John Nicolson

সিপাহি বিদ্রোহ দমনের নিষ্ঠুর নায়ক, দিল্লির কবরখানায় এখনও ঘুরে বেড়ায় নিকোলসনের ‘প্রেত’

কে এই নিকোলসন? উত্তর খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে ১৮৫৭ সালে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:১৩
Share:
০১ ১৬

আপাতদৃষ্টিতে দিল্লির নিকোলসন সেমেটারি বা কাশ্মীর গেট গোরস্থানের সঙ্গে অন্য গোরস্থানের তেমন কোনও পার্থক্য চোখে পড়বে না। শান্ত প্রকৃতির মাঝখানে সারি সারি পুরনো সমাধি এক বিষণ্ণ-গম্ভীর পরিমণ্ডল তৈরি করে রেখেছে। কিন্তু এই আপাত-শান্তির পিছনেই রয়েছে বহু কাল ধরে চলে আসা এক কাহিনি। এবং সোজা বাংলায় বলতে গেলে, গল্পটি মোটেই ‘সুবিধের’ নয়।

০২ ১৬

বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে চলে আসা এই কাহিনির মূলে রয়েছে এক রহস্যময় ঘোড়সওয়ার। প্রতি রাতেই নাকি সেই ঘোড়সওয়ারকে দেখা যায় কবরখানায়। কেউ তাকে স্পষ্ট দেখেছেন, কেউ দেখেছেন তার ছায়া-অবয়ব। জনশ্রুতি, এই ঘোড়সওয়ার আদৌ রক্তমাংসের মানুষ নয়। সে প্রেত। যাঁর নামে এই কবরখানার নামকরণ, সেই নিকোলসন সাহেবের প্রেত।

Advertisement
০৩ ১৬

কে এই নিকোলসন? উত্তর খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে ১৮৫৭ সালে। দিল্লি তখন মহাবিদ্রোহের আগুনে উথালপাথাল। দিল্লির বিদ্রোহীদের সঙ্গে প্রবল লড়াই চলছে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাদের। সেই বাহিনীরই অন্যতম নায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জন নিকোলসন। মহাবিদ্রোহের সময় উল্লেখযোগ্য বীরত্বের পরিচয় রেখেছিলেন এই সেনানায়ক।

ছবি: সংগৃহীত।

০৪ ১৬

১৮২২ সালে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরে জন্ম নিকোলসনের। তাঁর মামা ছিলেন কলকাতার সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য। ১৬ বছর বয়সে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে মামার পরামর্শেই নিকোলসন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল ইনফ্যান্ট্রির ক্যাডেট হিসাবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তাঁর ভাই আলেকজ়ান্ডারও কোম্পানির বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন।

ছবি: সংগৃহীত।

০৫ ১৬

প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য নিকোলসনকে কাবুলে পাঠানো হয়। আফগান বাহিনীর হাতে তাঁর ভাই নিহত হন। ভাইয়ের ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ দেখে এবং নিজে আফগানদের হাতে বন্দি হয়ে নিকোলসন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি তীব্র ঘৃণাবোধ তাঁর মধ্যে জন্ম নেয়। ভারতে খ্রিস্টীয় সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করাকেই তিনি তাঁর জীবনের ব্রত বলে মনে করতে শুরু করেন।

ছবি: সংগৃহীত।

০৬ ১৬

১৮৪৫ সালে ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে পাঠানো হয় নিকোলসনকে। সেখানে রীতিমতো সাফল্যের পরিচয় রাখে তাঁর বাহিনী। কোম্পানির তরফে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয় তাঁকে। ১৮৭৬ সালে কাশ্মীর উপত্যকা বিষয়ে কোম্পানি সমর্থিত মহারাজা গুলাব সিংহের বিশেষ উপদেষ্টা হিসাবেও কাজ করেন নিকোলসন।

ছবি: সংগৃহীত।

০৭ ১৬

বেশ কিছু ক্ষেত্রে সামরিক প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন নিকোলসন। ইতিমধ্যে ১৮৫৭ সালে শুরু হয় মহাবিদ্রোহ। মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি দেখে নিকোলসন তাকে ‘গুটি বসন্ত’ রোগের সঙ্গে তুলনা করেন। বিদ্রোহী সিপাহিদের দমনে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। বিদ্রোহ দমনে নিকোলসনের যেন রোখ চেপে গিয়েছিল। ইতিহাসবিদদের ধারণা, এই জেদের নেপথ্যে তাঁর ভারত বিদ্বেষ প্রবল ভাবে কাজ করেছিল।

ছবি: সংগৃহীত।

০৮ ১৬

মহাবিদ্রোহে দিল্লি বিদ্রোহী সেনাদের দখলে এলে শহরকে দখলমুক্ত করার জন্য নজফগড়ের যুদ্ধে নিকোলসন তাঁর ২০০০ সৈন্যের বাহিনী নিয়ে বিপুল পরাক্রম দেখান। এই যুদ্ধে তাঁর সাফল্য তাঁকে কোম্পানির সেনাবাহিনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেনানায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেয়। কিন্তু এই যুদ্ধে তিনি এক বিদ্রোহী সিপাহির ছোড়া গুলিতে মারাত্মক ভাবে আহত হন।

ছবি: সংগৃহীত।

০৯ ১৬

কোম্পানির বাহিনী দিল্লি দখলে সমর্থ হয়। কিন্তু আহত নিকোলসনকে একটি ডুলিতে করে নিয়ে যাওয়ার সময় ব্রিটিশ সেনারা বিদ্রোহীদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন। তাঁকে ওই অবস্থাতেই ফেলে পালায় ব্রিটিশ সেনারা। এমন সময়ে লেফটেন্যান্ট ফ্রেডরিক রবার্টস তাঁকে উদ্ধার করেন। নিকোলসনকে হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি। কিন্তু তাঁর আঘাত এতটাই গুরুতর ছিল যে, তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। দিল্লি ইংরেজদের দখলে এসেছে, খবর পেয়ে শান্তিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁকে কাশ্মীর গেটের কাছে এক গোরস্থানে কবর দেওয়া হয়। সেই গোরস্থানই আজ ‘নিকোলসন সেমেটারি’ নামে পরিচিত।

ছবি: সংগৃহীত।

১০ ১৬

নিকোলসনের বীরত্বের কাহিনি ইংল্যান্ডে কোম্পানির কর্তাদের আলোড়িত করে। তাঁরা তাঁকে ‘হিরো অফ দিল্লি’ এবং ‘লায়ন অফ দ্য পঞ্জাব’ অভিধায় ভূষিত করেন। সমকালীন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদদের একাংশ তাঁর বিক্রমের কাহিনিকে প্রায় অতিমানবিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে বর্ণনা করতে শুরু করেন। এমনকি, রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের মতো সাহিত্যিকও এই বর্ণনার দ্বারা প্রভাবিত হন। সমকালীন ব্রিটিশ সাহিত্যে নিকোলসন এক মহাপরাক্রান্ত চরিত্র হিসাবে আবির্ভূত হতে শুরু করেন।

ছবি: সংগৃহীত।

১১ ১৬

বর্তমান পাকিস্তানের মারগালা গিরিপথের কাছে তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করায় ব্রিটিশ রাজ। স্বদেশেও একাধিক জায়গায় তাঁর মূর্তি স্থাপিত হয়।

ছবি: সংগৃহীত।

১২ ১৬

দিল্লি শহরে কিন্তু নিকোলসনকে ঘিরে গড়ে ওঠে অন্য এক কিংবদন্তি। ১৯ শতক থেকেই নিকোলসন সেমেটারিতে তাঁর প্রেতাত্মার হানা দেওয়া নিয়ে গল্প ছড়াতে শুরু করে। আজও অনেকের দাবি, কবরখানায় গভীর রাতে সেনার সাজে সজ্জিত নিকোলসনকে অশ্বারোহী অবস্থায় টহল দিতে দেখা যায়। অনেকে এমন দাবিও করে থাকেন যে, সশরীরে দেখা না গেলেও নিকোলসনের ঘোড়ার খুরের আওয়াজ তাঁরা শুনেছেন।

ছবি: সংগৃহীত।

১৩ ১৬

স্থানীয় বাসিন্দারা এবং কবরখানার তত্ত্বাবধায়কদের অনেকেই বলছেন, নিশুত রাতে নিকোলসনের ‘প্রেত’ নাকি অস্থির ভাবে ছুটে বেড়ায় গোটা গোরস্থান জুড়ে। বিশেষ করে শীতের কুয়াশার সময়ে ‘প্রেতের’ হানা নিয়মিত ঘটতে থাকে।

ছবি: সংগৃহীত।

১৪ ১৬

নিকোলসন জীবদ্দশায় ভারত-বিদ্বেষী ছিলেন। কিন্তু তাঁর ‘প্রেত’ কখনও কারও কোনও ক্ষতি করেছে, এমন কথা শোনা যায়নি। স্থানীয়দের বিশ্বাস, নিকোলসনের আত্মা ওই গোরস্থানে শায়িত মানুষদের রক্ষকের কাজ করে চলেছে কয়েক যুগ ধরে।

ছবি: সংগৃহীত।

১৫ ১৬

নিকোলসনের ‘প্রেত’ সংক্রান্ত এই গল্প কি ইংরেজদের দিল্লি বিজয়ের স্মৃতিকেই বহন করে চলেছে? কোম্পানির দিল্লি দখলের ঘটনা ভারতের ইতিহাসে এক ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতার অধ্যায়। অগণিত মানুষের রক্তপাতের পর দিল্লি কোম্পানির দখলে আসে। কিন্তু নিকোলসন নিজে সেই গণহত্যার সময় জীবিত ছিলেন না। কিংবদন্তির উপসংহারে এমন কথাও বলা হয় যে, তিনি জীবিত থাকলে ব্রিটিশ সেনা সেই বিপুল নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারত না। কারণ, ভারত সম্পর্কে যত বিদ্বেষই পোষণ করুন না কেন, নিকোলসন ছিলেন বীর। নিরীহ মানুষের উপরে অবলীলাক্রমে নির্যাতন তিনি হতে দিতেন না।

ছবি: সংগৃহীত।

১৬ ১৬

কাশ্মীর গেট গোরস্থান আজ ভূতসন্ধানীদের কাছে এক আকর্ষণীয় স্থান। গভীর রাতে সেখানে নিকোলসনের অশ্বারোহী প্রেতকে দেখা যাক বা না-যাক, ভূতান্বেষীর দল প্রায়শই হানা দেন সেখানে। দিল্লির ‘ঘোস্ট ট্যুরিজ়ম’-এর এক বিশেষ কেন্দ্র এই গোরস্থান।

ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement