কুকির আজকাল বেশ মন খারাপ। তা মন খারাপের কারণ আছে বটে। ওর ছোট ভাইটা হওয়ার পর থেকে মা-বাবা আর মোটেই কুকিকে ভালবাসছেন না! যত ভালবাসা ওই পুঁচকে মোমোটার জন্যে! ওদের সব সময় ওর পিছনেই চলে যায়! কুকি বুঝতে পারে না কী করে সেটা হচ্ছে? মোমো না পারে হাঁটতে, না পারে কথা বলতে। শুধু শুয়ে শুয়ে দুধ খায় আর খিদে পেলে তারস্বরে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করে! ওইটুকুনি শরীর, কিন্তু গলায় কী জোর রে বাবা!
আগে মা কুকিকে স্কুলে যাওয়ার সময় বাস স্টপে ছেড়ে দিয়ে আসতেন আর বিকেলবেলা ফেরার সময় নিয়ে আসতেন। এখন কুকি একাই যায়, নয়তো মাঝে মাঝে রাধামাসি আসে, মা আর আসেন না। আগে মা কুকিকে জামাকাপড় ছাড়িয়ে খাইয়ে দিতেন এখন সেই সব কাজ তাকে নিজেই করতে হয়! মা যদি মোমোর কাছ ছেড়ে এক বারটি আসেন তা হলেই হয়ে গেল! একেবারে পরিত্রাহি চিৎকার শুরু করে দেবে খুদে বিচ্ছু!
কুকিকে হোমওয়ার্ক করিয়ে দেয়ারও কেউ নেই এখন। আগে মা-বাবা করিয়ে দিতেন, কিন্তু এখন তাঁরা খুব ব্যস্ত মোমোকে নিয়ে! সে দিন যেমন অঙ্কের টিচার অনেকগুলো অঙ্ক দিয়েছিলেন হোমওয়ার্কে। কী করে করতে হয় অঙ্কগুলো কুকি তেমন বুঝতেই পারেনি ক্লাসে। মাকে জিজ্ঞেস করতে মা বললেন, ‘ক্লাসে যখন মিস করাচ্ছিলেন তখন তুমি কী করছিলে? মন দাওনি কেন? যাও এ বার যা হোক করে নিজে নিজেই করার চেষ্টা করো! মোমোর শরীরটা আজকে ভাল নেই, সকাল থেকেই কাঁদছে!’
মা’র কথা শুনে চোেখ জল এল কুকির! সে ক্লাসে মন দিয়েই শুেনছিল, বুঝতে না পারলে কী করা যাবে?
কী আর করবে বেচারা যা বুঝেছে তাই দিয়েই অঙ্কগুলো করল আর সব ভুল হল! মিস লাল কালি দিয়ে কেটে দিলেন আর ‘ভেরি পুওর’ লিখে দিলেন! এ রকমটা আগে কখনও হয়নি ওর!
তাও সব সহ্য করছিল কুকি। কিন্তু বার্ষিক উৎসব নিয়েই গণ্ডগোলটা হয়ে গেল! ওদের স্কুলের প্রতিষ্ঠার দিন স্কুলের বার্ষিক উৎসব হয়। প্রতি বছর ওই দিন খুব ঘটা করে ফাংশন হয় স্কুলে। কুকিদের ক্লাস থেকে এ বার ‘রাজকন্যা নিখোঁজ’ নাটকটা হচ্ছে। কুকি লাল পরি হয়েছে আর মিশা নীল পরি। অনেক দিন ধরে রিহার্সাল চলছে। যারা যারা পরি হচ্ছে মিস তাদের সবাইকে সেই রঙের একটা সুন্দর জামা আনতে বলেছিলেন। কুকির কোনও পরি সাজার মতন সুন্দর লাল জামা নেই। সেটা মাকে বলতে মা বললেন, ‘দেখো কুকি এখন তোমার জন্যে জামা কেনা যাবে না। আমার বা তোমার বাবার কারও সময় নেই জামা কিনতে বাজারে যাওয়ার। তোমার তো সুন্দর হলুদ জামা আছে, তুমি বরং মিসকে বলো তোমাকে হলুদ পরি করে দিতে!’
‘বা রে, আমি তো লাল পরির সব কথা মুখস্থ করে ফেলেছি! আর হলুদ পরি তো তৃতি হচ্ছে। ও তো কবে হলুদ জামা এনে মিসকে দেখিয়ে দিয়েছে! মিস মোটেই ওকে লাল পরি করতে রাজি হবেন না!’
‘জানি না বাবা, তুমি মিসকে বলো তোমার লাল জামা নেই তাই অন্য ব্যবস্থা করতে!’
এর পর আর কোনও কথা হল না। কারণ, মোমো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে শুরু করে দিল।
পর দিন স্কুল-বাসে করে যেতে যেতে কুকি দুখী দুখী মুখে মিশাকে বলল সব কথা।
শুনে মিশা বলল, ‘ও এই ব্যাপার! তা আগে বলবি তো! আমার কাছে একখানা সুন্দর লাল জামা আছে, কালকে নিয়ে আসব তুই সেটাই মিসকে দেখিয়ে দিস। তা হলেই সমস্যা মিটে যাবে!’
শেষমেশ তাই হল। মিশার লাল জামাটা পরেই পার্টটা করবে কুকি।
বার্ষিক উৎসবের দিন মা বাবারা সবাই আমন্ত্রিত অনুষ্ঠান দেখতে। বাবা মা-তে স্কুল উপচে পড়ছে, কিন্তু কুকির মা বাবা আসতে পারেননি! ভীষণ ভীষণ রাগ হচ্ছিল কুকির! এই প্রথম সে স্কুলের নাটকে অংশগ্রহণ করছে আর তখনই মা বাবা কিনা আসতে পারলেন না! মা না আসতে পারুন, বাবা তো আসতে পারতেন কিন্তু বাবার অফিসে কাজ, বললেন, ‘না কুকি, এ বারটা হবে না। মোমোর জন্যে অলরেডি অনেক ছুটি নেওয়া হয়ে গিয়েছে আজ আর কিছুতেই তাড়াতাড়ি বেরনো যাবে না!’
আবার মোমো! সব ওই মোমোটার জন্যে হচ্ছে!
নাটক খুব সুন্দর হল। উপস্থিত সবাই খুব প্রশংসা করছিল। নাটক শেষ হওয়ার পর মেয়েরা যে যার মা বাবার কাছে বসতে চলে গেল। তখন কুকির মনে খুব কষ্ট হচ্ছিল। ওর জন্যে তো কেউ আসেনি! সে মিশার সঙ্গে তার মা বাবার কাছে গিয়েই বসল।
বিকেল ছ’টার সময় যখন অনুষ্ঠান শেষ হল, তখন মিশার বাবা-মা কুকিকে তাদের গাড়িতে করে বাড়ি নিয়ে চললেন। পিছনের সিটে বসা কুকি মিশাকে ফিসফিস করে বলল, ‘আমি যদি জাদু জানতাম তা হলে ওই মোমোটাকে না ভ্যানিশ করে দিতাম।’
ওর কথা শুনে মিশা চোখ গোলগোল করে বলল, ‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ, একেবারে ভ্যানিশ! তার পর দেখতাম কী হয়!’ বলে চোখ বন্ধ করে হাত দুটোকে শক্ত মুঠো করে কুকি আবার বলল, ‘ভ্যানিশ! ভ্যানিশ! ভ্যানিশ!’
আর বেশি কথা বলা গেল না বাড়ি এসে গেল বলে।
বেল বাজাতে রাধামাসি দরজা খুলে বলল, ‘এসে গেছ! কিছু খাবে?’
‘না, স্কুলে খেতে দিয়েছে।’
‘ঠিক আছে তা হলে তুমি হাত মুখ ধোও, জামাকাপড় ছাড়ো আমি এ বার বাড়ি যাই। আমি আসলে দরজা খুলতে হবে বলে অপেক্ষা করছিলাম। বউদি আর খোকাবাবু ঘুমোচ্ছে, বেশি শব্দ করো না যেন! দরজাটা বন্ধ করে দাও আর দাদাবাবু ফিরলে খুলে দিয়ো কেমন?’ বলে রাধামাসি চলে গেল।
কুকি জামাকাপড় ছেড়ে এসে দেখল মা নীচের ঘরের বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। আর একটু ভাল করে দেখতেই চমকে উঠল কুকি,
মা ঘুমোচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু মোমো তো নেই!
অ্যাঁ! কোথায় গেল মোমো? পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে এ দিক ও দিক দেখল কুকি। খাটের সর্বত্র দেখল, ঘরের চারিদিকেও, নাহ মোমো কোথাও নেই! মোমো তো আর
হাঁটতে পারে না যে নিজে নিজে কোথাও চলে যাবে!
এ বার ভীষণ ঘাবড়ে গেল কুকি! মোমোর কী হল? কোথায় গেল সে? হঠাৎ ওর মনে হল এ বাবা সে যে গাড়িতে বসে ভ্যানিশ ভ্যানিশ বলেছিল, সেটাই লেগে গেল না তো? এক বারের জন্যে বেশ মজা পেল কুকি কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল মোমো সত্যি সত্যি ভ্যানিশ হয়ে গেলে তো খুব মুশকিল হয়ে যাবে! তা ছাড়া ওটা তো ও রাগের মাথায় বলেছিল, সত্যি সত্যি যে কিছু হয়ে যেত পারে, সেটা তো সে কল্পনাও করতে পারেনি!
মোমোর ফর্সা লালচে মিষ্টি মুখটা মনে পড়ে গেল কুকির! কুকি ওর কাছে গিয়ে কথা বললেই চোখ গোল গোল করে ওর দিকে তাকিয়ে দেখে। ছোট্ট ছোট্ট আঙুলগুলো মুঠি করে আর পা শূন্যে তোলে! মা বাবা ওর নাটক দেখতে যাননি, তাতে মোমো বেচারার তো দোষ নেই। সে তো কিছুই বোঝে না! বাবার অফিসে কাজ বেশি তাতে মোমো কী করবে? তা ছাড়া কুকি তো এখন সত্যি বড় হয়ে গেছে, সে তো নিজের কাজ নিজেই করতে পারে!
জুনাদিদির ভাইটা কী সুন্দর ওকে ‘দিদি, দিদি’ বলে ডেকে ওর পিছন পিছন ঘোরে! একটু বড় হলে মোমোও তো কুকিকে ‘দিদি’ বলে ডাকবে আর ওর সব কথা শুনবে! মিশাকে তো ‘দিদি’ বলে ডাকারও কেউ নেই! না, না, কুকি সত্যি সত্যি মোমোকে ভ্যানিশ করে দিতে চায়নি।
মাকে ঘুম থেকে ডাকতেও সাহস হল না কুকির। কী করবে কিছুই বুঝতে না পেরে সে এ বার মোমোর হারিয়ে যাওয়ার দুঃখে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল!
একটু পরে দরজায় বেল শুনে কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে দরজা খুলল কুকি। বাবা বাড়ি ফিরেছেন অফিস থেকে।
ওকে অমন করে কাঁদতে দেখে বাবা বললেন, ‘কী হয়েছে কুকি কাঁদছ কেন?’
‘বাবা, মোমোকে পাওয়া যাচ্ছে না!’
বাবাও ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন, ‘সে কী!’
‘আমি আর কখনও ওই রকম বলব না বাবা! মোমো ফিরে এলে ওর উপর আর রাগ করব না কখনও! তুমি মোমোকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো!’
ঠিক তক্ষুনি কুকির কান্না ছাপিয়ে মোমোর চিলচিৎকার শোনা গেল!
চমকে পিছন ফিরে তাকিয়ে কুকি দেখল দিদা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। দিদার কোলে মোমো, আর তার মনে হয় খিদে পেয়েছে তাই সে মনের সুখে চেঁচাচ্ছে! রাধামাসি বাড়ি ফেরার তাড়ায় কুকিকে এটা বলতে ভুলে গেছে যে দিদা এসেছেন!
দিদা ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘আমি ছাদের ঘরে মোমোকে নিয়ে বসেছিলাম। মিত্রা খুব ক্লান্ত ছিল তাই ওকে বললাম একটু ঘুমিয়ে নিতে। মোমোকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে কখন নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়ালই নেই। যাই দুধটা গরম করে নিয়ে আসি না হলে এ তো পাড়া মাথায় করবে! তুমি কেঁদো না দিদি, তোমার ভাইটি হারিয়ে যায়নি!’
বলে দিদা মোমোকে খাটে নামিয়ে দুধ আনতে চলে গেলেন।
কুকি মোমোর কাছে গিয়ে যেই না বলল, ‘এই মোমো কাঁদিস না, দিদা দুধ নিয়ে আসছেন!’ অমনি সে কান্না থামিয়ে হাঁ করে কুকির মুখের দিয়ে চেয়ে রইল! তার পর ফোকলা দাঁতে ফিক করে একটা হাসি হাসল!
কুকি ঠিক করেছে সে আর কোনও দিন মোমোকে হিংসে করবে না।