চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে ভারতের সফল অভিযানের পর থেকে পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহটিকে নিয়ে চর্চার শেষ নেই। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, চায়ের দোকানে, বাসে, ট্রেনে আলোচনার কেন্দ্রে এখন ইসরো এবং ‘চাঁদমামা’।
ভারত চাঁদে মহাকাশযান পাঠিয়েছে। সেই মহাকাশযান চাঁদের মাটিতে পাখির পালকের মতো ভেসে ভেসে অবতরণ করেছে (সফ্ট ল্যান্ডিং)। আগামী ১৪ দিন চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার বিক্রম এবং রোভার প্রজ্ঞানের ঠিকানা চাঁদের দক্ষিণ মেরু।
ইসরোর এই সাফল্যের আবহে ফিরে আসছে ৫০ বছর আগে আমেরিকার চন্দ্র অভিযানের স্মৃতি। অ্যাপোলো ১১ মিশনে চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছিল নাসা। চাঁদের মাটিতে প্রথম পা রেখেছিলেন নীল আর্মস্ট্রং এবং এডুইন অলড্রিন।
কী কী হয়েছিল সেই অভিযানে? চাঁদ থেকে ঘুরে এসে একাধিক সাক্ষাৎকারে বহু কৌতূহল নিরসন করেছেন আমেরিকার মহাকাশচারীরা। তাঁদের কাছে খুঁটিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল চাঁদে কাটানো প্রতি মুহূর্তের বিবরণ।
চাঁদে মোট ২১ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট কাটিয়েছিলেন আমেরিকার দুই মহাকাশচারী। এই সময়ের মধ্যে নানা অসুবিধার মোকাবিলা করতে হয়েছিল তাঁদের। অবশ্য, ইতিহাসে নাম তোলার আনন্দে সেই সমস্যা লঘু হয়ে যায়।
নাসার একটি রিপোর্টে দাবি করা হয়, মহাকাশে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা যে দিন থেকে শুরু হয়েছে, সে দিন থেকেই গবেষকদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মলমূত্র ত্যাগের মতো শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াগুলি। চাঁদে পৌঁছে সেখানেই প্রথম হোঁচট খান আর্মস্ট্রংয়েরা।
যে মহাকাশযানে চাঁদে পাড়ি দিয়েছিলেন আর্মস্ট্রং এবং অলড্রিনেরা, সেখানে কোনও শৌচাগারের বন্দোবস্ত ছিল না। মলমূত্র ত্যাগের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি প্লাস্টিকের ব্যাগ পাঠিয়েছিল নাসা।
মূত্রত্যাগের জন্য কন্ডোমের মতো একপ্রকার নলের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তার মাধ্যমে প্লাস্টিক পর্যন্ত পৌঁছত তরল। তবে শুধুমাত্র পুরুষদের জন্যই এই বিশেষ ব্যবস্থা করেছিল নাসা।
মলত্যাগের জন্য আলাদা প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পরবর্তী কালে যাঁরা চাঁদে গিয়েছেন, তাঁরাও এই পদ্ধতিতেই কাজ করেন। মলভর্তি সেই ব্যাগগুলি চাঁদের মাটিতেই ফেলে এসেছিলেন মহাকাশচারীরা।
চাঁদে সময়ের হিসাব পৃথিবীর সঙ্গে মেলে না। সেখানে সবই ধীর গতির। অ্যাপোলো অভিযানের মহাকাশচারীদের মলমূত্র ত্যাগের সমগ্র প্রক্রিয়াতেই ৪৫ মিনিটের বেশি সময় লেগেছিল বলে জানা যায়।
আর্মস্ট্রং, অলড্রিনরা যখন চাঁদে নেমেছিলেন, তাঁরা ডায়াপার পরে ছিলেন। অলড্রিন পরে নিজেই জানিয়েছেন, তিনি প্যান্টে প্রস্রাব করে ফেলেছিলেন। তবে ডায়াপার পরা ছিল।
চাঁদে গিয়ে আর্মস্ট্রংদের মেনুও ছিল বেশ মজাদার। প্রথমে তারা খেয়েছিলেন কফি এবং বেকন। এ ছাড়া, সব্জি এবং গোমাংস খেয়েছিলেন দুই মহাকাশচারী। মেনুতে ছিল আঙুর, কমলালেবুর রস, স্ট্রবেরি এবং পিচ ফল।
চাঁদে যাওয়ার আগে নাসার অভিযান আমেরিকার মাটিতেই নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিল। সেখানকার মানুষ এই অভিযানের বিরোধিতা করেছিলেন। নাগরিক বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছিল দেশের একাংশ।
অ্যাপোলো অভিযানের বাজেট ছিল ২,৪৫০ কোটি ডলার। আমেরিকার জনগণের একাংশের বক্তব্য ছিল, এই টাকা পৃথিবীর মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের কাজে লাগানো উচিত। চাঁদে মানুষ পাঠিয়ে এত টাকা খরচ করা অর্থহীন।
বিক্ষোভ সত্ত্বেও নাসার অভিযান বাতিল হয়নি। চাঁদে গিয়ে অনেক নমুনা সংগ্রহ করেন আর্মস্ট্রং এবং অলড্রিন। ছবি এবং ভিডিয়ো তোলেন। চাঁদের মাটিতে আমেরিকার জাতীয় পতাকা গেঁথে দিয়ে আসেন।
চাঁদে কাটানো ২১ ঘণ্টা কিন্তু বাইরে হেঁটেচলে কাটাননি নাসার মহাকাশচারীরা। চাঁদের পরিবেশে তাঁরা আড়াই ঘণ্টা ঘোরেন। তার পর লুনার মডিউলে ফিরে যান এবং বেশ কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নেন।
আর্মস্ট্রংদের চন্দ্রযাত্রায় অনেক ঝুঁকি ছিল। কোথাও কোনও সিস্টেমে সামান্যতম ত্রুটিও ডেকে আনতে পারত প্রাণঘাতী বিপদ। চাঁদেই নেমে আসতে পারত মৃত্যু। সে কথা ভেবে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন মৃত্যুপরবর্তী ভাষণও তৈরি করে রেখেছিলেন। ৩০ বছর পর সেই ভাষণ প্রকাশ করা হয়।
পৃথিবীতে ফিরে এসে সঙ্গে সঙ্গে মাটি ছুঁতে পারেননি আর্মস্ট্রংয়েরা। ২১ দিন তাঁদের মহাকাশযানে নিভৃতবাসে রাখা হয়েছিল। চাঁদ থেকে কোনও জীবাণু তাঁরা বহন করছেন কি না, সেই সম্ভাবনার কথা ভেবে নিভৃতবাসের বন্দোবস্ত করেছিল নাসা। সেখানেই আর্মস্ট্রং ৩৯তম জন্মদিন পালন করেন।
১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত চাঁদের মাটিতে আমেরিকার ছ’টি পতাকা পোঁতা হয়েছে। ২০১২ সালের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, অন্তত পাঁচটি পতাকা একই ভাবে দাঁড়িয়েছিল। তবে সূর্যের আলোয় সেগুলির রঙ ফিকে হয়ে গিয়েছে।
চাঁদে প্রথম মানুষ পাঠানোর অর্ধশতাব্দী পরে আমেরিকা আবার উদ্যোগী হয়েছে একই লক্ষ্যে। আর্টেমিস ৩ মিশনে ২০২৫ সালে চাঁদে আবার মহাকাশচারী পাঠানো হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আরও এক ইতিহাসের অপেক্ষায় দিন গুনছে বিশ্ব।