বিশ্বখ্যাত গ্রিক পরিচালক থিও অ্যাঞ্জেলোপুলোস। তাঁর ছবি ‘ইউলিসিস গেজ’-এর দৃশ্য। ভাঙা লেনিন আর কোন দিকে আঙুল দেখাবেন?
১৯৬৬ সাল। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিদ্যানগর কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছি। পশ্চিমবঙ্গে তখন কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা নিম্নমুখী। সারা বাংলায় বামপন্থীদের নেতৃত্বে খাদ্য আন্দোলন শুরু হল। মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের ‘মাইলো’ খাওয়ার পরামর্শে আগুনে ঘি পড়ল। আমার গ্রামের বাড়ি রায়দিঘি, প্রতি শনিবার সেখানে যাই। সোমবার কলেজে আসি। সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে তৈরি এসইউসি পার্টির নেতৃত্বে রায়দিঘি, কুলতলি আর পাথরপ্রতিমাতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল দুর্বার গতিতে। তার সঙ্গে যুক্ত হল তেভাগা আন্দোলন। চাষিরা শস্যের দু’ভাগ পাবে, জমির মালিক পাবে এক ভাগ। আন্দোলনের ফলে সাধারণ ঘর থেকে উঠে এল নতুন নতুন নেতৃত্ব।
আমাদের গ্রামে বামপন্থী আন্দোলনের নেতা ছিল বিশু বেরা। ভাল নাম বিশ্বনাথ। আমার ছোটবেলার বন্ধু, একসঙ্গে খেলতাম, এক স্কুলে পড়তাম। পরীক্ষার সময় স্যরদের কাছ থেকে সাজেশন এনে বিশুকে দিতাম। সেই বিশু তেভাগা আন্দোলনের সামনের সারিতে এল। ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসকে হটিয়ে শাসনক্ষমতায় এল যুক্তফ্রন্ট। আন্দোলনের পালে লাগল নতুন হাওয়া। বিশু এসইউসি পার্টির আঞ্চলিক নেতা হয়ে গেল। পার্টি তখন সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দিয়েছে, তাতে শামিল হল বিশুও। আমাদের গ্রামের মধ্যিখানে একটা স্কুল আছে, তার সঙ্গেই মাঠ। বিশু আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে, দলের বিপ্লবীদের অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করল সেই মাঠে। প্রতি রোববার মাঠে বসত অস্ত্রচালনা শিবির।
এক শুক্রবার কলেজ থেকে বাড়ি গিয়েছি। বিশু এসে বলল, ‘দাদা, আজ সন্ধের সময় স্কুলবাড়িতে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের ক্লাস হবে। পার্টির নেতারা আসবেন। তোমাকে যেতে হবে।’ আমি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্লাসে মার্ক্সবাদী তত্ত্ব পড়াতাম। বিভাগীয় প্রধান ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, এখন যিনি দেশের সম্মাননীয় রাষ্ট্রপতি। উনি পড়াতেন ভারতীয় সংবিধান ও রাজনীতি। আমি বিশুকে বললাম, মার্ক্সবাদ শিখতে তোমাদের ওখানে যাওয়ার দরকার নেই। বিশু বলল, ‘দাদা, লোকে বলে, তুমি কলেজে মার্ক্সবাদকে বিকৃত করে পড়াও। এই বুর্জোয়া মানসিকতা ছাড়তে হবে।’ আমি ওদের পার্টির ক্লাসে গেলাম না। ওরাও এর পর থেকে আমাকে আর ভাল চোখে দেখতে লাগল না। কিছু দিন পর দেখি, ওরা আমার জমিতে লাল ঝান্ডা পুঁতে দিয়েছে। এক দিন দেখি, আমার জমির ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে! প্রতিবাদ করায় আমাকে ‘শ্রেণিশত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করল।
আর এক দিন। বিশু এসে বলল, ‘তুমি শ্রেণিশত্রু, রক্তাক্ত বিপ্লবের বিরোধী। তাই তোমার বিচার হবে গণ-আদালতে।’ মন্দিরের মাঠে বসল সেই বিচারসভা। নেতৃত্বে বিশু। তখন কলেজ-শিক্ষকদের মাইনে ছিল দেড়শো টাকা। বিচারে রায় হল: আমাকে এক মাসের মাইনে দিতে হবে, শাস্তি হিসেবে। দিয়ে পার পেলাম তখনকার মতো।
আমাদের কলেজে বাংলা সাহিত্যের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন ড. তুষার চট্টোপাধ্যায়। বামপন্থী মানুষ, বনবিবি ও দক্ষিণরায় ছিল তাঁর গবেষণার বিষয়। রায়দিঘি অঞ্চলে বনবিবি-দক্ষিণরায়ের পুজো হয়। তুষারদা গবেষণার কাজে আমাদের বাড়ি যেতেন। এক দিন তেমনই গেছেন, রাতে পার্টির লোকজন এসে বলল, ওরা আমাদের গোলার ধান আর পুকুরের মাছ লুঠ করতে আসবে। এটা নাকি বিপ্লবের অংশ। তুষারদা ওদের বোঝালেন। বিশু আমার বন্ধু, তাই তুষারদার অনুরোধে একটা রফা হল। সে যাত্রায় অল্পের ওপর দিয়ে বাঁচা গেল।
’৬৮-তে আন্দোলন তীব্র হল। অজয় মুখোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসিয়ে বামপন্থীরা সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করল। জমির মালিকরা এক ভাগ শস্যও পেল না। খামারবাড়ি থেকেই উধাও হয়ে গেল ফসল। চলতে লাগল মারধর, লুঠপাট। সিপিআই(এম)-এর প্রমোদ দাশগুপ্ত বললেন, এই বিপ্লব হিংসার তাণ্ডব নয়, সৃষ্টির মহোৎসব। সমাজবাদ ভূমিষ্ঠ হবে, তাই একটু গর্ভযন্ত্রণা থাকবেই। আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পাদকীয়তে একটা ছোট ঘটনার উল্লেখ করে তার প্রত্যুত্তর দিল। ঘটনাটা এ রকম: ইংল্যান্ডের রানি সন্তানসম্ভবা। সারা দেশ উৎসবে মেতে। পরে দেখা গেল, ওটা সন্তান নয়, গর্ভে টিউমার হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও যেটা ঘটছে সেটা বিপ্লব নয়, বিপ্লবের টিউমার। এই সম্পাদকীয়র প্রতিবাদে আমাদের গ্রামের রাস্তার মোড়ে আনন্দবাজার পত্রিকা পোড়ানো হল। নেতৃত্বে যথারীতি বিশু।
এ দিকে সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে এসইউসি-র সংঘাত শুরু হল। এসইউসি ডাক দিল প্রত্যক্ষ সংগ্রামের। আমাদের বাড়িতে বন্দুক ছিল। বিশু এসে বলল, বন্দুক দিতে হবে। আমার ছোট ভাইয়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হল রণক্ষেত্রে সেনানীদের খাবার জোগানোর দায়িত্ব। রায়দিঘির মাঠে লড়াই হল। কিছু মানুষ হতাহত হল। বিশু অক্ষত রয়ে গেল। এক দিন বাড়ি এসে বন্দুকটা ফিরিয়েও দিয়ে গেল।
অনেক দিন পর, গ্রামের বাড়ি গিয়েছি। তখন সিপিআই(এম)-এর দাপটে এসইউসি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বিশুর খোঁজে ওর বাড়ির সামনে এসে ডাকলাম। বেরিয়ে এল, দেখি, ওর গলায় তুলসীর মালা। জিজ্ঞেস করলাম, কী রে, কী করছিস এখন? বিশু বলল, ‘হরিনামের দল করেছি। রোজ হরিনাম করি। মন্দিরতলায় হরিনাম হবে, তুমি এসো।’ সেই মন্দিরতলা, যেখানে শ্রেণিশত্রু আমাকে নিয়ে গণ-আদালত বসেছিল! বললাম, তুই তো মার্ক্সবাদকেই অমোঘ সত্য বলে জানতিস! সেটা ছেড়ে এখন... বিশু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এখন বুঝেছি, হরিনামই সত্য!’
প্রদ্যোত কুমার মন্ডল, বিদ্যানগর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
pradyot.36@gmail.com
ষাটের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 60’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in