দু’দিনের সফরে বৃহস্পতিবার ভারতে এসেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আমেরিকার সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক টানাপড়েনের মাঝে পুতিনের এই সফরে দিল্লির সঙ্গে বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় করতে চাইছে মস্কো। তেমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
ভারত বর্তমানে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানি করে, তার একটি বড় অংশ আসে রাশিয়া থেকে। প্রতিরক্ষা এবং সামরিক সরঞ্জামের ক্ষেত্রেও দিল্লি এবং মস্কোর মধ্যে দীর্ঘ কয়েক দশকের সুসম্পর্ক রয়েছে। এ অবস্থায় পুতিনের দিল্লি সফর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নয়াদিল্লি পৌঁছেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। সাধারণ প্রোটোকল অনুযায়ী কোনও বিদেশি রাষ্ট্রনেতা ভারত সফরে এলে তাঁকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে হাজির থাকেন বিদেশমন্ত্রী বা বিদেশ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী। কখনও বা দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য কোনও মন্ত্রী।
কিন্তু পুতিনকে স্বাগত জানাতে প্রোটোকল ভেঙে দিল্লির পালমে ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হাজির হন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রানওয়েতে দাঁড়িয়েই করমর্দনের পরে পুতিনকে আলিঙ্গন করে নয়াদিল্লি-মস্কো মৈত্রীর বার্তা তুলে ধরেন তিনি।
বিমানবন্দর থেকে একই গাড়িতে চড়ে রওনা দেন মোদী এবং পুতিন। সেই গাড়িতেও ছিল চমক। সে ক্ষেত্রেও ভাঙা হয় সাধারণ নিয়ম।
সাধারণত উচ্চ নিরাপত্তাবিশিষ্ট একটি রেঞ্জ রোভার গাড়ি চড়ে যাতায়াত করেন মোদী। কিন্তু পুতিন আসার পর সেই গাড়িতে না গিয়ে একটি সাদা টয়োটা ফরচুনারে চেপে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে রওনা দেন তিনি। তাঁর সঙ্গে ওই একই গাড়িতে বসেন পুতিনও, যা উভয় নেতার জন্যই প্রোটোকলের ব্যতিক্রম।
আর তার পর থেকেই তামাম দেশের নজর পড়েছে ওই সাদা ফরচুনার গাড়িটির উপর। মডেলের নাম, টয়োটা ফরচুনার সিগমা ৪ এমটি।
টয়োটা ফরচুনার সিগমা ৪ এমটি একটি শক্তিশালী ৪-ওয়াট ডিজ়েল এসইউভি। ২.৮ লিটার টার্বো ইঞ্জিন গাড়িটিতে রয়েছে ৬-স্পিড ম্যানুয়াল গিয়ারবক্স, ডাউনহিল অ্যাসিস্ট কন্ট্রোল (ডিএসি) এবং রিয়ার ডিফারেনশিয়াল লকের মতো বৈশিষ্ট্য।
পাশাপাশি গাড়িটিতে রয়েছে অত্যাধুনিক সুরক্ষা প্রযুক্তি এবং বুলেটপ্রুফ কাচ। গাড়িটির দাম ৫০ লক্ষ টাকার কাছাকাছি।
মোদী এবং পুতিন যে সাদা ফরচুনার সিগমা ৪ এমটি গাড়িটিতে চড়েছিলেন, তার নম্বর ছিল ‘এমএইচ০১ইএন৫৭৯৫’। রেকর্ড অনুযায়ী, গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন ২০২৪ সালের এপ্রিলে। বিস-৬ নির্গমন নিয়ম পূরণ করে গাড়িটির ইঞ্জিন। সম্প্রতি গাড়িটিকে অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে সাজানো হয়েছে। দেশে অতি বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং অতিথিদের যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত হয় গাড়িটি।
ফরচুনারটির ‘ফিটনেস সার্টিফিকেট’ ২০৩৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বৈধ। গাড়িটির পিইউসিসি সার্টিফিকেট ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত আপডেট করা হয়েছে। গাড়ির মধ্যে রয়েছে যে কোনও বিলাসবহুল অত্যাধুনিক গাড়ির সমস্ত সুবিধা। আর যে গাড়িতে মোদী এবং পুতিন, একসঙ্গে ভ্রমণ করছেন, তার নিরাপত্তা যে আকাশছোঁয়া হবে তা বলাই বাহুল্য।
তবে এ ক্ষেত্রে মোদীর গাড়ির নিরাপত্তা বা কাগজপত্র নয়, উল্লেখযোগ্য ছিল বেছে নেওয়া গাড়িটিকে নিয়েই। ফরচুনার প্রধানমন্ত্রীর নিয়মিত বহরের অংশ নয়। সাধারণত উচ্চ নিরাপত্তার রেঞ্জ রোভার গাড়িতে চড়েন তিনি। পুতিনও তাঁর প্রচলিত নিরাপত্তা প্রোটোকল থেকে সরে এসে ওই গাড়িতে চড়েছেন।
পুতিন নিজে যে গাড়িতে চড়েন, নিরাপত্তার দিক সেই গাড়ির খ্যাতি জগৎজোড়া। সেই গাড়ির মাহাত্ম্যও কম নয়। রুশ প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত সেই গাড়িটি অরাস সেনাট লিমুজ়িন। পুতিনের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয়েছে গাড়িটি।
১৯৪৫ সালে তৈরি সোভিয়েত যুগের লিমুজ়িন জ়েডআইএস-১১০-এর অনুকরণে তৈরি গাড়িটি রাশিয়ার অটোমোবাইল সংস্থা অরাস-এর নকশা করা। গাড়িটি তৈরি করেছে রাশিয়ার অটোমোটিভ প্রযুক্তি উন্নয়ন সংস্থা ‘সেন্ট্রাল সায়েন্টিফিক রিসার্চ অটোমোবাইল অ্যান্ড অটোমোটিভ ইঞ্জিন ইনস্টিটিউট’ ওরফে ‘নমি’।
এর আগে মার্সিডিজ়-বেন্জ় এস ৬০০ গার্ড পুলম্যান ব্যবহার করতেন পুতিন। ২০১৮ সাল থেকে সেনাট লিমুজ়িন গাড়িটি ব্যবহার করছেন রুশ প্রেসিডেন্ট।
পুতিনকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে গাড়িটি। একই সঙ্গে গাড়িটি রুশ সরকারের ক্ষমতা, মর্যাদা এবং শক্তির প্রতীক হিসাবেও চিহ্নিত।
লিমুজ়িনে ৪.৪ লিটার ভি৮ পেট্রল ইঞ্জিন রয়েছে। রয়েছে একটি বৈদ্যুতিক মোটরও। এর ইঞ্জিন প্রায় ৬০০ হর্সপাওয়ার ক্ষমতা উৎপাদনে সক্ষম, যা গাড়িটিকে মসৃণ ভাবে চলার জন্য যথেষ্ট গতি এবং শক্তি দেয়।
অরাসের সেনাট লিমুজ়িন গাড়িটির ওজন প্রায় ৬,২০০ কিলোগ্রাম। মাত্র ছ’সেকেন্ডে ঘণ্টায় ১০০ কিমি গতি তুলতে পারে গাড়িটি! পরবর্তী কয়েক সেকেন্ডে সেটি ২৫০ কিমি/ঘণ্টা গতিতে ছুটতে পারে। মনে করা হয় পুতিনের সেনাট লিমুজ়িনটি একটি ‘চলমান দুর্গ’।
গাড়িটিতে শক্তিশালী বুলেটপ্রুফ কাচ এবং পুরু সাঁজোয়া দরজা রয়েছে। গাড়ির মেঝে এবং ছাদের নীচেও সুরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, যা অতর্কিত আক্রমণের সময় গুলি এবং বিস্ফোরণ থেকে যাত্রীদের নিরাপদ রাখে।
পুতিন যখনই বিদেশ সফরে যান, তাঁর সঙ্গে যায় অরাস সেনাট লিমুজিনটি। বিমান থেকে নেমে সেই গাড়িতেই চড়েন। কিন্তু ভারত সফরে এসে তার ব্যতিক্রম দেখা গেল।
এ বারের দিল্লি সফরে ২৩তম ভারত-রাশিয়া বার্ষিক শীর্ষবৈঠকে যোগদান করবেন পুতিন। পাশাপাশি, শুক্রবার দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসের বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা সংক্রান্ত একাধিক চুক্তি সই হতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম, রাশিয়া থেকে আরও এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনা।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘ইন্ডিয়া টুডে’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বৃহস্পতিবার পুতিন বলেন, বলেন, “মহাকাশ গবেষণা, পরমাণুশক্তি, জাহাজ নির্মাণ, বিমান নির্মাণ-সহ একাধিক ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের স্বার্থে ভারত এবং রাশিয়া একসঙ্গে কাজ করছে।” তিনি জানিয়েছেন, ভারত এবং রাশিয়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার নিয়েও আলোচনা করবে।