India-Maldives Relationship

‘ইন্ডিয়া আউট’ থেকে ‘বন্দে মাতরম’! ড্রাগনের পা ছেড়ে কেন ভারতের হাত ধরল মলদ্বীপ? কোন অঙ্কে ‘ইউ-টার্ন’ মুইজ্জুর?

কেন হঠাৎ করে ভারতকে নিয়ে কট্টর মনোভাব বদলে ফেললেন মুইজ্জু? কেন ‘ভারত বৈরিতা’ থেকে সরে এসে ‘ভারতমুখী’ হলেন? মনে করা হচ্ছে চিন এবং উপসাগরীয় দেশগুলির সঙ্গে বিকল্প অংশীদারির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কারণেই আবার ভারতের মুখাপেক্ষী হয়েছে মলদ্বীপ।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২৫ ১৩:৩৮
Share:
০১ ২৫

‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতি থেকে গলায় ‘বন্দে মাতরম’-এর সুর। দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে লাল গালিচাও বিছোলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জন্য। কিন্তু কী এমন হল মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জুর? ভারতকে নিয়ে নিজের অবস্থান থেকে কী ভাবে এমন ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেলেন তিনি?

০২ ২৫

‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতিতে ভর করে ২০২৩ সালের নভেম্বরে মলদ্বীপে ক্ষমতায় আসেন মুইজ্জু। ক্ষমতায় এসেই চিন সফরে গিয়েছিলেন তিনি। প্রকাশ্যে এসেছিল তাঁর ‘ভারত বৈরিতা’ও।

Advertisement
০৩ ২৫

মলদ্বীপের বিতর্কিত সেই প্রেসিডেন্টই সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী মোদীকে সে দেশের ৬০তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ‘গেস্ট অফ অনার’ করে নিয়ে গিয়েছিলেন। মোদীর সম্মানে একাধিক ব্যবস্থা করেন তিনি। লাল গালিচার ব্যবস্থা করেন। ‘বন্দে মাতরম’ও গাওয়া হয় মোদীর উপস্থিতিতে।

০৪ ২৫

ভারতের প্রতি মুইজ্জুর এই অমায়িক ব্যবহার দেখেছে সারা বিশ্ব। এই নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে আলোচনাও চলছে আন্তর্জাতিক মহলে। তবে মুইজ্জু সরকার হঠাৎ করে ভারতের বিষয়ে সুর নরম করলেও দু’বছর আগে পর্যন্ত পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। মুইজ্জু সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারত এবং মলদ্বীপ— দু’দেশের কূটনৈতির সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল।

০৫ ২৫

কিন্তু কেন হঠাৎ করে ভারতকে নিয়ে কট্টর মনোভাব বদলে ফেললেন মুইজ্জু? কেন ‘ভারত বৈরিতা’ থেকে সরে এসে ‘ভারতমুখী’ হলেন? মনে করা হচ্ছে চিন এবং উপসাগরীয় দেশগুলির সঙ্গে বিকল্প অংশীদারির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কারণেই আবার ভারতের মুখাপেক্ষী মলদ্বীপ।

০৬ ২৫

ভারত এবং মলদ্বীপের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির সূত্রপাত মুইজ্জু ক্ষমতায় আসার পর। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে ‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতির উপর ভর করে ক্ষমতায় এসেছিলেন চিনপন্থী হিসাবে পরিচিত মুইজ্জু। মলদ্বীপে নির্বাচনের আগে ভারতের বিরুদ্ধে ঢালাও প্রচারও করেছিলেন।

০৭ ২৫

ক্ষমতায় আসার পর মলদ্বীপের রাষ্ট্রনেতারা সাধারণত প্রথম বিদেশ সফর হিসাবে ভারতকে বেছে নেন। কিন্তু মুইজ্জু তা করেননি। তিনি গিয়েছিলেন চিন সফরে। চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি করেন। পরিকাঠামো এবং পরিবেশ সংক্রান্ত একাধিক চুক্তিও স্বাক্ষর করেন। ড্রাগনের থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ পেয়েছিল মলদ্বীপ।

০৮ ২৫

বিষয়টি নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। মলদ্বীপের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেরও অবনতি হতে শুরু করে। এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী মোদীর লক্ষদ্বীপ সফরের ছবি নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্যের অভিযোগ ওঠে মুইজ্জুর মন্ত্রিসভার তিন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। অভিযোগ উঠেছিল, ভারতীয়দের অপমান করারও। ঘটনার পর বরখাস্ত করা হয় ওই তিন জনকে।

০৯ ২৫

মলদ্বীপের প্রাক্তন ওই মন্ত্রীদের মন্তব্যে বিতর্ক দানা বেঁধেছিল। ঝড় বয়ে যায় ভারত জুড়ে। ভারতে ‘মলদ্বীপ বয়কট’-এর ডাক ওঠে। মলদ্বীপের শয়ে শয়ে টিকিট বাতিল করে দেন ভারতের পর্যটকেরা। ভারতের নামী তারকারাও মলদ্বীপ না গিয়ে লক্ষদ্বীপে ঘুরতে যাওয়ার পক্ষে আওয়াজ তোলেন। এর পরেই ধাক্কা খায় পর্যটননির্ভর দ্বীপরাষ্ট্র মলদ্বীপ।

১০ ২৫

মলদ্বীপের অর্থনীতি পর্যটননির্ভর। সে দেশের বার্ষিক আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ আসে পর্যটন থেকে। ভারত থেকে প্রতি বছর বহু মানুষ সেখানে ঘুরতে যান। কিন্তু ভারতে ‘বয়কট মলদ্বীপ’ রব উঠলে ক্ষতির মুখে পড়ে মলদ্বীপের অর্থনীতি। যেখানে ২০২৩ সালে মলদ্বীপে ঘুরতে যাওয়া ভারতীয়ের সংখ্যা দু’লাখের কাছাকাছি ছিল, ২০২৪ সালে তা কমে হয়ে যায় মাত্র ৪০ হাজার।

১১ ২৫

তবে তাতেও দমেননি মুইজ্জু। এত কাণ্ডের মাঝেই মলদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা সরানো নিয়ে উঠেপড়ে লাগেন তিনি। এর পরে নয়াদিল্লি-মালে টানাপড়েন নতুন মাত্রা পেয়েছিল। এই নিয়ে পর পর ঘটনাক্রমে দুই দেশের সম্পর্কে তিক্ততা বাড়ছিল।

১২ ২৫

মলদ্বীপের বাড়বাড়ন্তে রাশ টানতে উদ্যোগী হয় নয়াদিল্লিও। প্রতিবেশী দেশগুলিকে সাহায্য করার জন্য বাজেটে নির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখে ভারত। ২০২২-’২৩ এবং ২০২৩-’২৪-এর বাজেটে মলদ্বীপের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছিল ভারত। ২০২৩-’২৪ সালে মলদ্বীপের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৭৭০ কোটি টাকা। তবে ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষের বাজেটে দেখা যায় বরাদ্দ কমিয়ে ৪০০ কোটি করা হয়েছে।

১৩ ২৫

এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক স্তরে মলদ্বীপের উপর পাহাড়প্রমাণ ঋণের বোঝা চাপে। চিনের সঙ্গে মলদ্বীপের দহরম-মহরম শুরুর পর সে দিকে নজর পড়েছিল সারা বিশ্বের। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (আইএমএফ) সাবধান করে, চিনের ঋণের জালে জড়িয়ে পড়তে পারে মলদ্বীপ। কারণ চিনের থেকে দু’হাতে ঋণ নিলেও তা ফেরত দেওয়ার ক্ষমতা নেই মলদ্বীপের।

১৪ ২৫

অন্য দিকে, গত দু’বছরে মলদ্বীপের আর্থিক পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে গিয়েছে। বেজিংয়ের তরফে প্রত্যাশিত সহায়তা না পাওয়ারও অভিযোগ উঠেছে ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রের অন্দরে। বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও নাকি মলদ্বীপকে নতুন করে সাহায্যদানে খুব বেশি উৎসাহ দেখায়নি বেজিং। সৌদি আরব এবং অন্যান্য পশ্চিম এশীয় দেশও মুখ ফিরিয়েছিল মলদ্বীপের থেকে। এর পর সে দেশের অন্দরেও প্রশ্ন উঠতে শুরু করে ‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতির কার্যকারিতা নিয়ে।

১৫ ২৫

সব দিক থেকে সাঁড়াশি চাপে মলদ্বীপের অর্থনীতির কোমর আরও নুইয়ে পড়ে। এর পরেই নাকি টনক নড়ে মুইজ্জু সরকারের। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে হঠাৎই ভারত নিয়ে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতির জন্য চেষ্টা চালাতে শুরু করে মলদ্বীপ। ভারতের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হন মুইজ্জু।

১৬ ২৫

গত বছরের জুন মাসে মুইজ্জু প্রথম ভারতে আসেন। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদীর তৃতীয় বারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাঁকে। এর পর আবার অক্টোবরে সস্ত্রীক ভারতে আসেন তিনি। দু’দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও হয়। মাঝে সে দেশের এক মন্ত্রী এসেও দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতির চেষ্টা করে মলদ্বীপের পর্যটনকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করেন।

১৭ ২৫

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের দেওয়া অর্থসাহায্য পেয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে ঋণখেলাপি হওয়া এড়াতে সক্ষম হন মুইজ্জু। মলদ্বীপকে সে সময় ৭৫.৭ কোটি ডলারের সহায়তা প্রদান করেছিল ভারত। উত্তর মলদ্বীপে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, দক্ষিণ মলদ্বীপে একটি সেতু ও সড়ক প্রকল্প, রাজধানী মালেতে একটি বৃহৎ আবাসন উন্নয়ন প্রকল্প এবং মালেকে তার পশ্চিম শহরতলির দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে সংযুক্ত করতে নতুন সেতু নির্মাণেও সাহায্য করে মোদী সরকার।

১৮ ২৫

প্রত্যাশিত ভাবেই মলদ্বীপের সঙ্কটে প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য দিয়ে ত্রাতার ভূমিকা পালন করেছিল ভারত। আপাতত মালের সঙ্গে সমীকরণ কিছুটা ঠিকঠাক হলেও দিল্লি ভোলেনি যে মালে ও বেজিঙের সম্পর্ক এখনও মধুর।

১৯ ২৫

ভারত মহাসাগরে তার ভূ-কৌশলগত অবস্থানের জেরে ও এই অঞ্চলে ভারতের উপরে চাপ বজায় রাখতে মলদ্বীপকে কোনও দিনই হাতছাড়া করতে চাইবে না বেজিং। অন্য দিকে, ভারত মহাসাগরে চিনা আধিপত্য একেবারেই চায় না ভারত।

২০ ২৫

এ ছাড়াও বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কায় সাম্প্রতিক সরকার বদলের জেরে ভারত অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাইছে। তাই মলদ্বীপকে হাতে রাখতে মরিয়া নয়াদিল্লিও।

২১ ২৫

এর পর চলতি বছরে মলদ্বীপের ৬০তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মুইজ্জু প্রধান অতিথি হিসাবে মোদীকে আমন্ত্রণ জানান। মোদী প্রথম রাষ্ট্রনেতা যাঁকে মলদ্বীপের স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপনে সম্মানিত অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মুইজ্জু। সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে গত শুক্রবার মলদ্বীপ সফরে যান মোদী।

২২ ২৫

মলদ্বীপের রাজধানী মালেতে গিয়ে মুইজ্জুর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার নানা বিষয় নিয়ে বৈঠক করেন মোদী। ভারতের তরফে প্রায় ৪৮৫০ কোটি টাকা ঋণের প্রস্তাবও পায় দ্বীপরাষ্ট্রটি।

২৩ ২৫

মলদ্বীপ সফরে গিয়ে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রতীক হিসাবে দ্বীপরাষ্ট্রের সেনার হাতে ৭২টি সামরিক যান এবং কিছু প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তুলে দেন মোদী। মুইজ্জুর প্রতিরক্ষা দফতরের নতুন ভবনকে চিহ্নিত করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘এটি শক্তিশালী অংশীদারি এবং অটল বিশ্বাসের কংক্রিট দিয়ে নির্মিত।’’ মলদ্বীপ সফরে গিয়ে মোদীর গলায় শোনা গিয়েছিল নয়াদিল্লি-মালে সামরিক সমঝোতা দৃঢ় করার অঙ্গীকারও।

২৪ ২৫

মোদীর মলদ্বীপ সফরের সময় দুই রাষ্ট্রনেতার বৈঠকে একাধিক বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে বিদেশ মন্ত্রকের একটি সূত্র জানিয়েছে, সেই আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল ভারতের তরফে মলদ্বীপকে সাড়ে ৫৬ কোটি ডলার (প্রায় ৪৮৫০ কোটি টাকা) ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব। ভারতের থেকে নেওয়া মলদ্বীপের বার্ষিক ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতাও হ্রাস করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সেই সূত্র।

২৫ ২৫

এমতাবস্থায় বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, ঝুঁকে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ভারতের কাছে ঝোঁকা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না মুইজ্জু সরকারের কাছে। আর সে কারণেই নয়াদিল্লির দিকে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট এবং ভারতের কাছে নতিস্বীকার করে আখেরে লাভই হয়েছে মুইজ্জুর। অন্তত তেমনটাই মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকে।

ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement