ক্ষমতালোভী নায়কের লাইব্রেরিতে রবীন্দ্রনাথ

আর তার সুটকেসে জেমস জয়েস। পাসোলিনি তাঁর অসমাপ্ত উপন্যাসে এ ভাবেই মিলিয়ে দিয়েছিলেন দুই পৃথিবীকে। রাহুল দাশগুপ্তমনে ছিল গভীর হাহাকার। ফ্যাসিজ়ম-বিরোধী পাসোলিনি বড় হয়েছিলেন শেক্‌সপিয়র আর দস্তয়েভস্কি পড়ে। দেখেছিলেন চার্লি চ্যাপলিন, সের্গেই আইজ়েনস্টাইন, আলফ্রেড হিচককের ছবি। সিনেমা-মাধ্যমের প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ তৈরি হয়েছিল এ ভাবেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০৩
Share:

সৃজনশিল্পী: পিয়ের পাওলো পাসোলিনি। ছবি: গেটি ইমেজেস

একটি উপন্যাস লিখতে চেয়েছি আমি।...সেখানে মিলেমিশে গেছে প্রবন্ধ, সাংবাদিকতা, রিভিউ, চিঠি, এমনকি কবিতাও’— বন্ধু ও লেখক আলবার্তো মোরাভিয়াকে লেখা একটি চিঠিতে এ ভাবেই নিজের অসমাপ্ত উপন্যাস সম্পর্কে জানিয়েছিলেন পরিচালক পিয়ের পাওলো পাসোলিনি। এই চিঠি পাঠানোর আগেই অবশ্য পাসোলিনি নিহত হন।

Advertisement

১৯৭৫ সালের গোড়ার দিকে এক সাক্ষাৎকারে পাসোলিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি এমন একটা বই লেখা শুরু করেছি যা শেষ করতে হয়তো আমার বাকি জীবনটাই কেটে যাবে।’’ সেই সময়কার বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও চিঠি থেকে জানা যায়, দু’হাজার পৃষ্ঠার একটি উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর রোমের কাছে এক সমুদ্রতীরে পাসোলিনিকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় তাঁরই গাড়ির নীচে কয়েকবার পিষ্ট করে। তখন তাঁর বয়স তিপ্পান্ন। মৃত্যুর কয়েকদিন পর তাঁর ডেস্কে একটি ফোল্ডারের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিটি। মোট ৫২১ পৃষ্ঠা লিখেছিলেন পাসোলিনি। বেশির ভাগটাই টাইপ করা, অল্প কিছু পৃষ্ঠা হাতে লেখা। টাইপ করা পৃষ্ঠাগুলোর পাশে পাশে ছিল হাতে লেখা বহু সংশোধন ও সংযোজন। ব্যবহার করা হয়েছিল নীল, কালো, লাল কালির কলম। এই উপন্যাসের নামও দিয়েছিলেন তিনি— ‘পেট্রোলিও’।

উপন্যাসের নায়কের নাম কার্লো। সে পেশায় এক জন অয়েল এগজ়িকিউটিভ। তার ব্যক্তিত্বে দুটি সত্তা। একটি সত্তা অসম্ভব ক্ষমতালোভী, অন্য সত্তাটির যৌনক্ষুধা অনন্ত। যখন তখন শরীর বদলাতে পারে সে। হয়ে যেতে পারে নারীও। গল্পের কথকও দু’টি আলাদা সত্তায় বিভক্ত। কখনও সে লেখক হয়ে কাহিনিতে ঢুকে পড়ে, গল্প তৈরি নিয়ে মন্তব্য করে, আবার পাঠের অর্থও বোঝায়। কখনও আবার সে অদৃশ্য! সরাসরি পাঠকদের উদ্দেশে কথা বলে।

Advertisement

‘পেট্রোলিও’র কাহিনি শুরু ১৯৬০ সালের মে মাসের এক সকালে। পাঁচতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কার্লো ভ্যালেত্তি দেখে, তার নিজের মৃতদেহ তারই পায়ের তলায় পড়ে আছে। তার পর সেই মৃতদেহ বেঁচে ওঠে, একটি শিশুর রূপ নেয়। শিশুটি বড় হয়, কৈশোর-যৌবন পেরিয়ে হয়ে ওঠে আর-এক জন কার্লো। যেন দুই পুরনো বন্ধু তারা, একটাই জীবন ভাগাভাগি করে নিতে চাইছে— অংশ নিতে চাইছে একই কমেডিতে।

কার্লোর সম্পর্কে একটু-একটু করে জানতে পারেন পাঠক। তার জন্ম তুরিন শহরে, তবে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে রাভেন্না শহরে। তাকে সব সময় অনুসরণ করে পাসকুয়াল নামে একটি লোক। কার্লোর স্যুটকেসে সব সময় যত্ন করে রাখা থাকে ‘দন কিহোতে’, ‘ট্রিসট্রাম শ্যান্ডি’, ‘ডেড সোলস’, ‘ইউলিসিস’ এবং ‘ফিনেগানস ওয়েক’— এই পাঁচটি বই। আর তার লাইব্রেরিতে হাতের কাছেই থাকে দস্তয়েভস্কির ‘দ্য পজ়েসড’ আর ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’, দান্তের ‘দিভাইনা কম্মেদিয়া’ এবং মারকুইস দ্য সাদ-এর রচনাবলি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার বইও আছে তার সংগ্রহে।

কার্লোর চোখ দিয়ে নানা ধরনের বুদ্ধিজীবীর কৌতুকময় বর্ণনা দিয়েছেন পাসোলিনি। এঁরা সকলেই খুব অস্থির। কেউ খ্যাতির ভার সইতে পারছেন না, কেউ বুদ্ধিমত্তার ভারে নাজেহাল। ক্ষমতার জগৎকেও নানা ভাবে দেখেছেন পাসোলিনি। প্রতিদিন বিকেলে দুই কার্লোর সাক্ষাৎ হয়। তারা বালজ়াক ও দস্তয়েভস্কির নায়কদের সম্পর্কে কথা বলে, যাদের মধ্যে একই সঙ্গে রয়েছে মহত্ত্ব ও অপরাধ করার ক্ষমতা। তাদের মনে হয়, রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং শারীরিক ক্ষমতা আসলে এক। তাদের যৌনতার ধারণা শরীর পেরিয়ে পৌঁছয় সংস্কৃতিতে।

পাসোলিনি লিখেছেন, কার্লো নিজের অস্তিত্বকে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অনুভব করতে চায়। রোজ সকালে উঠে সে ভাবে, গতকাল রাতে কী কী ঘটেছিল। যৌনতা ও ক্ষমতার দুনিয়া থেকে বেরিয়ে কার্লো এক দিন স্বপ্ন দেখে, সে একটা গির্জার মধ্যে রয়েছে, যেখানে যাজকেরা গান গাইছে। যদিও ঈশ্বরের চেয়েও অনেক বেশি বার তার সঙ্গে দেখা হয় শয়তানের। সমস্ত স্ট্যাচুর দিকে তাকিয়ে তার হাসি পায়। জনতাকে মনে হয় মৃত মানুষের সমষ্টি। জীবনের সমস্ত মুখ এবং বস্তুকেই দেখায় প্রশ্নচিহ্নের মতো।

পাসোলিনির মৃত্যুর সতেরো বছর পর তাঁর এই অসমাপ্ত উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। এর কাহিনির ভেতরে ভেতরে ঢুকে গিয়েছে ইতিহাস সংস্কৃতি ও সমকাল নিয়ে নানা আলোচনা, কখনও বা কল্পবিজ্ঞান। পাসোলিনি নিজেই বলেছেন, ‘‘কাহিনি লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি চেয়েছি একটা ফর্মকে তৈরি করতে।’’ এই উপন্যাসটি দীর্ঘ দিন পাসোলিনির পরিবার ছাপতে চায়নি।

পাসোলিনির কৈশোর ও যৌবন কেটেছে ইটালির এক চরম সঙ্কটের সময়ে। তাঁর জন্ম ১৯২২ সালের ৬ মার্চ, ইতালির বোলোনায়। বাবা ছিলেন ফ্যাসিস্ট, আর মা চরম মুসোলিনি-বিরোধী। মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থান ও ক্রমে পতন, দুই-ই দেখেছিলেন তিনি। যুদ্ধ-পরবর্তী ইটালিতে শুরু হয় দেশ পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া। দলে দলে কৃষক উদ্বাস্তু হয়ে ছুটে আসতে থাকে শহরের দিকে। বিধ্বস্ত দেশের প্রতি পাসোলিনির মনে ছিল গভীর সমবেদনা। আর হারিয়ে যাওয়া কৃষক-সংস্কৃতির জন্য

মনে ছিল গভীর হাহাকার। ফ্যাসিজ়ম-বিরোধী পাসোলিনি বড় হয়েছিলেন শেক্‌সপিয়র আর দস্তয়েভস্কি পড়ে। দেখেছিলেন চার্লি চ্যাপলিন, সের্গেই আইজ়েনস্টাইন, আলফ্রেড হিচককের ছবি। সিনেমা-মাধ্যমের প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ তৈরি হয়েছিল এ ভাবেই।

কবি পাসোলিনি সম্পর্কে ক’জনই বা জানেন? মোরাভিয়ার মতে, পাসোলিনি বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইটালীয় কবি’! মৃত্যু, রাজনীতি ও যৌনতা হয়ে ওঠে পাসোলিনির কবিতার প্রধান বিষয়। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘রাগাজ্জি দি ভিটা’। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় উপন্যাস ‘আ ভায়োলেন্ট লাইফ’। দু’টি উপন্যাসেই আছে যুদ্ধ-পরবর্তী রোমের অমানবিক দারিদ্রের বর্ণনা; ক্ষুধা, চুরি, অপরাধ, বিশ্বাসঘাতকতা, বেশ্যাবৃত্তি, কালোবাজারি, শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতার প্রতিচ্ছবি।

তাঁর অসমাপ্ত উপন্যাস ‘পেট্রোলিও’-তে বাস্তবকে চিহ্ন ও প্রতীকের মাধ্যমে ধরতে চেয়েছিলেন পাসোলিনি। লেখক ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে যে সম্পর্ক, খুঁজতে চেয়েছেন তার অর্থ। সৃষ্টি করতে চেয়েছেন এমন এক ‘বিশৃঙ্খলা’, যা রহস্যময় হলেও তার ভিতরে আছে এক ধরনের অনুশাসন। এমন সব চরিত্র সৃষ্টি করতে চেয়েছেন যারা অস্থির, শূন্যগর্ভ, উন্মাদ। লিখেছিলেন, ‘নিজের সৃষ্টির ভিতর আমি নিজের সমাধি রচনা করতে চেয়েছি।’

তাঁর উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কার্লোও শেষে সব কোলাহল ও নাগরিকতা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। ঠাঁই নেয় নিঃসঙ্গ মগ্নতার জীবনে। স্বপ্নই যেখানে তার একমাত্র সঙ্গী, যেখানে তার কোনও অতীত বা অনুতাপ নেই। কার্লোর স্বপ্নে মাঝে মাঝেই আসে এক জন বোবা লোক। সে ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেই লোকটি কথা বলতে শুরু করে তারই কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে। কার্লোর তখন মনে পড়ে ফ্রয়েডকে, ‘স্বপ্নে দেখা বধিরতা আসলে মৃত্যুরই প্রতিনিধি।’

কে জানে, নিজের হাতে গড়া চরিত্রের মধ্য দিয়ে পাসোলিনি নিজের আসন্ন মৃত্যুর ইশারাই দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কি না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন