ট্র্যাপিজ় থেকে কোল্ড কাট

ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে চিরতরে ঝাঁপ ফেলা দোকানে পাশাপাশি মিলত পর্ক আর বিফ। কলকাতার কসমোপলিটান জীবনে মিশে ছিল যাঁর বিপণি, সেই হাঙ্গেরীয় সাহেব কালমান কোহারির জীবন শুরু সার্কাসে।‘‘উনি ছোটবেলায় সাহেবের মেয়ের সঙ্গে এক ক্লাসে পড়েছেন। ওঁর বিষয়ে অনেক কথা আপনাকে বলতে পারতেন!’’ শেষমেশ হদিস মিললও— ‘মিসেস ঠাকুর’-এর।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:৩০
Share:

স্মৃতি: বন্ধ কালমান কোল্ড স্টোরেজ ডেলিকেসি

বোতাম-টেপা মোবাইলেই স্বচ্ছন্দ ফ্রি স্কুল স্ট্রিট পাড়ার মলিনবেশ ভদ্রলোক। ‘অ্যাডভোকেট দাদা’, ‘বেক্‌ন ম্যাডাম’, ‘ক্যালকাটা ক্লাব’, ‘কাকা পর্ক’, ‘ডাক দাদা’ প্রমুখ সাঙ্কেতিক নামের ভিড় থেকেই প্রয়োজনীয় মানুষটিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন তিনি। নামের আড়ালে লুকিয়ে অভিজাত কলকাতার কোনও মুখ। বেশির ভাগই ‘কালমান কোল্ড স্টোরেজ ডেলিকেসি’র অনুরাগী খদ্দের বা মাংসের সাপ্লায়ার। সাম্প্রতিক কালে কালমানের রোজনামচার কাপ্তেন, দোকানের ‘মামা’ জয় ঘোষ বলছিলেন ঘন ঘন এ তল্লাটে আসতে দেখা প্রৌঢ়া নারীর কথা। ‘‘উনি ছোটবেলায় সাহেবের মেয়ের সঙ্গে এক ক্লাসে পড়েছেন। ওঁর বিষয়ে অনেক কথা আপনাকে বলতে পারতেন!’’ শেষমেশ হদিস মিললও— ‘মিসেস ঠাকুর’-এর।

Advertisement

আজন্ম রিপন লেনের বাসিন্দা, ৭১ বছরের বৃদ্ধার গলায় কালমানের নামে উচ্ছ্বাস উপচে পড়ে। বৃদ্ধার বাবা ধর্মে ইহুদি, নারকেলডাঙার সমাধিক্ষেত্রে শুয়ে আছেন। মা রোম্যান ক্যাথলিক। মেয়ে বিহারি ক্রিশ্চান পরিবারে বিবাহসূত্রে এখন হেলেন ঠাকুর। বলছিলেন, কালমানের দোকানে যাতায়াত তাঁদের আজন্ম। দোকানের প্রতিষ্ঠাতা কালমান কোহারির মেয়ে তামারা কোহারি তাঁর সঙ্গে লোরেটো ডে স্কুলে এক ক্লাসে পড়তেন। ‘‘মিস্টার কোহারি নিজে ঠান্ডা মাংস বার করে কেটে-কেটে চাখতে বলতেন। কথা বলতেন বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে।’’ ১৯৬৯ সালে কালমান সাহেবের মৃত্যু এ শহরেই। সাহেবের ইতিহাস তবু যেন রহস্য মোড়া। হেলেনের মতো প্রবীণের স্মৃতিই অতএব ভরসা।

ইউরোপীয় সার্কাসের দলের সঙ্গে তিরিশের দশকে কলকাতায় এসেছিলেন ট্র্যাপিজ়-শিল্পী কালমান, এটাই জনশ্রুতি। কেন থেকে গেলেন, তা স্পষ্ট নয়। তাঁর স্ত্রী ছিলেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর হাঙ্গেরিতে ফেরাটা কালমানের জন্য সহজ ছিল না। সোভিয়েট জমানার হাঙ্গেরির বদলে, কলকাতার জনজীবনে মিশে গিয়েছেন তিনি। পর্ক বা বিফ হাঙ্গেরিয়ান সসেজের সঙ্গে সমার্থক হয়ে উঠেছে কালমান। সাহেবরা বা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, ইহুদি, চিনেরা ঝাঁকে-ঝাঁকে শহর ছাড়লেও ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে মাংসের রকমারি মোরব্বা, মিট লোফ, লিভার পেস্ট, স্মোকড হ্যাম, সসেজের সমঝদারের কখনও অভাব হয়নি কলকাতায়।

Advertisement

কালমান পরিবার অস্ট্রেলিয়ায় চলে যায় গত শতকের সত্তরের দশকে। সপ্তাহ দুয়েক আগে সাত দশকের পুরনো, ঠান্ডা মাংসের দোকানে কেনাবেচা বন্ধ হয়ে গিয়েছে চিরতরে। একদা কালমান সাহেবের বিশ্বস্ত সহচর, দোকানের পরবর্তী মালিক বিষ্ণুপদ ধরের পরিবার পার্টনারশিপে কাপড়ের কারবার শুরু করবেন সেখানে। প্রয়াত বিষ্ণুপদবাবুর শ্যালক জয় বা কন্যা আগমনি আপশোস করছিলেন, কালমান সাহেবের পুরনো ছবিটাও খুঁজে পাচ্ছেন না। তবে হাঙ্গেরিয়ান সাহেবের স্মৃতি তাঁদের চোখে উজ্জ্বল। কালমানের এক ছেলে স্টিভ নাকি বছর আটেক আগেও কলকাতায় এসেছেন। ‘‘আমার বাবার সঙ্গে দেখা হলে, দুই বুড়ো জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন, পুরনো দিনের কথা বলতেন,’’ বললেন আগমনি। বছর-শুরুতে অস্ট্রেলিয়া থেকে স্টিভের কার্ডও এসেছে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ঠিকানায়!

আর এক পুরনো কালমান-ভক্ত, দীর্ঘ দিন ইউরোপ-আমেরিকার জল খাওয়া গৈরিক বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে গ্যারিক এখন ব্যবসাসূত্রে কলকাতায়। কালমানের ঝাল-ঝাল স্পাইসি বিফ কলারের গভীর অনুরাগী তিনি। বলছিলেন, ‘‘সত্তরের দশকে আমাদের বাড়ির উর্দুভাষী কাজের লোক মজিদের সঙ্গেই বেশি যেতাম কালমানে। তখনও এক মেমসাহেবকে দেখেছি।’’ ডাক্তার দম্পতি, প্লাস্টিক সার্জন মণীশমুকুল ঘোষ, ক্যানসার শল্যবিশারদ রোজ়িনা আহমেদদের কলেজজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট পাড়ায় হাউহুয়া-র চিমনি সুপ বা ক্যালমানের হ্যাম-সসেজ। হাউহুয়া বন্ধ হওয়ার পরে লর্ডসের মোড়ে নবজন্ম পেয়েছে। কালমানের দোকানের ইতি তাঁদের কাছেও বড় ধাক্কা।

কালমানের যবনিকাপাতের খবর কাগজে প্রকাশিত হওয়া ইস্তক ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে শহরের ব্যবসায়ী-উকিল-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-অধ্যাপকেরা প্রিয় মাংস-স্মৃতির শোকযাপন করছেন। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে তাকে ফেরানো অসম্ভব, জেনেও কলকাতার কালমান-পরম্পরা কী ভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।

আর এক ঘোষিত অনুরাগী অঞ্জন দত্তের কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, কালমান এ শহরের ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর চাহিদা কখনও উপেক্ষা করেনি। বিফ-পর্কপ্রেমী বাঙালি খ্রিস্টান, চিনে পরিবার থেকে তথাকথিত মূলস্রোতের মাংস-অনুরাগীদের জন্য কালমান ছিল লাইফলাইন। এক ছাদের তলায় ডাক-চিকেন-বিফ-পর্ক-টার্কি আর কোথাও মিলত না। বড় শপিংমল সচরাচর ‘নিষিদ্ধ মাংস’ বিক্রির স্পর্ধা রাখে না। গত ক’বছরে কলকাতার বিফ-রোম্যান্সের সৌধ নিজ়াম পর্যন্ত তার বিফ রোলের ঐতিহ্য ত্যাগ করেছে। কিন্তু কালমান, তাদের শীতকালীন সম্পদ সল্টবিফ, অক্সটাং, হাঙ্গেরিয়ান সসেজের অহংঙ্কার ছাড়তে চায়নি। দোকানের কথা উঠলেই কেঁদে ফেলেন রুমা ধর, ‘‘বিশ্বাস করুন, কিছু কারিগর এমন অশান্তি শুরু করল! একসঙ্গে বিফ-পর্ক, দু’টোর কাজ করবে এমন কারিগর পেতে হিমশিম খাচ্ছিলাম।’’ নিউমার্কেট পাড়ায় এখনও চলছে পর্কের কয়েকটি দোকান। কিন্তু তুমুল চাহিদা সত্ত্বেও কারিগরের অভাবে কালমানের একমেবাদ্বিতীয়ম গোমাংসের প্রসেস্‌ড মিট হঠাৎ অদৃশ্য।

মল্লিকবাজার মোড়ে কালমান কোহারির সমাধিফলকের ধুলো-জমা পাথর ঘিরে এখন বিক্ষিপ্ত আগাছার ভিড়। আর অদূরে দোকানে চলছে ভাঙাভাঙি, রূপান্তর-পর্ব। তার প্রত্যেকটা ঠুকঠাক পুরনো কলকাতা-অনুরাগীদের বুকে ধাক্কা মারে। কিউরড মাংস তৈরির সরঞ্জাম, স্মোকিংয়ের আলমারিসুদ্ধ তিন ম্যাটাডর সামগ্রী বেরিয়ে গিয়েছে আগেই। তবু মাংসের মোরব্বার চেনা গন্ধটা এখনও অবচেতনে ধাক্কা মারে। দু’পাশে সাবেক রেকর্ডের দোকান। মাঝে ধ্রুপদী কলকাতার কালখণ্ড যেন আচমকা খসে পড়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন