‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতিতে ভর করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ক্ষমতায় এসেই চিন সফরে গিয়েছিলেন। প্রকাশ্যে এসেছিল তাঁর ‘ভারত-বৈরিতা’। মলদ্বীপের বিতর্কিত সেই প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জুই এ বার দ্বীপরাষ্ট্রের ৬০তম স্বাধীনতা দিবসে প্রধান অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে।
দু’দিনের ব্রিটেন সফরের শেষে শুক্রবার মলদ্বীপে যাওয়ার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী মোদীর। বিদেশ মন্ত্রক ইতিমধ্যেই সে কথা নিশ্চিত করেছে। শুক্র এবং শনিবার মলদ্বীপে থাকবেন মোদী। যোগ দেবেন দ্বীপরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সমারোহে ‘গেস্ট অফ অনার’ হিসাবে।
তবে মোদীর মলদ্বীপ সফর এবং স্বাধীনতা দিবসে দ্বীপরাষ্ট্রের প্রধান অতিথি হিসাবে যোগ দেওয়ার বিষয়টিকে তাৎপর্যপূর্ণ হিসাবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞেরা। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, এক সময় ভারতকে হেয় করা মুইজ্জু ভুল বুঝতে পেরেছেন। দেশের অর্থনৈতিক শিরদাঁড়া ভগ্নপ্রায় হওয়ায় ভারতের কাছে ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছেন সে দেশের প্রেসিডেন্ট।
ভারতের বিদেশ মন্ত্রক একটি বিবৃতিতে বলেছে, “২৬ জুলাই মলদ্বীপের ৬০তম স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনে মোদী ‘গেস্ট অফ অনার’ হবেন। দুই রাষ্ট্রনেতা পারস্পরিক সহযোগিতা, ভারত-মলদ্বীপ যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন।”
শুক্র এবং শনিবার মলদ্বীপ সফরে গেলে সেটি হবে ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমে থাকা প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রী মোদীর তৃতীয় সফর। তবে মুইজ্জু রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্বগ্রহণের পর এই প্রথম মলদ্বীপ যাচ্ছেন মোদী।
বিদেশ মন্ত্রকের বিবৃতি প্রকাশের পর বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, ‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতি নিয়ে মুইজ্জু ক্ষমতায় আসার পর ভারত এবং মলদ্বীপের যে কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল, তা পুরনো অবস্থায় ফেরানোর কাজ শুরু হল মোদীর সফরের পর।
ভারত এবং মলদ্বীপের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির সূত্রপাত মুইজ্জু ক্ষমতায় আসার পর। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে মলদ্বীপে ক্ষমতায় এসেছিলেন মুইজ্জু। চিনপন্থী হিসাবে পরিচিত ছিলেন তিনি। মলদ্বীপে নির্বাচনের আগে ভারতের বিরুদ্ধে ঢালাও প্রচারও করেছিলেন।
ক্ষমতায় আসার পর মলদ্বীপের রাষ্ট্রনেতারা সাধারণত প্রথম বিদেশ সফর হিসাবে ভারতকে বেছে নেন। কিন্তু মুইজ্জু তা করেননি। চিন সফরে গিয়েছিলেন তিনি। চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি করেন। পরিকাঠামো এবং পরিবেশ সংক্রান্ত একাধিক চুক্তিও স্বাক্ষর করেন। বেজিঙের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ হিসাবে পেয়েছিল মলদ্বীপ।
বিষয়টি নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। মলদ্বীপের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেরও অবনতি হতে শুরু করে। এর মধ্যেই মুইজ্জুর মন্ত্রিসভার তিন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী মোদীর লক্ষদ্বীপ সফরের ছবি নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্যের অভিযোগ ওঠে।
সঙ্গে সঙ্গে ঝড় বয়ে যায় ভারত জুড়ে। ভারতে ‘মলদ্বীপ বয়কট’-এর ডাক ওঠে। মলদ্বীপের শয়ে শয়ে টিকিট বাতিল করে দেন ভারতের পর্যটকেরা। ধাক্কা খায় পর্যটননির্ভর দেশ মলদ্বীপ।
ভারত থেকে প্রতি বছর বহু মানুষ সেখানে ঘুরতে যান, যার উপর দেশটির অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভর করে। ভারতে ‘বয়কট মলদ্বীপ’ রব উঠলে ক্ষতির মুখে পড়ে মলদ্বীপের অর্থনীতি। যেখানে ২০২৩ সালে মলদ্বীপে ঘুরতে যাওয়া ভারতীয়ের সংখ্যা দু’লাখের কাছাকাছি ছিল, ২০২৪ সালে তা কমে হয়ে যায় মাত্র ৪০ হাজার।
তবে তাতেও দমেননি মুইজ্জু। এত কাণ্ডের মাঝেই মলদ্বীপ থেকে ভারতকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। এই নিয়ে পর পর ঘটনাক্রমে দুই দেশের সম্পর্কে তিক্ততা বাড়ছিল।
এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক স্তরে মলদ্বীপের উপর পাহাড়প্রমাণ ঋণের বোঝা চাপে। চিনের সঙ্গে মলদ্বীপের দহরম-মহরম শুরুর পর সে দিকে নজর পড়েছিল সারা বিশ্বের। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (আইএমএফ) সাবধান করে, চিনের ঋণের জালে জড়িয়ে পড়তে পারে মলদ্বীপ। কারণ চিনের থেকে দু’হাতে ঋণ নিলেও তা ফেরত দেওয়ার ক্ষমতা নেই মলদ্বীপের।
এর পরে বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও মলদ্বীপকে নতুন করে সাহায্যদানে খুব বেশি উৎসাহ দেখায়নি বেজিং। সৌদি আরব এবং অন্যান্য পশ্চিম এশীয় দেশও মুখ ফিরিয়েছিল মলদ্বীপের থেকে।
অন্য দিকে, ২০২২-’২৩ এবং ২০২৩-’২৪-এর বাজেটে মলদ্বীপের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছিল ভারত। ২০২৩-’২৪ সালে মলদ্বীপের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৭৭০ কোটি টাকা। তবে ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষের বাজেটে দেখা যায় বরাদ্দ কমিয়ে ৪০০ কোটি করা হয়।
সব দিক থেকে সাঁড়াশি চাপে মলদ্বীপের অর্থনীতির কোমর আরও নুইয়ে পড়ে। এতেই নাকি টনক নড়ে মুইজ্জু সরকারের। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে হঠাৎই ভারত নিয়ে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়িয়ে সম্পর্কের উন্নতির জন্য চেষ্টা চালাতে শুরু করে মলদ্বীপ।
গত বছরের জুন মাসে মুইজ্জু প্রথম বার ভারতে আসেন। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদীর তৃতীয় বারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাঁকে। এর পর আবার অক্টোবরে সস্ত্রীক ভারতে আসেন তিনি। দু’দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও হয়।
এর পরেই মুইজ্জু ভারতের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হন। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের দেওয়া অর্থসাহায্য পেয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে ঋণখেলাপি হওয়া এড়াতে সক্ষম হন মুইজ্জু। মলদ্বীপকে সে সময় ৭৫.৭ কোটি ডলারের সহায়তা প্রদান করেছিল ভারত।
উত্তর মলদ্বীপে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, দক্ষিণ মলদ্বীপে একটি সেতু ও সড়ক প্রকল্প, রাজধানী মালেতে একটি বৃহৎ আবাসন উন্নয়ন প্রকল্প এবং মালেকে তার পশ্চিম শহরতলির দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে সংযুক্ত করতে নতুন সেতু নির্মাণেও সাহায্য করে ভারত।
কিন্তু কেন হঠাৎ করে ভারতের প্রতি সুর নরম করলেন মুইজ্জু? মনে করা হচ্ছে চিন এবং উপসাগরীয় দেশগুলির সঙ্গে বিকল্প অংশীদারির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কারণেই আবার ভারতের মুখাপেক্ষী মলদ্বীপ।
প্রত্যাশিত ভাবেই, মলদ্বীপের সঙ্কটে প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য দিয়ে ত্রাণদাতার ভূমিকা পালন করেছিল ভারত। আপাতত মালে-র সঙ্গে সমীকরণ কিছুটা ঠিকঠাক হলেও দিল্লি ভোলেনি যে মালে ও বেজিঙের সম্পর্ক এখনও ঘনিষ্ঠ।
ভারত মহাসাগরে তার ভূ-কৌশলগত অবস্থানের জেরে ও এই অঞ্চলে ভারতের উপরে চাপ বজায় রাখতে মলদ্বীপকে কোনও দিনই হাতছাড়া করতে চাইবে না বেজিং। অন্য দিকে, ভারত মহাসাগরে চিনা আধিপত্য একেবারেই চায় না ভারত। এ ছাড়াও বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কায় সাম্প্রতিক সরকার বদলের জেরে ভারত অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাইছে। তাই মলদ্বীপকে হাতে রাখতে মরিয়া নয়াদিল্লিও।
এর মধ্যেই স্বাধীনতা দিবসে প্রধান অতিথি হিসাবে মোদীকে আমন্ত্রণ জানান মুইজ্জু। মোদী প্রথম রাষ্ট্রনেতা যাঁকে মলদ্বীপের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনে সম্মানিত অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুইজ্জু।
মঙ্গলবার এ প্রসঙ্গে ভারতের বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী বলেন, ‘‘এমন কিছু ঘটনা সর্বদা ঘটবে যা দু’দেশের সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলবে। এর থেকেই বোঝা যায়, কোন সম্পর্কের প্রতি কী রকম মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমি মনে করি ফলাফল সবাই দেখতে পাবেন।’’
মিস্রী আরও মন্তব্য করেন, ভারতের প্রতিবেশী নীতি ‘মহাসাগর’-এর জন্য মলদ্বীপ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তাঁর কথায়, ‘‘মলদ্বীপ যখনই সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে, তখন আমরাই তাদের চাহিদা পূরণে সর্বদা প্রথম ছিলাম। উচ্চ পর্যায়ে নিয়মিত সফরের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।”
বিদেশ মন্ত্রকের এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, মোদীর মলদ্বীপ সফরের পর দুই দেশের সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ বদল আসতে পারে। বর্তমানে দ্বীপরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার ভারত। উভয় পক্ষই একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং একটি বিনিয়োগ চুক্তির জন্য আলোচনা করছে। মনে করা হচ্ছে মোদীর মলদ্বীপ সফরে সেই বাণিজ্যচুক্তিরই পাকা কথা হতে পারে। সিলমোহর পড়তে পারে বিষয়টিতে।