বড়দিনের এক মাস আগেই কি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের থেকে ‘মেগা উপহার’ পাচ্ছে সৌদি আরব? রিয়াধের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর গর্বের পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেলথ’ শ্রেণির লড়াকু জেট এফ-৩৫ লাইটনিং টু তুলে দেবেন তিনি? সেই খবর প্রকাশ্যে আসতেই পশ্চিম এশিয়ার উপসাগরীয় দেশগুলির মধ্যে পড়ে গিয়েছে শোরগোল। স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে একটি প্রশ্ন— আর্থিক মুনাফার লোভে ‘ঘরের ছেলে’ ইজ়রায়েলকে চরম বিপদের মুখে ফেলতে চলেছে ওয়াশিংটন?
এফ-৩৫ লড়াকু জেটের মার্কিন-সৌদি সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে সম্প্রতি একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংবাদসংস্থা রয়টার্স। সেখানে বলা হয়েছে, রিয়াধকে ওই যুদ্ধবিমান বিক্রি করা যায় কি না, তা বিবেচনা করে দেখছে ট্রাম্প প্রশাসন। আগামী ১৮ নভেম্বর আমেরিকা সফরে যাচ্ছেন উপসাগরীয় আরব মুলুকটির যুবরাজ তথা প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ বিন সলমন। তিনি ওয়াশিংটন পৌঁছোলে সংশ্লিষ্ট সমঝোতাটিকে চূড়ান্ত রূপ দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ সদর দফতর পেন্টাগন।
এখনও পর্যন্ত কোনও আরব দেশকে এফ-৩৫ বিক্রি করেনি যুক্তরাষ্ট্র। ফলে চুক্তি চূড়ান্ত হলে প্রথম দেশ হিসাবে সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটিকে হাতে পাবে সৌদি। ২০২৫ সালের গোড়ায় দ্বিতীয় বারের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসাবে ট্রাম্প শপথ নেওয়ার কয়েক দিনের মাথায় তাঁর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে রিয়াধ। তখনই ৪৮টি পঞ্চম প্রজন্মের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে চেয়েছিলেন যুবরাজ সলমন। যদিও ওই সময় ওয়াশিংটনের থেকে কোনও আশ্বাস পাননি তিনি।
গত মে মাসে সৌদির জন্য ১৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারের বিরাট একটি অস্ত্র প্যাকেজের অনুমোদন দেন ট্রাম্প। তাতে ছিল আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, বিমানবাহিনীর একাধিক হাতিয়ার, মহাকাশভিত্তিক ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং ফৌজি যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করার বিভিন্ন সরঞ্জাম। রয়টার্সের দাবি, ওই তালিকায় ছিল না এফ-৩৫ লড়াকু জেটের নাম। পরে সিদ্ধান্ত বদলে এ ব্যাপারে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করে ওয়াশিংটন, খবর সূত্রের।
আমেরিকার যুদ্ধ দফতরের এক পদস্থ কর্তাকে উদ্ধৃত করে রয়টার্স লিখেছে, পেন্টাগনের নীতি বিভাগ এ ব্যাপারে গত কয়েক মাস ধরেই কাজ করে যাচ্ছে। সেখানে আলোচনা প্রতিরক্ষা সচিব পর্যন্ত পৌঁছেছে। তবে এফ-৩৫ লড়াকু জেট বিক্রির আনুষ্ঠানিক অনুমোদন প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভা এবং মার্কিন পার্লামেন্ট ‘কংগ্রেস’-এর থেকে সবুজ সঙ্কেত পেলে তবেই চুক্তির কাগজে সই করতে পারবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। আর তাই যুবরাজ সলমনের সফরের আগে গোটা প্রক্রিয়াটি শেষ হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্টই কম।
পঞ্চম প্রজন্মের এফ-৩৫ লড়াকু জেটের নির্মাণকারী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সংস্থাটি হল ‘লকহিড মার্টিন’। পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে একমাত্র ইজ়রায়েলের কাছেই আছে তাদের তৈরি এই যুদ্ধবিমান। ফলে শত্রুর আকাশে সামরিক আধিপত্য পেতে কখনওই সমস্যা হয়নি ইহুদি বিমানবাহিনীর। ২০২৩ সালের মধ্যে তাদের বহরে চলে আসে ৫০টি এফ-৩৫ লাইটনিং টু লড়াকু জেট। পরবর্তী সময়ে তেল আভিভ এই ধরনের আরও ২৫টি যুদ্ধবিমানের বরাত দেয় ওয়াশিংটনকে।
এই পরিস্থিতিতে সৌদি বিমানবাহিনী এফ-৩৫-এর মতো অত্যাধুনিক লড়াকু জেট হাতে পেলে পশ্চিম এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে আসতে পারে বড় পরিবর্তন। সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা চুক্তিটি হওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বাধা হল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইজ়রায়েলের দীর্ঘস্থায়ী চুক্তি। এর শর্ত অনুযায়ী ইহুদিদের সরবরাহ করা কোনও হাতিয়ার কখনওই তাদের প্রতিবেশী বা প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে বিক্রি করে না আমেরিকা। ট্রাম্পের পক্ষে সেই সমঝোতা ভেঙে ফেলা একেবারেই সহজ নয়।
কিন্তু তার পরেও এ ব্যাপারে উদ্বেগ রেখে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইজ়রায়েলি গণমাধ্যম ‘দ্য জেরুজ়ালেম পোস্ট’। সেখানে বলা হয়েছে, আমেরিকার পাশাপাশি ইরান, রাশিয়া এবং চিনের সঙ্গে ধীরে ধীরে সম্পর্ক মজবুত করছে রিয়াধ। সংশ্লিষ্ট দেশগুলির মধ্যে সামরিক জোট গড়ে ওঠার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে এফ-৩৫ হাতে পেলে এর প্রযুক্তি মস্কো, বেজিং এবং তেহরানের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে সৌদি সরকার। তখন তেল আভিভের পক্ষে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইজ়রায়েলি ফৌজের এক শীর্ষকর্তা ‘দ্য জেরুজ়ালেম পোস্ট’কে বলেছেন, ‘‘মার্কিন কংগ্রেস এফ-৩৫ বিক্রির অনুমোদন দিলে আমাদের কৌশল বদলাতে হবে।’’ পশ্চিম এশিয়ার এই ইহুদি রাষ্ট্রটিকে কখনওই স্বীকৃতি দেয়নি সৌদি আরব এবং ইরান। ২০২৫ সালের জুনে স্বল্প পরিসরে একটি যুদ্ধেও জড়িয়ে পড়ে তেহরান এবং তেল আভিভ। সেই সংঘাত ১২ দিন স্থায়ী হয়েছিল। সংঘর্ষের একেবারে শেষ পর্যায়ে ইহুদিদের পাশে দাঁড়িয়ে সাবেক পারস্য দেশে বোমাবর্ষণ করে মার্কিন বায়ুসেনা।
এফ-৩৫ লড়াকু জেটের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল এর ‘স্টেলথ’ প্রযুক্তি। বিশ্বের যে কোনও রেডারকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে ওই মার্কিন যুদ্ধবিমানের। ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালীন খুব দ্রুত সাবেক পারস্য দেশটির আকাশের দখল নিয়ে ফেলে ইহুদি বায়ুসেনা। শুধু তা-ই নয়, বিমান থেকে হামলা চালিয়ে খুঁজে খুঁজে তেহরানের আধা সেনা ‘ইসলামিক রিপাবলিক অফ গার্ড কোর’ বা আইআরজিসি কর্তা এবং পরমাণু গবেষকদের নিকেশ করে তেল আভিভ। প্রতিটা ক্ষেত্রেই সামনের সারিতে ছিল এফ-৩৫।
আর ঠিক এই কারণেই একটা সময়ে সংশ্লিষ্ট যুক্তবিমানটিকে হাতে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে তুরস্ক। এই নিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনাও সেরেছিল আঙ্কারা। কিন্তু, ২০১৯ সালে রাশিয়ার থেকে এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনতেই বদলে যায় সব হিসাব। কোনও অবস্থাতেই ইস্তানবুলকে এফ-৩৫ লড়াকু জেট বিক্রি করা হবে না বলে জানিয়ে দেয় আমেরিকা। ফলে দু’তরফে সম্পর্কের কিছুটা অবনতিও ঘটেছিল।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় সামরিক জোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটোর (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) সদস্যপদ রয়েছে তুরস্কের। এই গোষ্ঠীর সমস্ত দেশকে যাবতীয় হাতিয়ার বিক্রি করে ওয়াশিংটন। সেখানে শর্ত একটাই। অস্ত্রের ব্যাপারে রাশিয়া, চিন, ডেমোক্র্যাটিক পিপল্স রিপাবলিক অফ কোরিয়া বা ডিপিআরকে (পড়ুন উত্তর কোরিয়া) এবং ইরানের মতো যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ‘শত্রু’দের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে তাদের।
আর তাই এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে রুশ-তুরস্ক চুক্তি হতেই এ ব্যাপারে আমেরিকার ‘কানভারী’ করে ইজ়রায়েল। ইরানের মতো আঙ্কারার সঙ্গেও তেল আভিভের সম্পর্ক সাপে-নেউলে। পশ্চিম এশিয়ায় ইহুদি রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব মুছে ফেলতে চায় সাবেক অটোমানেরা। আর তাই সৌদির সঙ্গে প্রস্তাবিত এফ-৩৫ চুক্তি ওই এলাকায় শান্তিপ্রতিষ্ঠায় ওয়াশিংটনের বৃহত্তর কূটনীতির অংশ হতে চলেছে বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ।
ট্রাম্পের পূর্বসূরি জো বাইডেনের সময়েও রিয়াধকে এফ-৩৫ সরবরাহের পরিকল্পনা করে যুক্তরাষ্ট্র। শর্ত ছিল, ইজ়রায়েলকে স্বীকৃতি দেবে ওই উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্র। ২০২৩ সালে এ ব্যাপারে একটি চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছিল মার্কিন সরকার। কিন্তু ওই বছরের ৭ অক্টোবর ইহুদিভূমিতে ভয়ঙ্কর আক্রমণ চালায় ইরান মদতপুষ্ট প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। এর পরই দু’পক্ষের শুরু হয় যুদ্ধ। ফলে ভেস্তে যায় ওয়াশিংটনের যাবতীয় পরিকল্পনা।
বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য মনে করেন, বর্তমানে সৌদিকে এফ-৩৫ বিক্রি করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বেশ কয়েকটি বিকল্প রয়েছে। প্রথমত, সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটির তুলনামূলক ভাবে কম শক্তিসম্পন্ন ভ্যারিয়েন্ট উপসাগরীয় আরব দেশটিকে সরবরাহ করতে পারে আমেরিকা। দ্বিতীয়ত, তাতে ‘কিল সুইচ’ থাকলে নিজেদের ইচ্ছামতো যুদ্ধবিমানগুলিকে সামরিক অভিযানে ব্যবহার করতে পারবে না রিয়াধের বিমানবাহিনী।
‘দ্য জেরুজ়ালেম পোস্ট’ অবশ্য আরও একটি বিকল্পের কথা বলেছে। বর্তমানে ষষ্ঠ প্রজন্মের লড়াকু জেট এফ-৪৭ তৈরিতে হাত দিয়েছে আমেরিকা। এই যুদ্ধবিমান নির্মাণের দায়িত্বভার জনপ্রিয় উড়োজাহাজ নির্মাণকারী সংস্থা বোয়িঙের কাঁধে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। একসঙ্গে একাধিক ড্রোন নিয়ে উড়ে গিয়ে হামলা চালাতে পারবে এফ-৪৭। অত্যাধুনিক ওই জেটটি এখন থেকেই পেতে চাইছে ইহুদিরা। সে ক্ষেত্রে সৌদির কাছে এফ-৩৫ থাকলেও বিপদ এড়াতে পারবে তেল আভিভ।
উপসাগরীয় দেশগুলির মধ্যে সৌদি আরবের বিমানবাহিনীকেই সবচেয়ে শক্তিশালী বলা যেতে পারে। রিয়াধের বায়ুসেনার বহরে আছে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৫ এবং একাধিক ইউরোপীয় দেশের তৈরি ইউরোফাইটার টাইফুন। গত বছরের (পড়ুন ২০২৪ সালের) ডিসেম্বরে তুরস্কের সঙ্গে সামরিক ড্রোনের চুক্তি করে তারা।
এই পরিস্থিতিতে আমেরিকার সঙ্গে প্রস্তাবিত এফ-৩৫ লড়াকু জেটের চুক্তি বাতিল হলে ফের ইউরোপের দ্বারস্থ হতে পারে সৌদি সরকার। ফ্রান্সের থেকে রাফাল বা জার্মানির থেকে ইউরোফাইটার টাইফুন আমদানির বিকল্প রয়েছে রিয়াধের হাতে। ‘দ্য ইউরেশিয়ান টাইম্স’ জানিয়েছে, ইটালির সঙ্গেও একাধিক প্রতিরক্ষা চুক্তির চেষ্টা চালাচ্ছেন যুবরাজ সলমন।
গত সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের সঙ্গে ‘কৌশলগত এবং পারস্পরিক’ প্রতিরক্ষা চুক্তি করে সৌদি সরকার। তার শর্ত অনুযায়ী, কোনও একটি দেশ অন্য কোনও দেশের আগ্রাসনের শিকার হলে তা উভয় দেশের উপরেই আঘাত হিসাবে বিবেচনা করা হবে। বর্তমানে এই সমঝোতায় অন্যান্য ইসলামীয় দেশগুলিকেও টানতে চায় ইসলামাবাদ। এর জেরে ইজ়রায়েলের রক্তচাপ যে বেড়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
এ বছরের ডিসেম্বরে নয়াদিল্লি সফরে আসার কথা রয়েছে ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর। সৌদি-পাক প্রতিরক্ষা চুক্তির তিন মাসের মাথায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন তিনি। তার আগে রিয়াধ এফ-৩৫ লড়াকু জেটের প্রস্তাবিত সমঝোতা চূড়ান্ত করে ফেললে গোটা বিষয়টি অন্য দিকে মোড় নিতে পারে। তখন ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে ইহুদিরা কোন চোখে দেখে, তার উত্তর দেবে সময়।