কোল্ডপ্লে কনসার্টের মোহময়ী রাতের জাদু যে দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি যুগল। বাড়িতে লুকিয়ে প্রেমিকার সঙ্গে কাটানো অন্তরঙ্গ মুহূর্ত এ ভাবে হাটের মাঝে এসে পড়বে তা কল্পনাতেও স্থান দিতে পারেননি প্রেমিক-প্রেমিকা। মার্কিন মুলুকের বস্টনের ম্যাসাচুসেট্সের জিলেট স্টেডিয়ামে বসেছিল ব্রিটিশ রক ব্যান্ড ‘কোল্ডপ্লে’র কনসার্ট। কানায় কানায় ভর্তি ছিল দর্শকাসন।
সেখানেই প্রেমিকাকে বাহুডোরে জড়িয়ে সেই সঙ্গীতের আসর তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিলেন নামী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার অ্যাস্ট্রোনমারের সিইও অ্যান্ডি বাইরন। আচমকাই ক্যামেরায় ধরা প়ড়ে যান বাইরন ও তাঁর প্রেমিকা ক্রিস্টিন ক্যাবট। ওই সংস্থারই এক উচ্চপদস্থ কর্মী ক্রিস্টিন। কোল্ডপ্লের কনসার্ট চলাকালীন প্রেমিকাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন অ্যান্ডি। প্রেমিকের বুকে মাথা দিয়ে গানের তালে মেতে উঠছিলেন ক্রিস্টিন।
দর্শকাসনের উপর দিয়ে ঘুরে বেড়ানো ক্যামেরা আচমকাই স্থির হয়ে যায় অ্যান্ডি এবং ক্রিস্টিনের দিকে। জায়ান্ট স্ক্রিনে ধরা পড়া সেই অন্তরঙ্গ মুহূর্তের সাক্ষী থাকেন স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শক, এমনকি শিল্পীরাও। নিজেদের মধ্যে এতটাই ডুবে ছিলেন যুগল যে কিছু বুঝে ওঠার সময় পাননি তাঁরা।
পর্দায় তাঁদের দেখানোমাত্র একে অপরের বাহুডোর থেকে ছিটকে বেরিয়ে যান তাঁরা। নিজেকে আড়াল করতে বসে পড়েন অধিকর্তা। তাঁর প্রেমিকাও হাত দিয়ে মুখ ঢেকে অন্য দিকে ঘুরে যান। সমাজমাধ্যমে সেই ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়তেই ঝড়ের গতিতে তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব জুড়ে। মঞ্চ থেকে যুগলের এই কাণ্ড দেখে ব্যান্ডের গায়ক ক্রিস মার্টিনও বলে ওঠেন, ‘‘হয় তাঁরা খুব লজ্জা পাচ্ছেন, নয়তো তাঁদের পরকীয়া সম্পর্ক রয়েছে।’’
সহকর্মীর সঙ্গে এ-হেন ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিয়োটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তেই অ্যান্ডির ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবন নিয়ে কৌতূহল ছড়িয়ে পড়ে সংবাদমাধ্যম ও সমাজমাধ্যম জুড়ে। তাঁর বান্ধবীকে নিয়েও চর্চা শুরু হয় বিভিন্ন মহলে। আর বিতর্কের মুখে সংস্থা থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন অ্যান্ডি।
২০২৩ সালে সিইও হিসাবে অ্যাস্ট্রোনমারে যোগ দেন অ্যান্ডি। নিউ ইয়র্কস্থিত একটি খ্যাতনামী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা অ্যাস্ট্রোনমার। সফ্টঅয়্যার ডেভেলপমেন্ট সংস্থাটির বর্তমান সম্পদের পরিমাণ ১৩০ কোটি ডলার। অ্যান্ডির লিঙ্কডইন প্রোফাইল বলছে দু’বছর ধরে এই সংস্থার পরিচালনার দায়িত্ব সামলেছেন তিনি।
অ্যাস্ট্রোনমারে যোগ দেওয়ার আগে ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সাইবারিজনের চিফ রেভিনিউ অফিসারের পদে ছিলেন অ্যান্ডি। তাঁর দক্ষতার উপর নির্ভর করেই সংস্থার মোট সম্পদের পরিমাণ ৫০ লক্ষ ডলার থেকে ৭ কোটি ডলারে পৌঁছে যায়। ২০১৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত তিনি লেসওয়ার্কের প্রেসিডেন্ট হিসাবে যোগ দেন। পরে অবশ্য ওই সংস্থাতেই উপদেষ্টার ভূমিকায় দেখা যায় অ্যান্ডিকে।
অ্যাস্ট্রোনমারে যোগ দেওয়ার পর থেকে সংস্থার আর্থিক অবস্থার ভোল পাল্টে দেন অ্যান্ডি। দু’বছরের মধ্যে এক লাফে ২০৬ শতাংশ লাভের মুখ দেখে অ্যাস্ট্রোনমার। ৯.৩ কোটি ডলারের তহবিল তৈরি হয় সংস্থার। সংস্থার কার্যালয় নিউ ইয়র্কে স্থানান্তরিত করার নেপথ্যেও অ্যান্ডির বিশেষ ভূমিকা ছিল বলে জানা যায়। তিনি প্রায়শই লিঙ্কডইনে অ্যাস্ট্রোনমারের অনুষ্ঠান, পণ্যের বৈশিষ্ট্য এবং প্রযুক্তিশিল্পের উন্নয়ন সম্পর্কে নানা তথ্য শেয়ার করতেন।
সিইও হিসাবে সংস্থার ইকুইটির ১ থেকে ৫ শতাংশ লভ্যাংশের মালিক অ্যান্ডি। সেই হিসাব ধরলে তার শেয়ারের মূল্য ১.২ কোটি ডলার থেকে ৬.৫ কোটি ডলার হতে পারে। তাঁর পূর্ববর্তী সংস্থার বেতন, ইকুইটি ও অন্যান্য আয় ধরে অ্যান্ডির মোট সম্পত্তির হিসাব করার চেষ্টা করেছেন অনেকেই। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, অ্যাস্ট্রোনমারের প্রাক্তন সিইও অ্যান্ডির মোট সম্পত্তির পরিমাণ ২ কোটি ডলার থেকে ৭ কোটি ডলারের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে পারে।
১৯৭৫ সালে ম্যাসাচুসেট্সে জন্ম অ্যান্ডির। রোড আইল্যান্ডের প্রভিডেন্স কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। স্নাতক স্তরে পড়ার সময়ই তিনি প্রযুক্তি এবং এই সংক্রান্ত ব্যবসায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অ্যান্ডির প্রাথমিক কর্মজীবনে তিনি ভেরি সেন্টার, বিএমসি সফ্টঅয়্যার এবং ব্লেডলজিকের মতো সংস্থাগুলিতে কাজ করেছিলেন। সেই কাজের অভিজ্ঞতাই তাঁকে পরবর্তী কালে নামীদামি সংস্থার উচ্চপদে বহাল হওয়ার ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা দিয়েছিল।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে, অ্যান্ডি তাঁর স্ত্রী মেগান কেরিগান বাইরন এবং দুই সন্তানকে নিয়ে নিউ ইয়র্কে থাকেন। স্ত্রী মেগান পেশায় স্কুলশিক্ষিকা। ১০ লক্ষ ডলার দিয়ে ম্যাসাচুসেট্সেও একটি বাড়ি কিনেছেন অ্যান্ডি।
কোল্ডপ্লে কনসার্টের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর ১৮ জুলাই একটি বিবৃতি জারি করে স্ত্রী, পরিবার এবং সংস্থার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন ৫০ বছরের সিইও। নেটপাড়ার একাংশের দাবি, সমাজমাধ্যম থেকে ইতিমধ্যেই স্বামীর পদবি সরিয়ে ফেলেছেন মেগান। তবে এই ভিডিয়ো নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি অ্যান্ডি এবং ক্রিস্টিন। বিবাহবিচ্ছেদ নিয়েও প্রকাশ্যে কিছু ঘোষণা করেননি সংস্থার অধিকর্তা এবং তাঁর স্ত্রী।
অ্যান্ডির সঙ্গে যাঁকে ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে সেই ক্রিস্টিনও একই সংস্থার মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান। ক্রিস্টিন ক্যাবট ২০২৪ সালের নভেম্বরে অ্যাস্ট্রোনমারে ‘চিফ পিপ্ল অফিসার’ হিসাবে যোগ দেন। তাঁর আগে তিনি একাধিক সংস্থার মানবসম্পদ বিভাগের কর্মরত ছিলেন বলে খবর।
ক্রিস্টিনের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, তিনি কেনেথ সি. থর্নবি নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। এই দম্পতি ২০১৮ সালে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেছিলেন এবং ২০২২ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।
স্ত্রীকে ঠকিয়ে অফিসে পরকীয়া করছেন বলে অনেকেই অ্যান্ডিকে কটাক্ষ করেছেন। এই অবস্থায় অ্যাস্ট্রোনমার একটি বিবৃতি জারি করে। সংস্থা জানিয়েছে, তারা নিজস্ব মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতি বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বিতর্ক শুরু হতেই প্রধান নির্বাহী কর্তা (সিইও) অ্যান্ডিকে ছুটিতে পাঠানো হয় এবং সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান পণ্য কর্মকর্তা পিট ডিজয়কে অন্তর্বর্তিকালীন সিইও হিসাবে নিযুক্ত করে সংস্থাটি। সংস্থার পরিচালনা বিভাগ এই বিষয়ে একটি আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করে এবং খুব শীঘ্রই তাঁদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে বলে বিবৃতিতে জানায় অ্যাস্ট্রোনমার। আর এর পরেই সংস্থা থেকে অ্যান্ডির ইস্তফার বিষয়টি প্রকাশ্যে এল।