আর মাত্র তিন মাস। তার পরেই চার বছরে পা দেবে ইউক্রেন যুদ্ধ। এই লড়াইয়ে ‘সুপার পাওয়ার’ রাশিয়ার হাতে বেদম মার খেয়েও হার মানতে নারাজ কিভ। উল্টে পূর্ণ উদ্যমে মস্কোর অপরিশোধিত খনিজ তেলের শোধনাগারগুলিতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছেন ‘ইউরোপের রুটির ঝুড়ি’র জেনারেলরা। কিন্তু আর কত দিন? এই অসীম সাহসিকতার চরম মূল্যই কি এ বার দিতে হবে তাদের? পূর্ব ইউরোপের দেশটির ফৌজি সংখ্যায় টান পড়ায় উঠে গিয়েছে সেই প্রশ্ন।
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ প্রথম বার সৈনিকের অভাবের বিষয়টি ইউক্রেনীয় জেনারেলদের নজরে আসে। এই সমস্যার দ্রুত সমাধান না হলে রণাঙ্গনের ‘ফ্রন্ট লাইন’ যে ভেঙে পড়বে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন তাঁরা, যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল কিভের পতন। আসন্ন বিপদের ভয়াবহতা খোদ প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির কানে উঠতে দেরি হয়নি। কিন্তু, জনবলের স্বল্পতা মেটানোর কোনও রাস্তাই দেখাতে পারেননি তিনি।
এ বছরে ইউক্রেনীয় বাহিনীতে সৈনিকের অভাবের সমস্যাটি আরও প্রকট হয়ে ওঠে। সম্প্রতি এই নিয়ে গণমাধ্যমে মুখ খোলেন কিভের জেনারেল প্রসিকিউটর। তাঁর কথায়, ‘‘লড়াইয়ের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতেই সৈনিকদের মধ্যে রণক্ষেত্র ছেড়ে পালানোর প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সামনের সারি ছেড়ে গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিচ্ছেন তাঁরা। কিছু কিছু জায়গায় সম্পূর্ণ পোস্ট খালি করে পালানোর কথাও রিপোর্ট করেছেন কমান্ডারেরা। কারণ, আমাদের ফৌজ গণহারে সহযোদ্ধাদের মৃত্যু দেখতে দেখতে ক্লান্ত, নিঃস্ব এবং ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে।’’
রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধরত ফৌজে জনবলের অভাব যে ভয়াবহ আকার নিয়েছে, তা স্বীকার করেছেন ইউক্রেনীয় পার্লামেন্টের প্রতিরক্ষা কমিটির সেক্রেটারি রোমান কোসতেনকো। তিনি জানিয়েছেন, গত দু’মাসে সেনা ক্যাম্পগুলি থেকে পালিয়েছেন প্রতি পাঁচের মধ্যে চার জন করে নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক। অন্য দিকে এই সময়সীমার মধ্যে দেশ ছেড়েছে এক লাখের বেশি তরুণ-তরুণী। প্রয়োজনে ঘুষ দিয়েও আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে ইউরোপের অন্যত্র চলে গিয়েছেন তাঁরা। ফলে যুদ্ধের জন্য নতুন ফৌজ পেতে সমস্যা হচ্ছে সরকারের।
জ়েলেনস্কি প্রশাসনের দাবি, পুরনো হোক বা নতুন, বাহিনীর অধিকাংশ সেনার মনে চেপে বসেছে মৃত্যুভয়। রাশিয়ার সঙ্গে লড়াইয়ে জয়ের সম্ভাবনা যে ক্ষীণ, তা বুঝে গিয়েছেন তাঁরা। আর তাই চিকিৎসা হোক বা অন্য কোনও কারণ, এক বার ছুটি পেলেই দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন ওই সমস্ত ফৌজি। বাকিরা রণাঙ্গনে পৌঁছেও কমান্ডারদের আদেশ পালনে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। উল্টে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে তাঁদেরই চ্যালেঞ্জ করে গোলমাল পাকিয়ে তুলছেন।
এ প্রসঙ্গে ইউক্রেনীয় সামরিক বিশ্লেষক ওলেক্সান্ডার কোভালেনকো বলেছেন, ‘‘যুদ্ধের জন্য হাতিয়ার সংগ্রহের থেকেও এই সমস্যার সমাধান জ়েলেনস্কির পক্ষে বেশি কঠিন। আগামী দিনে তা আরও বাড়বে। ফলে ১৮ বছর বা তার চেয়েও কম বয়সিদের ফৌজে নিয়োগের অনুমতি দিতে পারেন তিনি। আমেরিকার দিক থেকে ইতিমধ্যেই তাঁর উপরে সেই চাপ আসতে শুরু করেছে। যদিও এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি কিভ। কারণ, সে ক্ষেত্রে প্রবল গণবিক্ষোভের মুখে পড়তে পারে সরকার।’’
কিন্তু তাই বলে পলাতক সৈনিকদের জ়েলেনস্কি প্রশাসন ক্ষমা করে দিচ্ছে, এমনটা নয়। ধরা পড়লে সামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাঁদের। বিষয়টি নিয়ে সংবাদসংস্থা ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’-এর (এপি) কাছে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফৌজিদের একাংশ। তাঁদের দাবি, পলাতক সৈনিকদের ফের রণাঙ্গনে পাঠাতে অমানবিক আচরণ করছেন কমান্ডারেরা। এতে বাহিনীতে বাড়ছে বিদ্রোহ।
এ বছরের সেপ্টেম্বরের গোড়ায় ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’কে ইউক্রেনের ৭২ নম্বর ব্রিগেডের এক সেনা অফিসার বলেন, ‘‘আমরা মরণপণ লড়াই করেও ভুহলেদার শহরকে বাঁচাতে পারিনি। এর একটা বড় কারণ হল জনবলের অভাব। এখন জোর করে পলাতক সৈনিকদের যুদ্ধের ময়দানে পাঠানো হচ্ছে। এতে ফল হবে হিতে বিপরীত। রণক্ষেত্রে প্রাণ দেওয়ার চেয়ে আত্মসমর্পণে বেশি আগ্রহী তাঁরা। অনিচ্ছুক ঘোড়া কোনও দৌড় জিততে পারে না, এই সহজ সত্যিটা বুঝতে হবে।’’
ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, গত বছর (পড়ুন ২০২৪) রণাঙ্গন এবং বাহিনী ছেড়ে পালানোর প্রবণতা ছিল সবচেয়ে বেশি। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় কিভের হাতে ছিল তিন লক্ষ সেনার ফৌজ। গত সাড়ে তিন বছরের বেশি সময়ে তার চেয়ে বেশি তরুণ-তরুণী দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এ সংক্রান্ত কোনও সঠিক সংখ্যা দিতে পারেনি জ়েলেনস্কি প্রশাসন।
সম্প্রতি সংবাদসংস্থা এপিকে সাক্ষাৎকার দেন পলাতক হিসাবে চিহ্নিত ইউক্রেনীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সৈনিক সের্হি হ্নেজদিলভ। তাঁর কথায়, ‘‘একের পর এক ফ্রন্ট লাইন ভেঙে পড়ায় আমি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলাম। সেই অধিকার আমার আছে। এটা আত্মসমর্পণের চেয়ে বেশি সম্মানের। কিন্তু, কমান্ডারেরা সেটা মঞ্জুর করেননি।’’ অন্য দিকে এ ব্যাপারে আরও বিস্ফোরক কথা বলতে শোনা গিয়েছে পলাতক আর এক ফৌজিকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউক্রেনের পদাতিক ইউনিটের আর এক সৈনিক এপিকে বলেন, ‘‘অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হওয়ায় আমাকে রণাঙ্গন থেকে সরিয়ে আনা হয়। বেশ কিছু দিন হাসপাতালে ছিলাম। সুস্থ হয়ে সেখান থেকে পালাই। কারণ যুদ্ধের ময়দানে ফিরে যাওয়ার সাহস আমার নেই। গত কয়েক মাসের দুঃস্বপ্নটা ভুলে যেতে পারলে ভাল হত। ওখানে শুধুই রক্ত আর মৃত্যু। এই মুহূর্তে যে পাশে আছে, তাঁরই ছিন্নভিন্ন লাশ দেখতে হবে পরের মুহূর্তে। আমরা একটা গুলি ছুড়লে, শত্রুপক্ষের দিক থেকে ছুটে আসছে ৫০টা বুলেট।’’
রণাঙ্গনে মোতায়েন ইউক্রেনীয় সৈনিকদের বেশির ভাগের অভিযোগ, তাঁদের একেবারে সামনের সারিতে রেখে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে বসে যাবতীয় আদেশ দিচ্ছেন কমান্ডারেরা। বাহিনীকে একটা জেলখানায় পরিণত করেছেন তাঁরা। ফলে দেশরক্ষার মানসিক দৃঢ়তা খুঁজে পাওয়া দিন দিন কঠিন হচ্ছে। কেউ কেউ তো আবার মারাত্মক অবসাদে ভুগছেন। অন্য দিকে গোদের উপর বিষফোড়ার মতো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রণকৌশল বদলে যাচ্ছে রাশিয়ার। গত সাড়ে তিন বছরে অধিকৃত এলাকাগুলিকে একরকম দুর্গে পরিণত করেছে মস্কো।
এপিকে গোলন্দাজ বাহিনীর সৈনিক হ্নেজ়দিলভ বলেছেন, ‘‘আমাদের রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির অভাব রয়েছে। এর জেরে নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলিকে সঠিক ভাবে রক্ষা করা যাচ্ছে না।’’ গ্রেফতার হওয়া পলাতক সৈনিকদের অভিযোগ, পুরোপুরি ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার কথা শুনে চলছেন জ়েলেনস্কি। ফলে দিন দিন মৃতের সংখ্যা বাড়লেও সংঘর্ষবিরতির নামগন্ধ করছেন না তিনি। ফলে ইউক্রেন পুরোপুরি ভাবে সমাধিক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন তাঁরা।
গত দু’বছরে ইউক্রেনের শৈলশহর ভুহলেদারে দাঁত ফোঁটাতে পারেনি রুশ ফৌজ। ওই এলাকার কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। কিভের পদাতিক বাহিনীর ৭২ নম্বর ব্রিগেড কমান্ডার জানিয়েছেন, ভুহলেদারে মোতায়েন প্রতি কোম্পানিতে অন্তত ১২০ জন করে সৈনিক রাখা উচিত ছিল। কিন্তু মস্কোর আক্রমণে নিহত ও আহতদের পাশাপাশি জওয়ানদের পালিয়ে যাওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় একটা সময়ে সেটা ১০-এ নেমে আসে। এর পর এলাকাটা কব্জা করতে ক্রেমলিনের বাহিনীর তেমন সমস্যা হয়নি।
ইউক্রেনীয় সেনা অফিসারদের দাবি, ভুহলেদারের যুদ্ধে রণক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়েছেন অন্তত ২০ শতাংশ সৈনিক। সব মিলিয়ে ওখানে চার হাজার জওয়ানের ঘাটতি ছিল। ল়ড়াইয়ের মধ্যে রুশ আক্রমণের চাপ সহ্য করতে না পেরে এক দিকের বাহিনী কিছুটা পিছিয়ে এসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সামনের দিকে এগোনোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু, সৈনিকদের একাংশ সেটা পালন করতে চায়নি। ফলে সকলের সামনেই তাঁদের গুলি করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডারেরা। তবে সেটা কোনও বিদ্বেষ থেকে নয়, শহর বাঁচানোর তাগিদে।
ইউক্রেনের এই সমস্যা মস্কোর ফৌজে যে দেখা যায়নি, এমনটা নয়। আসন্ন বিপদ আঁচ করে তড়িঘড়ি তাই তিনটি পদক্ষেপ করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। প্রথমত, সৈন্যসংখ্যার অভাব মেটাতে ‘ডেমোক্র্যাটিক পিপল্স রিপাবলিক অফ কোরিয়া’ বা ডিপিআরকের (পড়ুন উত্তর কোরিয়া) সর্বোচ্চ নেতা (পড়ুন সুপ্রিম লিডার) কিম জং-উনের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন তিনি। সেই সমঝোতা অনুযায়ী ইউক্রেনের রণাঙ্গনে জওয়ান ও অফিসারদের পাঠায় পিয়ংইয়ং।
এ ছাড়া সৈনিকের অভাব পূরণের ক্ষেত্রে পুতিনের হাতে আরও দু’টি বিকল্প রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকা ভাড়াটে বাহিনী ‘ওয়াগনার গ্রুপ’। যুদ্ধের গোড়ার দিকে ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী শহরগুলি দখলের দায়িত্ব তাদের উপরেই দিয়েছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট। মস্কোর আসল ফৌজকে সে ভাবে ব্যবহার করেননি তিনি। এ ছাড়া চেচেন রিপাবলিকের প্রধান রমজ়ান কাদিরভের বাহিনীও ক্রেমলিনের জন্য সংশ্লিষ্ট লড়াইয়ে ঘাম-রক্ত ঝরাচ্ছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।
রুশ প্রেসিডেন্টের তৃতীয় সুবিধা হল বেলারুশ। সেখানকার প্রেসিডেন্ট আলেকজ়ান্ডার লুকাসেঙ্কিকে পুতিনের ‘হাতের পুতুল’ বললে অত্যুক্তি হবে না। মস্কোর প্রতিবেশী এই দেশটি ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। ইউক্রেন যুদ্ধে কৌশলগত সুবিধা পেতে সেখানকার জমি বর্তমানে ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করছেন ক্রেমলিনের কমান্ডারেরা। বেলারুশে পরমাণু হাতিয়ারও নিয়ে গিয়েছেন তাঁরা।
এই পরিস্থিতি ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের সেনায় নিয়োগের অনুমতি দিলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অন্য দিকে মোড় নিতে পারে। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-’৪৫ সাল) সময় অপ্রাপ্তবয়স্কদের ফৌজে ভর্তি করে ফ্রান্সে পাঠান জার্মান ফ্যুয়েরার আডল্ফ হিটলার। তাঁদের বেশির ভাগই ছিল নাৎসিদের আধাসেনা ‘শুটজস্টাফেল’ বা এসএস-এর সদস্য। ফ্রান্স দখলের পর চরম নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছিল তাঁরা।
বিশ্বযুদ্ধ থামলে বাহিনীতে অপ্রাপ্তবয়স্কদের ভর্তি করার নিয়মে দুনিয়া জুড়ে জারি হয় কড়া নিষেধাজ্ঞা। চাপে পড়ে সেই নিয়ম ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন জ়েলেনস্কি। কারণ, তাঁর পশ্চিমি ‘বন্ধু’রা হাতিয়ার সরবরাহ করলেও রণাঙ্গনে যে সৈনিক পাঠাবে না, তা একরকম স্পষ্ট। শেষ পর্যন্ত এর জল কোন দিকে গড়ায় সেটাই এখন দেখার।