ছোট পর্দায় জনপ্রিয়তার দিক থেকে একেবারে প্রথম সারিতে থাকে বিভিন্ন রিয়্যালিটি শো। গান, নাচ, রান্নাবান্না— নানা বিষয়ে হয় প্রতিযোগিতাগুলি। দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিযোগীরা আসেন এই সব শো-এ, সফল হন হাতেগোনা কয়েক জন। আবার এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা রিয়্যালিটি শো-এ হয়তো ততটা সাফল্য পাননি, কিন্তু পরবর্তী কালে পৌঁছে গিয়েছেন বহু দূরে।
তেমনই এক জন এই গায়িকা, যিনি নিজের পরিশ্রম এবং প্রতিভার জোরে মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন— তিনি নেহা কক্কড়। উত্তরাখণ্ডের (তৎকালীন উত্তরপ্রদেশ) হৃষীকেশে জন্ম তাঁর। মাত্র ৪ বছর বয়স থেকেই স্থানীয় জমায়েত এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলিতে গান গাইতেন ছোট্ট নেহা। গায়িকা হিসাবে সাফল্য লাভ করার আশায় ২০০৪ সালে দাদা টোনির হাত ধরে মুম্বইয়ে পাড়ি দেন তিনি।
২০০৫ সালে ‘ইন্ডিয়ান আইডল’-এর দ্বিতীয় সিজ়নে অংশগ্রহণ করেন নেহা। কয়েকটি পর্বের পরেই বাদ পড়ে যান। তবে হাল ছেড়ে দেননি। ২০০৮ সালে তাঁর প্রথম অ্যালবাম ‘নেহা দ্য রকস্টার’ মুক্তি পায়। দাদা টোনির সুরে ‘রোমিও জুলিয়েট’ নামেও একটি অ্যালবাম প্রকাশ করেন তিনি।
২০০৮ সালে ‘মীরাবাঈ নট আউট’ ছবিতে গায়িকা হিসাবে বলিউডে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। ওই বছরই এআর রহমানের সুরে ‘ব্লু’ ছবির আবহসঙ্গীতে কোরাসে কণ্ঠ দেন তিনি। এর পরে ‘না আনা ইস দেশ লাডো’ নামে একটি টেলি সিরিয়ালে শীর্ষসঙ্গীত গাওয়ার সুযোগ পান নেহা। ২০১০ সালে কন্নড় এবং তেলুগু সঙ্গীত জগতে পা রাখেন তিনি। কন্নড় চলচ্চিত্র ‘থামাসু’র শীর্ষসঙ্গীত এবং মাস্টার সেলিমের সঙ্গে ‘নোদু বারে’ গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। ‘থামাসু’র শীর্ষসঙ্গীতের জন্য সেরা মহিলা প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে মনোনীত হন তিনি।
ওই বছরই বিধি কাসলীওয়ালের ‘ইসি লাইফ মে…’ ছবির মাধ্যমে প্রথম বার পর্দায় মুখ দেখান নেহা। কপিল শর্মা এবং অলী অসগরকে সঙ্গী করে ‘কমেডি সার্কাসকে নয়া তানসেন’ নামে একটি রিয়্যালিটি শো-এও অংশগ্রহণ করেন তিনি।
২০১২ সালে প্রীতমের সঙ্গে জুটি বেঁধে ‘ককটেল’ ছবিতে ‘সেকেন্ড হ্যান্ড জওয়ানি’ নামে একটি গানে কণ্ঠ দেন নেহা। এই গানটির মাধ্যমেই বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি। ওই বছরেই বলিউড বাদশা শাহরুখ খানকে উৎসর্গ করে ‘এসআরকে অ্যান্থেম’ গানটি তৈরি করেন তিনি। গানটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেন সমালোচকেরা।
২০১৪ সালে ‘কুইন’ ছবির ‘লন্ডন ঠুমকদা’ গানটি সমালোচক মহলে প্রশংসিত হয়। এর পরে তাঁর গাওয়া একের পর এক গান জনপ্রিয় হয়েছে। ২০১৬ সালে হিন্দি ছবি ‘ফিভার’-এ নেহার গাওয়া ‘মিলে হো তুম’ গানটি হইচই ফেলেছিল। ইউটিউবেও রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল সেই গানের মিউজ়িক ভিডিয়ো। কারণ, তার আগে পর্যন্ত ইউটিউবে বলিউডের কোনও মিউজ়িক ভিডিয়ো এত বেশি ‘ভিউ’ পায়নি। নেহার সঙ্গে সেই গানে গলা মিলিয়েছিলেন তাঁর দাদা টোনি কক্কড়। গানটিতে কথা এবং সুরও দিয়েছিলেন টোনিই।
যে ‘ইন্ডিয়ান আইডল’-এ তিনি ব্যর্থতার স্বাদ পেয়েছিলেন, পরবর্তী কালে সেখানেই বিচারকের আসন অলঙ্কৃত করেন নেহা। তা-ও এক বার নয়, একাধিক বার। পর পর চারটি সিজ়নে (সিজ়ন ১০-১৩)। এ ছাড়া ‘সা রে গা মা পা লি’ল চ্যাম্প’, ‘সুপারস্টার সিঙ্গার’ নামের আরও দু’টি রিয়্যালিটি শো-এ বিচারকের আসনে ছিলেন এই গায়িকা।
২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি ‘ভিউ’ পাওয়া মহিলা শিল্পীদের তালিকায় দ্বিতীয় ছিলেন নেহা, ১৩৯০ কোটি ভিউ ছিল তাঁর। তিনিই প্রথম ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী, যিনি ইউটিউবের ডায়মন্ড অ্যাওয়ার্ড পান (২০২১ সাল)। স্পটিফাইয়ের বিচারে, ভারতের যে মহিলা সঙ্গীতশিল্পীকে সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করা হয়, তিনি নেহা। সারা বিশ্বের নিরিখে এই তালিকায় তিনি ২২তম।
‘তিসরি মঞ্জিল’ ছবির বিখ্যাত গান ‘চলতা মুসাফির’-এর সুর অনুসরণ করে তৈরি ‘বদরিনাথ কি দুলহানিয়া’ ছবির শীর্ষসঙ্গীতে দেব নেগী, ইক্কা সিংহ, মোনালি ঠাকুরের সঙ্গে কণ্ঠ দেন নেহাও। গানটি ইউটিউবে সবচেয়ে বেশি বার দেখা ভারতীয় ভিডিয়োগুলির তালিকায় ছিল। এর ‘ভিউ’ ছিল পাঁচ কোটিরও বেশি। ২০২০ সালে ভারতের প্রথম ১০০ জন ‘ডিজিটাল স্টার’-এর একজন হিসাবে নেহার নাম মনোনীত করেছিল ‘ফোর্বস’।
তবে বিতর্কও কম নেই নেহাকে ঘিরে। নেহার গাওয়া ‘বোতল খোল’ গানটির কথা নিয়ে আপত্তি তোলে ‘সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশন’। তাদের অভিযোগ ছিল, গানের কথাগুলি দ্বৈত অর্থবহ। নেহা এবং তাঁর দাদা টোনির বিরুদ্ধে কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগ উঠেছে একাধিক বার। বহু বিখ্যাত গানের কথা এবং সুর চুরি করেছেন তাঁরা, এমনটাই বলে থাকেন সঙ্গীতপ্রেমীরা।
সে তালিকায় কবিতা কৃষ্ণমূর্তির গাওয়া ‘টিপ্ টিপ্ বরসা পানি’, ‘তু চিজ় বড়ী হৈ মস্ত মস্ত’, অলকা যাগ্নিকের গাওয়া ‘ছম্মা ছম্মা’, ফাল্গুনী পাঠকের গাওয়া ‘ইয়াদ পিয়া কি আনে লগী’, ‘মৈঁনে পায়ল হৈ ছনকাই’ প্রভৃতি গান যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘কাঁটা লগা’ও।
বহু গানের প্রকৃত শিল্পীদের উপর্যুপরি অনুরোধ, সঙ্গীতপ্রেমীদের কটাক্ষ কিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি নেহাকে। গায়িকা জানান, তিনি এখন বিখ্যাত এবং সাফল্যের স্বাদ পাওয়ার পরে কোনও কিছুই তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। সম্প্রতি, মেলবোর্নের একটি অনুষ্ঠানে ঘণ্টা তিনেক দেরি করে পৌঁছোন তিনি। অপেক্ষা করার জন্য দর্শককে ধন্যবাদ জানিয়ে কেঁদে ফেলেন নেহা। এ-হেন কাণ্ডে তাঁকে ‘ড্রামা কুইন’ বলে কটাক্ষ করে নেটাগরিকদের একটি বড় অংশ।
কেবল কর্মজীবনই নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও বার বার বিতর্কে জড়িয়েছেন নেহা। ২০১৪ সাল থেকে অভিনেতা হিমাংশ কোহলির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে ছিলেন গায়িকা। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে একটি সর্বভারতীয় টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তাঁরা ঘোষণা করেন, শীঘ্রই সাত পাকে বাঁধা পড়বেন তাঁরা। তাঁর মাস তিনেকের মধ্যেই একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্টে বিচ্ছেদের কথা জানান নেহা।
এমন কথাও শোনা যায় যে, সঙ্গীতশিল্পী উদিত নারায়ণের পুত্র আদিত্যের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন গায়িকা। ‘ইন্ডিয়ান আইডল’-এর বিচারকের আসনে থাকাকালীন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক আদিত্যের সঙ্গে দুষ্টুমিষ্টি প্রেমালাপ চলত নেহার। একটি পর্বে অতিথি হিসাবে এসে নেহা বৌমা হলে কী হবে সে বিষয়ে মশকরা করেন স্বয়ং উদিত।
২০২০ সালের অগস্টে একটি মিউজ়িক ভিডিয়োয় কাজের সূত্রে পঞ্জাবি গায়ক-অভিনেতা রোহনপ্রীত সিংহের সঙ্গে আলাপ হয় নেহার। সেই আলাপ থেকে বন্ধুত্ব হয়ে প্রেমে গড়াতে বেশি সময় লাগেনি। সেই বছরেই ২৪ অক্টোবরে নয়াদিল্লির একটি গুরুদ্বারে রোহনপ্রীতের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন গায়িকা।
সম্প্রতি বিতর্ক তৈরি হয়েছে তাঁর পরিবারজীবন ঘিরেও। যে দিদিকে নিজের অনুপ্রেরণা বলে থাকেন গায়িকা, সমাজমাধ্যমের একটি পোস্টে সেই সোনু কক্কড়ই লেখেন, তিনি আর টোনি কক্কড় এবং নেহা কক্কড় নামের দুই প্রতিভাবান সুপারস্টারের বোন নন। তিনি মর্মাহত এবং প্রবল মানসিক যন্ত্রণাতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। টোনির জন্মদিনে অনুপস্থিত থাকার কিছু দিন পরেই এই পোস্ট করেন সোনু। এই ঘটনার নেপথ্য কারণ সম্পর্কে যদিও কিছু জানা যায়নি। তবে, অনেকের মতেই এ নিছকই নজরে আসার চেষ্টা।
সাফল্য, বিতর্ক সব কিছুকে সঙ্গী করেই কর্মজীবন এগিয়ে নিয়ে চলেছেন নেহা। সমাজমাধ্যমেও খুবই সক্রিয় তিনি। নেটাগরিকেরা বার বার কটাক্ষের বাণে বিদ্ধ করেছেন নেহাকে, তাঁর উদ্দেশে ধেয়ে এসেছে কুমন্তব্যও, এ সব কিছু সত্ত্বেও সমাজমাধ্যমে তাঁর অনুরাগীর সংখ্যা প্রায় ৮ কোটির গণ্ডি ছুঁয়েছে।