বাবার প্রোমোশনের কারণে এই ছোট্ট মফস্সল শহরটাতে তারা চলে এল। তিতাসের তো চোেখ জল চলে এল স্টেশনে নেমেই। কলকাতা থেকে পাক্কা পাঁচ ঘণ্টা। কুলি ডেকে জিনিসপত্র তুলে সবাই রিকশায় উঠল। বেশ বড় একটা স্কুল ছাড়িয়ে যেখানে তারা পৌঁছল, সেটা একটা দোতলা বাড়ি। বয়স্ক এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, ‘আসুন রজতবাবু।’
নীচের তলার ঘরে একটাই চৌকি। এটাই তা হলে বাবার তিন মাস কাটিয়ে দেওয়া আবাস!
জানলাগুলো খুলছিলেন ভদ্রলোক। ‘বউমা, আমি ওপরে থাকি। অসুবিধে হলে, দ্বিধা না করে জানাবে। আর মাসিমা, আমার মা-ও আছেন। আর হ্যাঁ রজত, এ বেলায় তোমরা আমাদের সঙ্গে খাবে। কড়া হুকুম তোমার বউদির।’
‘কী দরকার ছিল দাদা? আমি তো...’
‘সামান্য ডাল-ভাত খাবে, আপত্তি কীসের?’ মায়ের কথা শেষের আগেই চা নিয়ে যিনি এলেন, বাবা তাঁকে দেখেই বললেন, ‘চা-টার বড্ড প্রয়োজন ছিল। বউদি, বুঝতেই পারছেন এদের।’ মায়ের সঙ্গে হাসি বিনিময়। টুকটাক কথা হল দু’জনের মধ্যে। তার পর ঠাম্মাকে প্রণাম করে তিনি বললেন, ‘তিতাস তো তুমি? দু’জন বন্ধু পাবে এখানে। আমি তোমার জেঠিমা।’
পাড়াটার নাম সুভাষপল্লি। প্রচুর গাছ। তিতাস বাগানটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল। প্রচুর গাঁদা ফুল ফুটেছে। তখনই ও আশ্চর্য হল। একটা কুল গাছ! ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে! তিতাস কয়েকটা কুল তুলে নিতে যেই এগিয়েছে, অমনি ‘সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেতে নেই, জানো না তুমি?’ বলল গোলগাল বাচ্চা ছেলেটা।
‘খাইনি তো।’ লজ্জিত তিতাস।
‘এ দিকে এসো। মা ওপরে ডাকছেন।’
ওর সঙ্গে ওপরে এল তিতাস। সেখানে তখন লুচি, বেগুনভাজা প্লেটে প্লেটে সাজানো। ঠাম্মা সমবয়সি একজনার সঙ্গে গল্পে মত্ত। রান্নাঘরে মা লুচি বেলছেন। বাবা ইতিমধ্যে খেতে শুরু করে দিয়েছেন। পাশে বসে আছে তারই বয়সি একটা ছেলে। আড়চোখে তাকে দেখে সে বলে, ‘ভাই, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, অনেক কাজ আছে।’
‘এখুনি গিয়ে কাদামাটি নিয়ে বসবে না। তিতাস, এরা দু’জন তোমার বন্ধু, বুঝলে? বুম্বা আর গাবলু। লুচি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। শুরু করো।’
মা, ঠাম্মা নীচে চলে গেছে। জিনিসপত্র গোছগাছ চলছে। বাইরে থেকে একটা খাট এল। টেবিল চেয়ার এবং আলনাও। এ সব এখানেই অর্ডার মাফিক তৈরি। মায়ের অসন্তোষ শুনতে পেল তিতাস। জামা প্যান্ট পালটে নিচ্ছিল ও।
‘এখানে সবাইকে টেনে আনার কী দরকার ছিল বলুন তো মা? শ্যামবাজারের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে, এখানে ভর্তি করা হল ছেলেকে। ‘স্ট্যান্ডার্ড’ বলেও তো একটা কথা আছে?’
মাকে সাপোর্ট করে এ বার বাবার উদ্দেশে ঠাম্মার পালা। ‘তুই শনিবার শনিবার কলকাতায় যেমন যেতিস, তেমনই চললে ক্ষতি কী ছিল? তিতুর কিন্তু ডিমোশন হল।’
ঠাম্মা সে কালের ইংলিশে এমএ। সুতরাং, এ সব কথা বলবার তাঁর হক আছে।
চেয়ারে বসে কাগজ পড়ছিলেন বাবা। ‘তোমরা ফালতু চিন্তা করছ। তিতুর এখন ক্লাস ফাইভ। আর এখানকার স্কুল বেশ নামী, দেখো না! জায়গাটায় থাকো। ভাল লাগবে আলবাত। পলিউশন-ফ্রি, ফ্রেশ এয়ার, এনজয় করো।’
তিতাস ছাদে চলে এল। চমকের পর চমক সেখানে অপেক্ষা করছিল। মন দিয়ে ঠাকুর তৈরি করছিল বুম্বা। গাবলু জোগাড়ে। হাত দুয়েকের মূর্তি। হাঁসের পিঠে বসে আছেন সরস্বতী।
‘এসো। দাদান এ নিয়ে তিন বছর ঠাকুর তৈরি করছে। মুখের ছাঁচ বাদে সবটা ওর তৈরি।’
‘তুই থামবি? শুধু বকবক। জল নিয়ে আয়।’ ভাইকে ধমক দেয় বুম্বা। বেশ লাগছিল তিতাসের। বিস্ময়ে হতবাকও হয়ে যাচ্ছিল। কলকাতায় কুমোরটুলি থেকে ফি বছর সে বাবার সঙ্গে গিয়ে ঠাকুর নিয়ে আসে। কিন্তু, তারই বয়সি একটা ছেলে প্রতিমা তৈরি করছে, এ হেন বিরল ঘটনা তার জীবনে প্রথম।
দিন তো আর বসে থাকে না। তিতাসও স্কুলে যায় বুম্বা আর গাবলুর সঙ্গে। বুম্বার ক্লাস সিক্স। আর গাবলুর থ্রি। ওর অজান্তেই কখন যেন গাবলু আর বুম্বা তার গাইড হয়ে গিয়েছে।
আজ বাদে কাল পুজো। এখন ছাদে যাওয়া বারণ। বুম্বার কড়া নির্দেশ। অতএব গাবলুই তিতাসের সারাদিনের সঙ্গী।
পুজোর ঠিক আগের দিন তিন্নিদিদি চলে এল বেড়াতে। জেঠুর মেয়ে তিন্নিদিদি কলেজে পড়ে। ভয়-ডর নেই। একা একাই চলে এল সবাইকে অবাক করে দিয়ে।
বাবার ব্যাঙ্ক একটু দূরে। ম্যানেজার হয়ে এসেছেন বলে তার ব্যস্ততা তুঙ্গে। সকালে বেরিয়ে যান। সন্ধে হয়ে যায় ফিরতে ফিরতে। মাসকাবারি রিকশা ঠিক করা আছে। রহিমকাকুর রিকশা। তিতাস, গাবলু আর তিন্নিদিদি পুজোর আগের দিন গোটা শহরটা ঠিক দু’ঘণ্টায় চক্কর মেরে এল রিকশার সওয়ারি হয়ে।
‘তোদের পুঁচকে শহরটা হেব্বি রে তিতু, ঠিক গাবলুর মতো’— খিলখিল করে হাসছিল তিন্নিদিদি। ‘তোমাদের কলকাতা শহরের থেকে ঢের ভাল’— গাবলুর গম্ভীর উক্তি শুনে তিন্নিদিদির সঙ্গে সঙ্গে তিতাসের মুখেও হাসিটা ছড়িয়ে গেল।
‘তোদের গাছভর্তি কুল, খাস না গাবলু?’
‘পুজোর পর খাব।’
‘কেন যে এই সব ফালতু নিয়ম’, বলেই ফেলল তিতাস।
‘মেনে নে না। ক্ষতি কিছু নেই। সরস্বতীকে নিবেদন করা হয় তো, তাই বোধ হয় খেতে নেই। তাই বলে কি সবাই মানছে? না। কিন্তু, কিছু কিছু নিয়ম মানলে তৃপ্তি হয়। বড়রাও খুশি হন।’ তিন্নিদিদির কথাগুলো মন দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করছিল তিতাস।
‘কাল আসবে কিন্তু রহিমকাকা’, রিকশা থেকে নামতে নামতে গাবলু বলল।
‘সে আর বলতে? খিচুড়ি খাব না? আর বুম্বার বানানো ঠাকুরও দেখতে হবে।’
রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠেছিল। দ্রুত সন্ধে হয়ে আসছিল। জব্বর ঠান্ডা এ দিকে। মা সন্ধে দিচ্ছিল। ঘরে ঢুকতেই ঠাম্মার বকুনি, ‘তোর জ্ঞানগম্যি আর কবে হবে রে তিন্নি? নতুন জায়গা। ছেলে দুটোকে নিয়ে সেই যে বেরিয়েছিস...’
‘আরে বাবা, রহিমকাকু তো ছিল’, ওপরে গটগট করে চলে যেতে যেতে গাবলুর জবাব। মা আর ঠাম্মা শুনে হেসে অস্থির।
ওপর থেকে জেঠিমা একগাদা রংচঙে কাপড় নিয়ে নামলেন। ‘তিন্নি, যা হোক কিছু সাজা। আর এই রঙিন কাগজগুলো আছে, তোরা বসে বসে শিকলি বানা। বারান্দায় এক কোনায় আয়োজন কর। এ বার আমার ছুটি। সব ভার তিন্নির ওপর।’
রাতের খাওয়া শুরু হওয়ার আগেই দুর্দান্ত সাজিয়ে ফেলল তিন্নিদিদি। গাবলু আর তিতাস শিকলি করেছিল অনেক। সেগুলো টাঙানো হল। তার পর, হঠাৎই উলুধ্বনি ভেসে এল। বুম্বা প্রতিমা নিয়ে নামছিল তখন। ছোট্ট টুলের ওপর বসানো হল সরস্বতীকে। চোখ ফেরাতে পারছিল না তিতাস। তিন্নিদিদির চোখে জল। ‘তুই বানিয়েছিস বুম্বা! একা একা? উফ, আমি যে ভাবতেই পারছি না!’
দুই ঠাম্মার আদরের ঠেলায় তখন বুম্বার
অবস্থা জেরবার।
খুব ভোরবেলায় পুজোয় বসেছেন জেঠু। তিতাসরা স্নান সেরে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে শীতে কাঁপছিল। নৈবেদ্য, ধূপের ধোঁয়া, প্রদীপের আলোয় জমাটি পুজোর চবুতরা। শাঁখ বাজাচ্ছিলেন জেঠিমা। ধ্যানমগ্ন জেঠু। বাবা দোকান থেকে মিষ্টি কিনে ফিরলেন সবে।
অনেক ক্ষণ পর জেঠু উঠে দাঁড়ালেন। আরতি করলেন। তার পর উদাত্ত গলায় ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ আবৃত্তি করলেন। আবৃত্তি শেষ হতেই জেঠিমার গলায় ভেসে এল ‘মধুর মধুর ধ্বনি বাজে’। মা ঠাম্মাকে বিস্মিত করছিল এই অন্য রকমের পুজো। জেঠিমার চোখ বোজা। তাঁর দ্বিতীয় নিবেদন তখন ধ্বনিত হচ্ছে। সুরের মূর্ছনায় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। ‘মন্দিরে মম কে আসিলে হে’... শেষ হতেই তিন্নিদিদি আর থাকতে পারল না। কলকাতার নামী গানের স্কুলের ছাত্রীর গলায় তখন ‘আলোকের এই ঝরনাধারায় ধুইয়ে দাও’ শুনে মুগ্ধ সবাই।
জেঠু সবার হাতে ফুল বেলপাতা দিলেন। পুষ্পাঞ্জলি হল নিয়মমাফিক। ঠাম্মার চোখে জল। বিড়বিড় করে বললেন, ‘আমার এতখানি বয়স হল, এ রকম
পুজো দেখিনি। জীবন আমার ধন্য হল।’ ঠাম্মাকে প্রণাম করে জেঠু বললেন, ‘গান-বাজনার দেবীকে আমি এ ভাবেই আরাধনা করি, মাসিমা।’
ঠিক তখনই রহিমকাকু রিকশা নিয়ে হাজির। রিকশা থেকে নেমে ভেতরে এল এক জন অল্পবয়সি মেয়ে। কোলে তার একটা বাচ্চা ছেলে।
জেঠিমা বললেন, ‘আয় ফতিমা। এত দেরি করলি যে?’
‘এই দেখো না ছেলের কাণ্ড।
সে গাবলুদাদার মতো ধুতি না পরে আসবে না। ওর বাবা রাতে নিয়ে এল এই ধুতিপাঞ্জাবি। চানটান সেরে উনি সাজুগুজু করে তবে এলেন।’
গাবলুর থেকেও পুঁচকে একটা বাচ্চা। বাসন্তী রঙের ধুতি-পাঞ্জাবি পরেছে।
কপালে একটা কাজলের টিপ। দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে সদ্য কেনা একটা স্লেট-চক আর ‘আদর্শলিপি’। এই দেখে সবাই তখন আনন্দে বিহ্বল।
এক বাক্স মিষ্টি জেঠিমার হাতে দিয়ে রহিমকাকা জেঠুকে বলল, ‘দাদা, ছেলেটার একটু হাতেখড়ি দিয়ে দাও।’
ওর নাম পলাশ। জেঠুর কোলে বসে স্লেটে দিব্যি অ-আ-ক-খ লিখে ফেলল। ওর কপালে স্নেহচুম্বন এঁকে দিলেন জেঠু।
শাঁখের আওয়াজ, উলুধ্বনির মাঝে তিন্নিদিদি তখন গান ধরেছে ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে...’
শীতের রোদ এসে বারান্দায় লুটোপুটি খাচ্ছে। ঠান্ডায় হিহি করে কাঁপছিল পলাশ। গান থামিয়ে তিন্নিদিদি নিজের বাহারি চাদরটা ঘর থেকে এনে ওর গায়ে জড়িয়ে দিল। তিতাস স্পষ্ট দেখল, এই আনন্দের মুহূর্তে সরস্বতী ঠাকুরের মুখটাও বেশ হাসিখুশি। গাবলু তিতাসের কানে কানে বলল, ‘পুজো শেষ। চল, কুল খেয়ে আসি।’