ছবি: সুমন চৌধুরী
এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা তল্পি গোটাতে গোটাতে আমার ডগ্দরবাবু বাবা এসে পড়লেন বিন্ধ্য পর্বতের ধারে ছোট্ট শহর মণীন্দ্রগড়ে। ছিমছাম পুঁচকে সেই শহরে সন্ধে নামলেই ভিড় করে আসত ভূতের দল। আমরা তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে মশারির ভেতর ঢুকে পড়তাম বইপত্তর নিয়ে। এখানেই এক দিন ভঁইস-গাড়ি চড়ে সুখলাল আর দুধলাল এল। দুই ভাই মিলে একটা মাঠে ত্রিপল টাঙাল। ১৬ মিলিমিটার প্রোজেক্টর চালিয়ে সিনেমা দেখাত সুখলাল। দুধলাল টিকিট বেচত। এক দিন ছবি চালিয়ে দিয়ে সুখলাল অন্ধকার মাঠে গেছে কাজ সারতে, হঠাৎ গোঁ-গোঁ করে মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা তুলে, কানে পইতে জড়িয়ে চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেল। সবাই চ্যাংদোলা করে সুখলালকে নিয়ে এল বাবার কাছে। দুধলাল কাঁদতে কাঁদতে জানাল, একটা পেতনি নাকি পেছন থেকে জাপটে ধরেছিল সুখলালকে। আগেও পেতনিটা এ রকম করেছে। বাবার হাতের গুণে আধ ঘণ্টার মধ্যেই সুখলাল উঠে বসল। কাঁচুমাচু হয়ে বাবার কাছে জানতে চাইল, পেতনিটাকে নিয়ে কী করবে এখন ও? বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, পুরুত ডেকে দিচ্ছি, শাদিই করে ফ্যাল। ভিজিট নিলেন না বাবা, আর আমাদের অবাধ যাওয়া-আসার ছাড় মিলল সুখলালের তাঁবুর ভেতর। কখনও মধুবালা, কখনও বৈজয়ন্তীমালা, কখনও সুইমিং কস্টিউম পরা নূতন, উফ্ফ্ফ! আমার সবচেয়ে মনে ধরেছিল মধুবালাকে। বছর দুয়েক পর বাবার সঙ্গে বম্বে গেছি, দেখি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে মধুবালা। এর পরেও কত বার কত বাসস্ট্যান্ডে দেখেছি মধুবালাকে! ন’বছরের সেই প্রেম আজও জমে আছে বুকের ভেতর।
এক দিন সুখলালের তাঁবু থেকে অন্ধকার মাঠ পেরিয়ে বাড়ির দিকে আসতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। একটা বিশাল অশ্বত্থ গাছের তলায় দাঁড়িয়ে গালে হাত দিয়ে গলা ছেড়ে গান গাইছে একটা ভূত— নেতাজি সুভাষ... নেতাজি সুভাষ... নেতাজি সুভাষ। এখনও চোখ বন্ধ করে হুবহু গেয়ে দিতে পারি গানটা। ভূতটা হঠাৎ বলে উঠল, এখনও দাঁড়িয়ে আছিস! বাড়ি যাঁআআ! সে দিন রাত্তিরে পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, হঠাৎ দেখি, মশারি তুলে ভূতটা কখন মাথা গলিয়ে দিয়েছে ভেতরে। বলছে, যতই পঁড়, ডাক্তার-মোক্তার তুঁই কোনও জন্মেই হঁবি না। ভূতটা কী করে যেন জেনে ফেলেছিল, তত দিনে আরও বড় একটা ভূত সুখলাল-দুধলালের পরদা ছাপিয়ে চেপে বসছে আমার ঘাড়ে। অনেক পরে সুখলাল আর তার প্রোজেক্টর ঢুকে পড়েছিল আমার ছবি ‘স্বপ্নের দিন’-এ।
মণীন্দ্রগড়ে থাকতে থাকতেই আমাকে আর দাদাকে বাবা পাঠিয়ে দিলেন রামকৃষ্ণ মিশনে। নিজের কাপড় নিজেকে কাচতে হত, নিজের বাসন নিজেকে মাজতে হত, নিজের বিছানা নিজেকেই করতে হত। একটা ঘরে আমরা কুড়ি-পঁচিশ জন। প্রত্যেক রাতেই অত্যাশ্চর্য একটা ঘটনা ঘটত। শোয়ার আগে পচু নিলডাউন হয়ে, পেছনটা কামানের মতো ওপরে তুলে বলত, নেঃ, বল। কেউ হয়তো বলল ‘একানব্বই’, আর পচু কখনও বোমার মতো, কখনও সুরেলা করে বাতকম্ম শুরু করে দিত। আমরা খড়ি দিয়ে গুনতাম। ঠিক একানব্বইয়ে এসে পচু থেমে যেত। কোনও দিন বিয়াল্লিশ, কোনও দিন একশো-নয়, কোনও দিন পঁচাশি। পচুর কখনও ভুল হত না, আর হাততালিতে ফেটে পড়ত আমাদের ঘর। পরে কোনও এক থানার ওসি হয়েছিল পচু। তখন মেট্রোতে ‘দূরত্ব’ চলছে। শো ভাঙল, হঠাৎ কে এসে কাঁধে চাপড় মারল। মুখ ফিরিয়ে দেখি, পঞ্চানন সান্যাল। জড়িয়ে ধরল আমাকে। জিজ্ঞেস করলাম, এখন কি খালি রিভলভার? ঢিসুম ঢিসুম? পচু বলল, সে তো চোর-ছ্যাঁচোড়দের জন্য। বাড়িতে বউ বেশি বেগড়বাই করলে এখনও কামান দাগি। পরে অনেক খুঁজেছিলাম পচুকে, পাইনি। ওকে সিনেমা বা কবিতায় নিয়ে আসার ইচ্ছে আমার এখনও যায়নি।
বাবা বদলি হয়ে চলে এলেন আবার অন্য একটা জায়গায়। এখানে ভাল স্কুল আছে, দিদিকে গান শেখানোর মাস্টার আছে, তাঁবু-টাবু নয়, আস্ত দুটো সিনেমা-হল আছে। মিশন থেকে আমরা বাড়ি ফিরে এলাম আবার। প্রথম বর্ষার পর সেখানে ঘাসের জঙ্গলে অদ্ভুত সুন্দর লাল লাল ভেলভেট পোকারা ঘুরে বেড়াত। তাদের হাতের মুঠোয় নিয়ে আমরা বলতাম, ‘ছোটি মোটি পিপড়া বোটি/ তেরে মামা লাড্ডু লায়া/ লাল দরজা খোল দে।’ মুঠো খুললেই তারা হাঁটতে শুরু করত তালুর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। ঝমঝমিয়ে বর্ষা শুরু হওয়ার পর কোথায় যেন হারিয়ে যেত ওরা। ফিরে আসত পরের বর্ষার শুরুতে। মায়ের টিপের মতো লাল এই পোকারা উঁকি মেরে যেত আমার স্বপ্নে। অনেক বছর পর এক দিন রাত্রে বাড়ি ফিরে দরজা খুলে দেখি, যা যা থাকার তার কিছুই নেই! খাবার টেবিল, বসার চেয়ার, দেওয়াল-ঘড়ি, বইপত্তর, কিচ্ছু নেই, তার বদলে ঘর জুড়ে সেই ভেজা ঘাসের জঙ্গল, আর কয়েকটা বাচ্চা খুঁজে বেড়াচ্ছে ছোটিমোটি পিপড়া বোটিদের।
এরও অনেক পরে এক দিন বাড়ি ফিরে দেখি, গা-ভর্তি গয়না পরে হাসি-হাসি মুখে বসে আছেন বাপ্পী লাহিড়ী। সিনেমা তৈরি করতে হবে ওঁর জন্য। আমার প্রথম শর্তই ছিল, বাপ্পী নয়, আমি ওকে ডাকব ‘বাপি’ বলে। ‘বাপ্পী’ কখনও বাঙালি ছেলের নাম হয়! ওঁর প্রোডাকশনের ছবি ‘লাল দরজা’। এক জন দাঁতের ডাক্তার, সারা জীবন হাঁ-মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যে কিনা বুঝতেই পারেনি, তার চার পাশের বাকি সব দরজা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ভালবাসা, মায়া, স্বপ্ন, সব চলে গিয়ে সে হয়ে উঠছে এক জন রোবট-মানুষ। এক দিন বাড়ি ফিরে দরজা যখন কিছুতেই খুলছে না, তখন সে বিড়বিড় করে ডাকতে থাকে ছোটিমোটি পিপড়া বোটিদের। খুলে যায় দরজা, দেখা যায়, দরজার ও-পারে ভেজা মাঠ। ‘চরাচর’-এর লখা-ও হঠাৎ এক দিন একই দরজা খুলে ও-পারেই দেখতে পায় তার সেই সমুদ্রকে, যার ওপর উড়ে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার পাখি— যা সে দেখতে চেয়েছিল বার বার।
এক বার শান্তিনিকেতনে যোগেন চৌধুরীর দেওয়াল থেকে তুলে এনেছিলাম একটা ছবি— স্তনের চার পাশে অবিরাম ঘুরে চলেছে এক সাপ। আজকাল দেওয়াল থেকে সে নেমে আসে ঘরের মেঝেতে, কখনও খাবার টেবিলের ওপর বসে চুপ করে আমার খাওয়া দেখে। কখনও ক্যামেরার সামনে, লোকজনকে অবহেলা করে এগিয়ে যায় অন্য কোনও রহস্যময় গভীরের দিকে। এরা সবাই কখনও না কখনও, কিছু না কিছু আমায় দিয়ে চলেছে, ঢুকে পড়েছে আমার কবিতায়, সিনেমায়। স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে এসে আবার ঢুকে পড়েছে স্বপ্নের ভেতর।