২০২২ সালে জুলাই মাসে ম্যানহাটনের বাড়িতে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মৃত্যু হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম স্ত্রী ও তাঁর প্রথম তিন সন্তানের মা ইভানা মারি ট্রাম্পের। ৭৩ বছর বয়সে সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা যান ইভানা। পেশায় প্রাক্তন মডেল ইভানা ছিলেন চেক-মার্কিন নাগরিক।
সাবেক চেকোস্লোভাকিয়ায় ১৯৪৯ সালে জন্ম ইভানার। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইভানার বিয়ে হয় ১৯৭৭ সালে। দীর্ঘ দেড় দশক পর ভেঙে যায় তাঁদের দাম্পত্য। ১৯৯২ সালে দাম্পত্যে ছেদ পড়ে তাঁদের, ইভানাকে ডিভোর্স দেন ট্রাম্প। তার পরে রিয়্যালিটি শো সঞ্চালনা, বই লেখার মতো নানা কাজ করেছেন ডোনাল্ডের প্রথম স্ত্রী ইভানা।
মারা যাওয়ার পর ইভানাকে কোনও সরকারি বা বেসরকারি সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত করা হয়নি। বরং নিউ জার্সিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেডমিনস্টার গল্ফ কোর্সে সমাহিত করা হয়েছিল ইভানার দেহ। আড়ম্বরহীন ভাবে পড়ে রয়েছে ইভানার সমাধি। তাতে বাঁধানো হয়নি কোনও বেদি। চারপাশে নেই কোনও বেড়া। একটি ধূসর রঙের ফলকে তাঁর নাম, জন্ম ও মৃত্যুর দিনক্ষণ লেখা। আলগা মাটির উপরে রাখা থাকে এক গোছা সাদা ফুল।
কবরস্থানে সমাধি না দিয়ে গল্ফ কোর্সে সমাধির ঘটনাটি সাদা চোখে দেখলে অস্বাভাবিক না ঠেকতেও পারে। এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে ব্যক্তিগত পছন্দের কারণ থাকা খুবই স্বাভাবিক। তবে অতীতেও বিষয়টি নিয়ে কাটাছেঁড়া করেছিল মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলি। সম্প্রতি নতুন করে ইভানার সমাধিস্থলের স্থান নির্বাচনের বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ব্যবসায়িক অভিসন্ধি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সমাজমাধ্যমে।
আমেরিকার সর্বময় কর্তা কেন তার প্রাক্তন স্ত্রীকে গল্ফ কোর্সে সমাহিত করেছিলেন? এটি কি সত্যিই প্রাক্তন স্ত্রীর প্রতি শোকের বহিঃপ্রকাশ, না কি এখানেও ট্রাম্পের কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে?
নিউ জার্সি রাজ্যের কর আইন অনুসারে, সমাধিস্থলের জন্য ব্যবহৃত যে কোনও জমি রিয়্যাল এস্টেট কর-সহ সমস্ত করের আওতা থেকে বাদ। এই করছাড়ের বিষয়টিই তুলে ধরেছেন ট্রাম্পবিরোধীরা। নিন্দকদের দাবি, স্ত্রীর সমাধি নিয়ে ব্যবসা করছেন আপাদমস্তক ব্যবসায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
সেখানকার সমস্ত সমাধিক্ষেত্রে পরিচালন সংস্থা তাদের জমির উপর রিয়্যাল এস্টেট কর, ব্যক্তিগত সম্পত্তি কর, ব্যবসায়িক কর, বিক্রয় কর, আয়কর এবং উত্তরাধিকার কর দেওয়া থেকে অব্যাহতি পেয়ে থাকেন। এই আইনের সুবিধা ভোগ করে কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় করে আসছে সংস্থাগুলি।
পারিবারিক সিদ্ধান্তের নাম করে ট্রাম্প তাঁর গল্ফ কোর্সটিকে কবরস্থানে রূপান্তরিত করে ফেলেছেন বলে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সম্প্রতি একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্টে একটি থ্রেড শেয়ার করা হয়েছে। সেটির শিরোনাম ছিল, ‘‘কেন ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রাক্তন স্ত্রীকে গল্ফ কোর্সে সমাহিত করেছিলেন? এটি শোক ছিল না। বরং এটি একটি আদ্যোপান্ত বাণিজ্যিক কৌশল।’’
পোস্টটিতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে যে গল্ফ কোর্সকে প্রয়াত পত্নীর শেষ বিশ্রামস্থল হিসাবে বেছে নেওয়ার পিছনে গোপন উদ্দেশ্য রয়েছে। এমন উদ্দেশ্য যা ট্রাম্প পরিবারের কর্তাকে আর্থিক সুবিধা দিতে পারে। কবর থাকার কারণে ট্রাম্প জমিটিকে একটি অলাভজনক কবরস্থান সংস্থা হিসেবে নিবন্ধন করতেই পারেন, যাতে পুরো গল্ফ কোর্সটি করমুক্ত হয়ে যায়।
ট্রাম্প নিজেও গল্ফ ক্লাবে নিজের সমাধিক্ষেত্র তৈরি করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। ২০০৭ সালে নিউ ইয়র্ক পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে, তিনি বেডমিনস্টারের শান্তভূমিতে সমাহিত হতে চান।
ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের একটি মামলায় ট্রাম্পের সংস্থা জানিয়েছিল, অধুনা মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁর শেষ বিশ্রামের স্থান হিসাবে নিউ জার্সির গল্ফ ক্লাবকে বেছে নিয়েছিলেন। কারণ এটি তাঁর প্রিয় সম্পত্তিগুলির মধ্যে একটি।
সেই মামলায় ট্রাম্প গল্ফ ক্লাবে ১০ প্লটের একটি ব্যক্তিগত পারিবারিক সমাধিসৌধ নির্মাণের অনুমোদন চেয়েছিলেন। ট্রাম্পের ব্যবসায়িক পরিকল্পনার একটি অংশ ছিল ছোট অথচ বিলাসবহুল পারিবারিক সমাধি তৈরি করা। অন্যটি ছিল এক হাজার সমাধিক্ষেত্রের প্লট নির্মাণ। সেই খণ্ড খণ্ড জমি গল্ফ ক্লাবের সদস্যদের কাছে বিক্রি করে ব্যবসায়িক মুনাফা পকেটস্থ করার পরিকল্পনা ফেঁদেছেন ট্রাম্প।
হাফিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গল্ফ কোর্সটিকে কবরস্থান হিসাবে নিবন্ধন করলে সেটি করমুক্ত হবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৯ সালে নিউ জার্সির ক্লাবটিকে খামার হিসাবে নিবন্ধন করে তার কর কমানোর একটি উপায় খুঁজে বার করেছিলেন।
ট্রাম্প সেই গল্ফ রিসর্টে বেশ কয়েকটি ছাগল রেখে দিয়েছেন ও খড়ের ছাউনি তৈরি করেছেন। এর ফলে তার করের বোঝা বছরে প্রায় ৮৮ হাজার ডলার কমেছে। ২০১৯ সালে গল্ফ কোর্সের প্রতি একর জমির জন্য ৪৬২ ডলারের পরিবর্তে মাত্র ৬ ডলার কর দিতে হয়েছে তাঁর সংস্থাকে।
সমাজমাধ্যমের সেই বিতর্কিত পোস্টে দাবি করা হয়েছে, ২০১৭ সালে ট্রাম্প পরিবার নিউ জার্সির হ্যাকেটসটাউনের একটি সম্পত্তিকে একটি অলাভজনক সমাধি দেওয়ার সংস্থা হিসাবে মনোনীত করার চেষ্টা করেছিল। এই স্থানটি ছিল গল্ফ কোর্স থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূরে।
অতীতে ইভানা ট্রাম্পের সমাধি ঘিরে যখন বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছিল তখন ট্রাম্পের সংস্থা বিবৃতি দিয়ে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছিল। একটি মেলে তারা জানিয়েছিল, ইভানা ট্রাম্পের সমাধিস্থল এবং কর আইনের মধ্যে যে যোগসূত্র তৈরি হচ্ছে তা অত্যন্ত হীন ষড়যন্ত্র।
মার্লা মেপলসের (যিনি পরে ট্রাম্পের দ্বিতীয় স্ত্রী হন) সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তেই ১৯৯২ সালে ইভানার সঙ্গে সম্পর্কে ইতি টানেন ট্রাম্প। দাম্পত্যের টালমাটাল সময়ে ইভানা দাবি করেছিলেন, বিচ্ছেদের সময়ে নিষ্ঠুর আচরণ করতেন ট্রাম্প। ওঁর কাছে বিচ্ছেদটাও যেন একটা ব্যবসায়িক চুক্তি, যেটাও ওঁকে জিততেই হবে। পরে অবশ্য তিক্ততা কেটে গিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়।