বিশেষ বিশেষ খবর

২০১৫-র হাইলাইট্‌স। তবে, পরিবেশ দূষণের জন্য ইথার তরঙ্গে এমন ঝামেলা, কিছু খবর টেলিকাস্ট হতে গিয়ে বিগড়ে গেছে। তাতে কী? সব খবরই তো আধা কাল্পনিক!অনেকে বলেন, এই দেশের ‘আচ্ছে দিন’-এর শেষের শুরু ২০১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি, যে দিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে নিজের নাম লেখা দশলাখি স্যুট পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মঞ্চে ওঠেন। স্যুটটির নিজের কোনও দোষ ছিল না, এটি ছিল অতিথির চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’ কূটনীতির অংশ, যা শেষমেশ বুমেরাং হয়ে যায়। সমস্যা শুরু হয় মিশেল ওবামাকে দিয়ে, যদিও মূল কালপ্রিট ছিল দিল্লির অকালবর্ষণ।

Advertisement

সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

অনেকে বলেন, এই দেশের ‘আচ্ছে দিন’-এর শেষের শুরু ২০১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি, যে দিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে নিজের নাম লেখা দশলাখি স্যুট পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মঞ্চে ওঠেন। স্যুটটির নিজের কোনও দোষ ছিল না, এটি ছিল অতিথির চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’ কূটনীতির অংশ, যা শেষমেশ বুমেরাং হয়ে যায়। সমস্যা শুরু হয় মিশেল ওবামাকে দিয়ে, যদিও মূল কালপ্রিট ছিল দিল্লির অকালবর্ষণ। প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারতের ভাগ্যাকাশ কালো করে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়। শোনা যায় জলকাদার মধ্যে অনভ্যস্ত পায়ে হাঁটাহাঁটি করিয়েও শেষমেশ বারাকের পাশে বসতে না দেওয়ায় মিশেল অত্যন্ত বিরক্ত হন এবং রাতে বারাককে ‘কই তোমার স্যুটে তো নাম লেখা নেই’ বলে খোঁটা দেন। ওবামা নিজে অবশ্য এই নিয়ে খোঁচাখুঁচির পক্ষপাতী ছিলেন না। ভারতীয় মন্ত্রীসান্ত্রিদের এয়ারফোর্স-ওয়ানের সুবন্দোবস্ত নেই, বেচারিদের এয়ারপোর্টে যখন তখন জামাকাপড় খুলিয়ে সার্চ করা হয়, নাম না লেখা থাকলে কোট হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা— এই ছিল ওবামার মত। মধ্যবিত্ত কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের সন্তান, দেশের বাড়ি কেনিয়ায়, তিনি গরিবির মর্ম বোঝেন। কিন্তু হোয়াইট হাউস সূত্রে জানা যায়, মিশেল এতে শান্ত হননি। ফলে হাসিহাসি মুখে বিদায় নিয়েও ওবামা দেশে ফিরে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ নিয়ে বিস্ফোরক এক বিবৃতি দেন। আগুন একটু একটু করে জ্বলতে শুরু করে।

Advertisement

কূটনীতির অঙ্গ হিসেবে সরাসরি উত্তর না দিয়ে এক জন সরকারি মুখপাত্র ‘ভারতবর্ষ গরিব দেশ নয়, সেটা জগৎসভায় দেখানোর প্রয়োজন ছিল’ বললে হিতে বিপরীত হয়। কূটনীতির বিন্দুবিসর্গ না বুঝে সংবাদপত্রগুলি হুজুগে মাতে, সঙ্গে প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বরা। প্রবাদপ্রতিম নায়ক অমিতাভ বচ্চন তাঁর ব্লগে বক্রোক্তি করেন, ‘ঐশ্বর্য আমার বাড়িতেই আছে, সারা পৃথিবীবাসী সেটা এমনিই জানে।’ এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল, কিন্তু সমস্যা হয় রাজ ঠাকরের হঠাৎ মরাঠি অস্মিতা জেগে ওঠায়। তিনি দুম করে বলে বসেন, ‘ঐশ্বর্য আছে খুব ভাল কথা, কিন্তু পাড়ার মেয়ে যেন বাইরে না যায়।’ এতে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ে। ভারতের চলচ্চিত্র-নায়করা এমনিতেই লার্জার দ্যান লাইফ, বিগ বি তো এত বড়, যে অনেক সময় পরদায় আঁটেন না। তাঁকে নিয়ে কটূক্তি হওয়ায় জনমানসে আলোড়ন দেখা দেয়। সঙ্গে আসরে নামেন জঙ্গি নারীবাদীরা। দিল্লি এবং কলকাতায় লাগাতার কুশপুতুল পোড়ে। ‘দেশের লোক না খেয়ে মরছে আর উনি স্যুট পরছেন’— বলে সংবাদমাধ্যমে চেঁচামেচি শুরু হয়। শান্তিনিকেতনের জনৈকা ছাত্রী এর মধ্যে ‘মোদী তুমি বাজে লোক, তোমার স্যুটে ছারপোকা হোক’— স্লোগান লিখলে সেটা ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতবর্ষে ‘আচ্ছে দিন’ বিতর্ক শুরু হয়ে যায়।

বিতর্কের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় মার্চ মাসে মোদীর বিদেশভ্রমণ শুরু হবার পর পরই। ব্যাপারটা একটু আশ্চর্যজনক, কারণ এর মধ্যে দেশে কাণ্ড কিছু কম ঘটেনি। ফেব্রুয়ারির শুরুতে দিল্লি নির্বাচনে হইচইয়ের চূড়ান্ত হয়েছে, যখন ৬৭টা আসনে জিতে অরবিন্দ কেজরীবাল একে-৬৭ নাম কিনেছেন। ভোটের পরেও সেখানে হেডলাইনের শেষ নেই। এপ্রিল মাসে যোগেন্দ্র যাদবকে বহিষ্কার করার পর বাংলার বিখ্যাত সংবাদপত্র আনন্দবাজার হেডলাইন করে ‘অরবিন্দ যোগেন্দ্রর লহ নমস্কার।’ কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, এই ডামাডোলের মধ্যেই মোদীর বিদেশ সফর শুরু হলে সেটাকে লক্ষ্যবস্তু করে তুলতে কেউ ভোলেনি।

Advertisement

ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে আরও আশ্চর্য, কারণ রাজনীতিকদের বিদেশে বেড়ানো নতুন কিছু নয়। তাঁরা নানা কারণে নানা দেশে ঘুরে বেড়ান, কিন্তু কেউই মোদীর মতো তোপের মুখে পড়েননি। ২০১৪-য় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অলিম্পিক সফরের মতো টিম নিয়ে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন, কী শিল্প এল জানতে পারা না গেলেও সে নিয়ে তেমন বিতর্ক হয়নি। সফরের ফলাফল কী জানতে চাওয়ায় তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এ সফর প্রিপেড নয়, পোস্টপেড।’ ছ’মাস পরে একই প্রশ্ন করায় তিনি বলেন, ‘পদক নয়, অংশগ্রহণই আসল।’ সম্ভবত পুলিশের ভয়েই সে নিয়ে কেউ টুঁ শব্দটিও করেনি। কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধীও মাঝে অনেক দিন বিদেশে ছিলেন। স্পষ্ট কারণ জানা না গেলেও এক প্রবীণ কংগ্রেস নেতা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘রাহুলের মিডাস টাচ। যা ছোঁয় তাই সোনা, তাই জ্যোতিষী ওকে কিছু দিন দেশের বাইরে থাকতে বলেছিলেন।’ এতে উত্তাপের সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু হাইকম্যান্ড ব্যাপারটা নিয়ে কোনো সাড়াশব্দ না করায়, বিতর্কের ধূম্রজাল দূরে থাক, আত্মজীবনী ছাপার খরচও ওঠেনি। এমনকী কমিউনিস্ট নেতা প্রকাশ কারাটও বেশ কিছু দিন গরমের ছুটিতে স্ত্রী, শ্যালিকা ও ভায়রাভাই সহ ইউরোপে বেড়াতে যেতেন। পশ্চিমবঙ্গের এক মিচকে কবি একদা সে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন ‘প্রণয় প্রকাশ হলে হয় লোকনিন্দা/ রাধার প্রণয় আছে, প্রকাশের বৃন্দা।’ তখন সিপিএম জমানা, কবি ঝটপট বঙ্কিম পুরস্কার পেয়ে গেলে সে আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়। জমানা বদলানোর পর জার্সি পালটে অনেকে একে স্বজনপোষণ আখ্যা দিলেও, তুখড় স্মার্ট বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘আমরা সমালোচকদের সম্মান দিতে জানতাম, কার্টুন আঁকলেই জেলে ভরতাম না।’ কথাটা সত্যি হওয়ায় সে বিতর্কও ধামাচাপা পড়ে যায়।

কিন্তু মোদীর ব্যাপারটা আলাদা। তিনি যখন বিদেশে, কৃষক আত্মহত্যা তখন মহামারীতে পরিণত। এপ্রিল মাসেই কেজরীবালের জনসভায় এক কৃষক গাছের ডাল থেকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। দিল্লির গাছ থেকে নামানো কেন্দ্রের কাজ না রাজ্যের, সে নিয়ে প্রচুর বাগ্‌বিতণ্ডা হওয়ার পরে দেখা যায়, ভদ্রলোক মারা গেছেন। কেজরীবাল দ্রুত হাসপাতালে গিয়ে অবস্থা সামলালেও, মোদী টুইটারেই সমবেদনা সারলে লোকে ভাবে তিনি দেশের বাইরে। এর মধ্যে অবস্থা ঘোরালো করেন ঠোঁটকাটা এক মুম্বই গায়ক। এর আগে তিনি ফুটপাতবাসীদের কুকুর আখ্যা দিয়ে হেডলাইন হয়েছিলেন, এ বার দুম করে বলে দেন, ‘গাছ থেকে ঝুললে তাকে বাঁদর বলা হয়।’ অতঃপর দেশ জুড়ে তাঁকে পশুবিশেষজ্ঞ আখ্যা দেওয়া হয়। সঙ্গে মোদীকে নিয়েও শুরু হয়ে যায় বিতর্ক। কৃষকরা না খেতে পেয়ে মরছে, এই অবস্থায় সেশেল্‌স বেড়ানো?

মোদীর তরফে এক আমলা মিনমিন করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দেশভ্রমণের শখ দীর্ঘ দিনের, কিন্তু গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ভিসায় কিছু সমস্যা ছিল। ফলে এখন দেশের মুখ চেয়ে দ্বিগুণ ঘুরতে হচ্ছে। ভিসা না পাওয়ার দায় বিরোধী অপপ্রচারের। কিন্তু তাতে কোনও ফল হয় না। সোশাল নেটওয়ার্কে মোদীর সফরসূচি হটকেকের মতো শেয়ার হতে শুরু করে। একটি পোস্টার জনপ্রিয় হয়ে যায়, যাতে দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী বিদেশে শপিং মলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আর বিদেশমন্ত্রী দেশে বসে আডবাণীকে বেবি-সিট করছেন।

ব্যাপারটা বিদেশভ্রমণেই সীমাবদ্ধ থাকলেও এক রকম হত, কিন্তু এর মধ্যে সরকারি পক্ষের এক সাংসদ মোদীর বিদেশযাত্রাকে রামের শ্রীলঙ্কাজয় আখ্যা দিলে বিতর্ক সম্পূর্ণ অন্য দিকে মোড় নেয়। তিনশো তেত্রিশজন ইতিহাসবিদ এক সঙ্গে একটি খোলা চিঠিতে লেখেন, ‘প্রথম ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে দ্বীপরাষ্ট্রে পদার্পণ করেন যে ভারতীয় নৃপতি, তাঁর নাম বিজয়সিংহ।’ বিজয়সিংহের আদি বাড়ি নাকি সিঙ্গুর, তাই এর পিছনে বাঙালি বামপন্থীদের হাত আছে বলে সন্দেহ করা হয়। বামপন্থীরা এমনিতেই দিল্লির বিদ্বজ্জন মহলে খুবই প্রভাবশালী। অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরী এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে লিখে গেছেন। এখনও অরুন্ধতী রায় নামের এক জন নভেলিস্ট কুল্লে একটি নভেল লেখার পর ঝাড়া আঠারো বছর বিরতি নিয়েও বিখ্যাত লেখিকাই থেকে গেছেন, স্রেফ বামপন্থী হওয়ার কারণে। ফলে ব্যাপারটা সরকারি তরফে সিরিয়াসলি নেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা জনপ্রিয় টিভি তারকা স্মৃতি ইরানি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, রাম এবং যুধিষ্ঠির অবশ্যই বাস্তব চরিত্র, কারণ টিভিতে তাঁদের দেখা গেছে। একশো কোটি মানুষ একসঙ্গে ভুল দেখতে পারে না, সে জন্য মানুষের অনুভূতিকে সম্মান দেওয়া প্রয়োজন। তৎক্ষণাৎ টিভির দ্রৌপদীকে দলে রিক্রুট করা হয়, এবং টিভির যুধিষ্ঠিরকে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর পদে বসানো হয়। রটে যায় ‘সীতা অউর গীতা’-কে এ বার ভারতের জাতীয় সিনেমা ঘোষণা করা হবে। ফলে যা হয়, তার সঙ্গে হনুমানের স্বর্ণলঙ্কাজয়ের সুস্পষ্ট মিল আছে। লেখক এবং বুদ্ধিজীবীরা ক্ষেপে গিয়ে টপাটপ পুরস্কার ফেরত দিতে শুরু করেন। ইতিহাসবিদরা খননকার্য বন্ধ করে প্রতিবাদপত্র লিখতে শুরু করেন। বচ্চন কাণ্ডের পর বলিউডি নায়করাও খেপে ছিলেন। তাঁরাও একে একে ক্ষোভ জানাতে শুরু করেন। পাটকেলেরও অভাব হয় না। চেতন ভগত লেখেন, ইতিহাসবিদেরা ‘এখানে এই ঘটেছিল আর ওখানে ওই ঘটেছিল’ বলা ছাড়া আর কাজের কাজ কী করেন, তিনি জানেন না। মহারাষ্ট্রের এক নেতা বলিউডি খানদের ‘খানসামা’ বলে অভিহিত করেন। জবাবে আমির খান বলেন, তিনি যা বলেছিলেন, এই অসভ্যতায় সেটাই প্রমাণিত হল। ভারতের ইতিহাসে মুষলপর্ব শুরু হয়ে যায়, এবং এই ধুন্ধুমার কাণ্ড পৃথিবীতে সহিষ্ণুতা-বিতর্ক নামে পরিচিত হয়।

আশ্চর্য হলেও সত্যি, এই পুরো বিতর্কে গরুরা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা শান্তশিষ্ট প্রাণী, সাতে-পাঁচে থাকেনা, এমনকী গরুদের ভোটাধিকারও নেই। কিন্তু তার পরেও আশ্চর্যজনক ভাবে তারা ‘আচ্ছে দিন’ সন্দর্ভের অংশ হয়ে যায়। এর মূল কারণ নিহিত আছে মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগানে। এই স্লোগানের সুযোগ নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে কিছু দুষ্টচক্র ভারতীয় গরুদের বিদেশে পাচার করছিল। শিল্পমন্ত্রক খুব স্পষ্ট করে জানায়, যে, গরুরা সফ্‌টওয়্যার নয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে গাড়ি চালালেও তাদের গাড়ির পার্টস হিসেবে ভাবা যাবে না, কিন্তু তাতেও গরু-চালান বন্ধ হয়নি। এ নিয়ে নানা মহলে ক্ষোভ ছিলই। এ অবস্থায় দাদরি নামক এক জায়গায় গরুচোর সন্দেহে এক জনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলে সে নিয়ে বিবাদ তুঙ্গে ওঠে। জনমত দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। বিশেষত ফিল্মি মহল সহিষ্ণুতার পক্ষে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে। সৃজিত মুখোপাধ্যায় ‘রাজকাহিনী’ নামক একটি জনপ্রিয় সিনেমা বানিয়ে ধর্মীয় কুচক্রীদের মুখোশ খুলে দেন, সিনেমাটির শেষে ‘জনগণমন’র কয়েকটি স্তবক বিশেষ কায়দায় ব্যবহার করা হয়। আলাহিয়া বিলাবল রাগে খেলিয়ে খেলিয়ে অনুপম রায় ‘ভারত ভাগ-গো-বিধাতা’ শব্দটি এমন ভাবে ব্যবহার করেন, তাতে স্পষ্ট বোঝা যায় আসলে হিন্দু মৌলবাদীদের ব্যঙ্গ করা হয়েছে। সিনেমার শেষে বাংলার প্রফেট কবীর সুমন সহ এক দল প্রতিষ্ঠিত শিল্পী যখন সমস্বরে ‘জয় হে’ গাইছেন, হল ফেটে পড়ে এবং সমালোচকদের মুখে ছাই দিয়ে সিনেমাটি সুপারহিট হয়। অনতিকাল পরে, ‘রাজবাহিনী’ নাম দিয়ে এর একটি স্পুফও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে গীতিকার স্পষ্ট বলে দেন, ‘সেলেব্রিটিরা ঝাঁটা হাতে/ পথ হাঁটে বিজেপি-র সাথে/ ইন্ডিয়া ছাতার মাথা।’ স্পুফ-টি সুজয় ঘোষের শর্টফিল্ম অহল্যার থেকেও বেশি হিট হয়।

পরদার বাইরে বাস্তব পৃথিবীতেও নানা অলৌকিক কাণ্ড ঘটতে থাকে। প্রাক্তন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য এবং প্রাক্তন কবি সুবোধ সরকারকে কলকাতার রাস্তায় একই সঙ্গে দাঁড়িয়ে গোমাংস ভক্ষণ করতে দেখা যায়। এ রকম দৃশ্য কলকাতার রাস্তায় ১৯০৫ সালের রাখিবন্ধনের পর আর দেখা যায়নি। এক বিজেপি নেতা একে ব্যঙ্গ করে ‘মোদীর ঠেলায় বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খাওয়া’ আখ্যা দিলেও সে সব কথায় কেউ কান দেয় না। কারণ তত দিনে ভারতের পূর্ব দিকের রাজ্য বিহারে সবচেয়ে বড় অলৌকিক কাণ্ডটি ঘটিয়ে দেন লালুপ্রসাদ যাদব এবং নীতীশ কুমার। বছরের শেষের দিকের এই নির্বাচনে দেখা যায়, বাঘ ও গরুতে এক হলে ‘আচ্ছে দিন’ সত্যিই বুরা হয়ে যেতে পারে।

এই নির্বাচনে জয়ের পর, পটনায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে তুখড় ব্যঙ্গ খেলিয়ে নীতীশ বলে দেন, ‘গরুরা লালুর সঙ্গে লড়তে এলে না খেয়ে মরবে। পশুখাদ্যে ওর কপিরাইট আছে।’ লালু আর এক ধাপ এগিয়ে বলেন, ‘আগে অপরাধীদের তিহাড়ে শাস্তি হত, এখন বিহারে হয়।’

লালুর উইট চিরকালই সর্বজনবিদিত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে এসে লালু বলেছিলেন, ‘হম নে যাদবোকে লিয়ে ক্যা কিয়া, বাসুজি নে এক ইউনিভার্সিটি হি বনা দিয়া, উস কা নাম হ্যায় যাদবপুর।’ কথিত আছে একদা আমেরিকার প্রখ্যাত টিভি ব্যক্তিত্ব জয় বেহারের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনায় লালু বলেন, ‘তুম ভি বিহারি হো, ম্যায় ভি।’ এ সব নিয়ে ইতিপূর্বে মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমে হাসির হুল্লোড় এর আগেও হয়েছে, কিন্তু বিহার-কাণ্ডের পর তাঁর চোখা মন্তব্যগুলিকে আপামর ভারতবাসীই সিরিয়াসলি নিতে শুরু করেন।

এই ঝড় ওঠায় আনন্দ পেলেও অন্যান্য বিরোধী নেতাদের আচরণ অবশ্য তুলনায় সংযত থাকে। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিহার নির্বাচনের খবর পেয়েই সংক্ষেপে মন্তব্য করেন, ‘পেড ব্যাক ইন হিজ ওন কয়েন।’ অন্য দিকে মমতা নির্বাচনোত্তর পর্বে তারকাখচিত চলচ্চিত্র উৎসবের রিহার্সাল রুমেই দিনের অধিকাংশ সময় কাটানোয় সরাসরি মন্তব্য এড়িয়ে যান। যদিও টিভি ক্যামেরার মাইক্রোফোনে ধরা পড়ে রিহার্সাল রুমের ভিতরে তাঁর উল্লসিত আনন্দধ্বনি। ‘ওদের একটা মোদী আছে’— স্থানীয় টিভি চ্যানেলে শোনা যায়, মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘আমাদের অনেকগুলো। চলচ্চিত্রমোদী, শিল্পমোদী, নৃত্যমোদী। দেব, একটু নাচো তো।’

তবে, এত কিছুর পরেও দিনের শেষে দেখা যায়, শেষ দান এখনও মোদীরই হাতে। তিনি এমনি এমনি আপামর ভারতবাসীর চোখের মণি নন। ব্যাপারটা জানা যায় ঘটনাচক্রে। মোদীর লন্ডন সফর চলাকালীন, অভাবনীয় হলেও সত্যি, দেখা যায়, নিউ ইয়র্কের একটি পুজো স্যুভেনিরে (বিদেশে যখন-তখন পুজো হয়) স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি কবিতা লিখেছেন— ‘আমাদের ছোট মোদী চলে আঁকে বাঁকে/ অঘ্রান মাসে তার ব্যাডলাক থাকে/ পার হয়ে যায় লালু নীতীশের ঘোড়া/ ঘাট থেকে উঠে এসে লাথি মারে মড়া।’ হইচই শুরু হবার পর অবশ্য স্যুভেনিরের সম্পাদক ফেসবুকে একটি মন্তব্য করে জানান, কবির নামটি মুদ্রণপ্রমাদ। ওটি লালকৃষ্ণ আডবাণীর লেখা। বাংলা পুজোর স্যুভেনিরে হঠাৎ আডবাণীর লেখা কেন? নানা সূত্রে জানা যায়, বঙ্গের খ্যাতনামা কবিরা আদি ও নব কৃত্তিবাস নিয়ে চুলোচুলিতে ব্যস্ত থাকায় সব সম্পাদকদেরই ফাঁক ভরাট করতে হচ্ছে অ্যামেচারদের দিয়ে। কেউ আন্দাজ করতে না পারলেও, এই আপাত তুচ্ছ ঘটনাটির মধ্যেই লুকিয়ে ছিল মোদীর জনমোহিনী ব্রহ্মাস্ত্র নির্মাণের স্ট্র্যাটেজি। বিষয়টি চূড়ান্ত গোপন হওয়ায় এর বিশদ বিবরণ অমিল। তবে মোদী শিবিরের এক মুখপাত্র, নাম উল্লেখ না করার শর্তে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ এবং জীবনানন্দের একচেটিয়া আধিপত্য শেষ করে এই প্রথম আলোচ্য তালিকায় এক নম্বরে উঠে এসেছে কবি কৃত্তিবাসের নাম। এটা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।’ বিশদ জানা না গেলেও এটুকু স্পষ্ট বোঝা যায়, মোদীযুগ এখনও শেষ হয়নি, এবং রামায়ণের জনপ্রিয় লেখক কৃত্তিবাস যদি আসেন, রাম তো আর দূরে থাকতে পারেন না, তাই লোকায়ত রামকে ঘিরেই গড়ে উঠতে চলেছে মোদীর ২০১৬-র তুরুপের টেক্কা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement