দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের বালোচিস্তানে এ বার মার্কিন নৌঘাঁটি? সেখান থেকে ইরান ও আফগানিস্তানের উপর নজরদারি চালাবে আমেরিকা? আরব সাগরের উপকূলে যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন বন্দর তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে ইসলামাবাদ। সেই খবর প্রকাশ্যে আসতেই একাধিক প্রশ্নে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। বিশ্লেষকদের একাংশের অবশ্য দাবি, বন্দর নির্মাণে ওয়াশিংটনকে ডেকে ‘খাল কেটে কুমির আনছে’ ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী। অন্য দিকে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে গোটা ঘটনার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে নয়াদিল্লি।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম ‘ফিন্যান্সশিয়াল টাইম্স’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বালোচিস্তানের সমুদ্র তীরবর্তী শহর পাসনিতে বন্দর নির্মাণের প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছে পাক প্রশাসন। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ওয়াশিংটনের সামনে গোটা পরিকল্পনাটি রাখেননি প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকারের এক শীর্ষ আধিকারিকের কাছে সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবটি তুলে ধরেন ইসলামাবাদের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের এক পরামর্শদাতা। প্রস্তাবিত প্রকল্পে রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলদের অন্তর্ভুক্তি থাকায় দানা বেঁধেছে সন্দেহ।
‘ফিন্যান্সশিয়াল টাইম্স’-এর অবশ্য দাবি, পাসনির প্রস্তাবিত বন্দরে যুক্তরাষ্ট্র কোনও নৌঘাঁটি তৈরি করুক, তা চায় না ইসলামাবাদ। যদিও বাস্তবে সেটা কতটা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ইরান ও আফগানিস্তান লাগোয়া বালোচিস্তানের এই শহরটির ‘কৌশলগত অবস্থান’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংশ্লিষ্ট পাক প্রদেশটিতে রয়েছে চিন নিয়ন্ত্রিত গ্বদর বন্দর, পাসনি থেকে যার দূরত্ব মেরেকেটে ১৪২ কিলোমিটার।
অন্য দিকে দক্ষিণ ইরানের চাবাহার বন্দরটি বালোচিস্তানের এই উপকূল শহর থেকে মাত্র ৩০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। চাবাহার নিয়ে গত বছর তেহরানের সঙ্গে ১০ বছরের চুক্তি করে নয়াদিল্লি। বর্তমানে আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বন্দরটি ভারতের একমাত্র ভরসা। এর জন্য সেখানে শহিদ বেহেস্তি টার্মিনাল গড়ে তুলতে বিপুল লগ্নি করেছে কেন্দ্র। পাসনির প্রস্তাবিত বন্দর নির্মাণে শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প প্রশাসন রাজি হলে আমেরিকা যে চাবাহারের উপরে নজরদারি করতে পারবে, তা বলাই বাহুল্য।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কথায়, পাকিস্তানের দেওয়া টোপ অনায়াসে গিলতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, প্রস্তাবিত পাসনি বন্দরের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হাতে থাকলে বেশ কিছু সুবিধা হবে আমেরিকার। প্রথমত, এর জেরে আরব সাগরীয় এলাকায় বাড়বে মার্কিন প্রভাব। দ্বিতীয়ত, ইরান ও আফগানিস্তানের পাশাপাশি পারস্য উপসাগর ও হরমুজ় প্রণালীর উপর শ্যেন দৃষ্টি রাখতে পারবে ওয়াশিংটন। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের বাণিজ্যিক সুবিধাও নেহাত কম নয়।
সূত্রের খবর, মার্কিন আধিকারিকদের ইসলামাবাদ জানিয়েছে নতুন বন্দরের মাধ্যমে বালোচিস্তানের দুষ্প্রাপ্য খনিজ সহজেই আমদানি করতে পারবে আমেরিকা। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগপতিরা চাইলে খনিজ সমৃদ্ধ সংশ্লিষ্ট প্রদেশটির বিভিন্ন এলাকাকে রেলপথে জুড়তে বিপুল লগ্নি করতে পারেন। যাবতীয় রেললাইনের গন্তব্য অবশ্য দাঁড়াবে ওই বন্দর। এ ব্যাপারে কোনও রকমের আপত্তি করবে না পাক সরকার।
তৃতীয়ত, প্রস্তাবিত পাসনি বন্দরকে কাজে লাগিয়ে চিনের তৈরি গ্বদর বন্দরের উপরে নজর রাখতে পারবে আমেরিকা। আরব সাগরীয় এলাকায় বেজিঙের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নৌবাহিনীর আনাগোনা বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ইরানের পরমাণু কর্মসূচির উপরেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে চায় ওয়াশিংটন। প্রস্তাবিত পাসনি বন্দর এই সব কিছু পূরণ করতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসনকে বন্দর নির্মাণের ‘মেগা অফার’ দেওয়ার নেপথ্যে পাকিস্তানের আবার অন্য অঙ্ক রয়েছে। এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে মার্কিন লগ্নি টানতে চাইছে ইসলামাবাদ। গত কয়েক বছর ধরেই ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির ‘ভাঁড়ে মা ভবানী’ অবস্থা। পাসনি বন্দরের কাজ শুরু হলে কোষাগারে যে কোটি কোটি ডলার আসতে থাকবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ওই টাকায় আর্থিক পরিস্থিতি শুধরে ফেলার পরিকল্পনা রয়েছে শাহবাজ় সরকারের, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
দ্বিতীয়ত, পাসনিকে সামনে রেখে বেজিঙের কবল থেকে ধীরে ধীরে মুক্তি পেতে চাইছে ইসলামাবাদ। ২০১৩ সালে চিনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয় পাকিস্তান। এরই অংশ হিসাবে ড্রাগনভূমির শিনজ়িয়ান প্রদেশ থেকে গ্বদর বন্দর পর্যন্ত প্রায় দু’হাজার কিলোমিটার লম্বা রাস্তা তৈরি করছে চিন। এরই পোশাকি নাম ‘চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক বারান্দা’ বা সিপিইসি (চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর)।
গত ১২ বছরে এই প্রকল্পে বিপুল অঙ্কের লগ্নি করেছে চিন। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের আওতায় পাকিস্তানের ভিতরে গড়ে উঠেছে একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ ছাড়া বেজিঙের সহযোগিতায় গ্বদরে একটি বিমানবন্দরেরও উদ্বোধন করে শাহবাজ় সরকার। কিন্তু, এত কিছুর পরেও ইসলামাবাদের আর্থিক দিক থেকে মুনাফা হয়েছে এমনটা নয়। যাত্রীর অভাবে বর্তমানে ধুঁকছে ওই বিমানবন্দর। অন্য দিকে সিপিইসির জন্য ঘাড়ে চেপেছে পাহাড়প্রমাণ ঋণ।
আর তাই পুরনো ‘বন্ধু’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই ফিরে গিয়েছে পাকিস্তান। গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) মধ্যে চলা ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-এর সময়ে ওয়াশিংটনের একাধিক সামরিক জোটে ছিল ইসলামাবাদ। ফলে ‘সুপার পাওয়ার’ দেশটির কৃপাদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়নি ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী। শুধু তা-ই নয়, মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) নিরিখে ওই সময়ে নয়াদিল্লিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান।
বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য মনে করেন, ২০২৫ সালের একেবারে শেষে পৌঁছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করলেও কোনও অবস্থাতেই পুরনো আর্থিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে না ইসলামাবাদ। উল্টে প্রস্তাবিত বন্দর প্রকল্পটির জন্য বড় বিপদের মুখে পড়তে পারে ইসলামাবাদ। কারণ, ইরানের পক্ষে পারস্য উপসাগরের গায়ে মার্কিন উপস্থিতি মেনে নেওয়া অসম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রকে বহু বার ‘বড় শয়তান’ বলে উল্লেখ করেছেন তেহরানের শিয়া ধর্মগুরু তথা সর্বোচ্চ নেতা (সুপ্রিম লিডার) আয়াতোল্লা আলি খামেনেই।
সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশের অনুমান, পাসনির প্রস্তাবিত বন্দর তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্র রাজি হলে ইউক্রেনের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে পাকিস্তান। সে ক্ষেত্রে একযোগে ইরান এবং আফগানিস্তানের আক্রমণ সহ্য করতে হতে পারে ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের বাহিনীকে। এ বছরের সেপ্টেম্বরে পঠানভূমির বাগরাম বিমানঘাঁটি সেখানকার তালিবান শাসকদের থেকে ফেরত চেয়েছেন ট্রাম্প। নইলে হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে সেনা অভিযান পাঠানোর ইঙ্গিতও দিয়েছেন তিনি।
ট্রাম্পের হুমকি অবশ্য একেবারেই গায়ে মাখেনি আফগানিস্তানের তালিবান সরকার। উল্লেখ্য, জমি দিয়ে ঘেরা হিন্দুকুশের কোলের দেশটিকে আক্রমণ করা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে মোটেই সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের কোনও না কোনও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে হবে ওয়াশিংটনকে। সে দিক থেকে প্রস্তাবিত পাসনি প্রকল্প পঠানভূমির জাতীয় নিরাপত্তা যে বিঘ্নিত করবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ফলে এ ব্যাপারে তালিবানের পক্ষে চুপ করে বসে থাকা সম্ভব নয়।
পাকিস্তানের তৃতীয় বিপদের জায়গাটি হল চিন। প্রস্তাবিত পাসনি বন্দরের মাধ্যমে বালোচিস্তানে আমেরিকার পা পড়লে সেখান থেকে পাত্তারি গোটাতে হতে পারে বেজিংকে। খনিসমৃদ্ধ ওই এলাকায় বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে ড্রাগন সরকারের। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং সামরিক দিক থেকে গুরত্বপূর্ণ গ্বদর বন্দরকে নিয়ন্ত্রণে নিতে মান্দারিনভাষীদের কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। ইসলামাবাদের একটি সিদ্ধান্তেই সব কিছু জলাঞ্জলি দিতে হতে পারে তাদের।
সব শেষে অবশ্যই বলতে হবে বালোচিস্তানের স্থানীয় বিদ্রোহের কথা। দীর্ঘ দিন ধরে স্বাধীনতার দাবিতে দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের এই প্রদেশটিতে চলছে গণআন্দোলন। সেখানে প্রায়ই বালোচ বিদ্রোহীদের আক্রমণের শিকার হয় ইসলামাবাদের ফৌজ। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে পাসনি বন্দরের প্রকল্প শাহবাজ় সরকার তুলে দিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
এ বছরের সেপ্টেম্বরের শেষে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভার বৈঠকে যোগ দিতে মার্কিন সফরে যান পাক প্রধানমন্ত্রী শরিফ। তাঁর সঙ্গী ছিলেন ফিল্ড মার্শাল মুনির। সূত্রের খবর, সংশ্লিষ্ট বৈঠকের ফাঁকে ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে প্রস্তাবিত বন্দর প্রকল্পটি নিয়ে একপ্রস্ত আলোচনা করেন তাঁরা। ওই সময়ে একটি কাঠের বাক্স খুলে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দুষ্প্রাপ্য খনিজের কিছু নমুনাও দেখান মুনির।
এর পরই ইসলামাবাদের সঙ্গে ৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগের একটি চুক্তি সেরে ফেলে যুক্তরাষ্ট্রের একটি খনিজ় সংস্থা। বৈদ্যুতিন গাড়ি এবং বিভিন্ন প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল বিরল ধাতু। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই দুষ্প্রাপ্য খনিজের জন্য চিনের উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে তা কমাতে চাইছে আমেরিকা। যদিও পাকিস্তানে এই ধরনের কোনও খনিজের ভান্ডার রয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। সেই কারণেই ইসলামাবাদের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক উত্তর দেওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই মনে করছে বিশ্লেষকদের একাংশ।