খবরটা পেয়েছ কি? হয়তো পাওনি। পাবে কী করে, ওটা তো আর লিওনেল মেসি বনাম ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো-মার্কা কিছু নয়। অথবা, মন্ত্রীসান্ত্রিদের দৌড়ঝাঁপ নয় যে, কাগজে-টিভিতে প্রচার পাবে। খবরটা একেবারে অন্য জগতের। এমন এক বিষয়ের, যাকে ইসকুলে অনেকে ভয় পায়। ভাবে, বিচ্ছিরি ওই সাবজেক্টটা ক্লাসে না থাকলে কী ভালই হত! পরীক্ষার আগের দিন তা হলে আর বুক দুরদুর করত না।
অথচ, ওই বিষয়টা— মানে অঙ্ক— আবার আমাদের জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। হ্যাঁ, মানছি বটে এ কথা যে, কঠিন কঠিন সব অঙ্ক সলভ না করেও দিব্যি জীবন কাটানো যায়। কাটাচ্ছেনও অনেকে। তবু, অঙ্কের এক দিক— সংখ্যা (২, ৪,... ২৩, ৭৫ ইত্যাদি)— কি আমাদের জীবন জুড়ে হাজির নয়? সকালে ক’টায় ঘুম থেকে উঠবে, ব্রেকফাস্টে ক’টা রুটি খাবে, কত নম্বর বাসে ইসকুল যাবে, পরীক্ষায় কে কার চেয়ে কত মার্কসে এগিয়ে থাকবে— এ সবই ওই সংখ্যা দিয়ে বোঝা যায়। তাই বলছিলাম, পাঠ্য বিষয় হিসেবে অঙ্ক কারও কারও কাছে যতই অপছন্দের হোক, তার দান সংখ্যা বিনে কিন্তু আমাদের জীবন অচল।
যে খবরের কথা বলছিলাম, তা ওই সংখ্যা নিয়ে। কী খবর, তা বলার আগে সংখ্যার জাত বিষয়ে দু’এক কথা জরুরি। ৬ আর ৭ হল দু’জাতের সংখ্যা। কারণ, ৬ হল অন্য দুটো সংখ্যার গুণ। ৬=২x৩। ৭ কিন্তু অন্য দুটো সংখ্যার গুণফল নয়। বড়জোর ৭= ৭x১। সে তো অন্য দুই সংখ্যার গুণফল হল না। প্রথম জাতের সংখ্যা ৬, যা ২ এবং ৩-এর গুণফল, তা হল যৌগিক। আর দ্বিতীয় জাতের সংখ্যা ৭, যা অন্যদের গুণফল নয়, তা মৌলিক। ২ কিংবা ৩ মৌলিক, ৬ যৌগিক।
আমাদের চার পাশে হাজারো-লাখো বস্তু ছড়ানো। বাহার দেখে থ’ হয়ে যেতে হয়। অথচ বিজ্ঞান বলে দিচ্ছে, এত বৈচিত্র দেখে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এক একটা বস্তু দেখতে যত আলাদাই হোক, আসলে ওদের সব কিছু মাত্র শ’খানেক পদার্থের পরমাণুর মধ্যে কয়েকটার পরমাণু দিয়ে গড়া। আমাদের দেহ বা গায়ের জামা, যা-ই বলো, সব এটা-সেটা পদার্থের পরমাণুর সমষ্টি। এ কারণে ২, ৩, ৫, ৭, ১১, ১৩... ইত্যাদিকে বলে সংখ্যার পরমাণু। সমস্ত যৌগিক দুই বা তার বেশি মৌলিকের গুণফল। মৌলিককে সংখ্যার পরমাণু বলায় কিছু ভুল নেই।
সাধারণ হিসেব বলে, সংখ্যা যত বড় হবে, তাদের মধ্যে মৌলিকের উপস্থিতি তত কমবে। ২, ৩, ৫, ৭ মৌলিক বলে তাদের গুণিতক ৪, ৬, ৮, ১০, ১২, ১৪, ১৫, ১৬, ১৮, ২০, ২১, ২২, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ৩০, ৩২, ৩৪, ৩৫ মৌলিক হতে পারে না। এই হিসেব থেকে যে ধারণা মাথায় আসে, তা এই যে, সংখ্যার ভিড়ে মৌলিক বুঝি কমতে কমতে এক সময় হারিয়ে যাবে। মানে, সবচেয়ে বড় মৌলিক বলে এমন একটা সংখ্যা থাকবে, যার পরে আর কোনও মৌলিকের দেখা মিলবে না।
যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৩০০ বছর আগে গ্রিক গণিতজ্ঞ ইউক্লিড প্রমাণ করেছিলেন ও ধারণা ভুল। সামান্য যুক্তিতর্কে ওই ধারণা ভেঙে দিয়েছিলেন তিনি। যৎসামান্য যুক্তিতে প্রকাণ্ড এক সত্য প্রতিষ্ঠার উদাহরণ অঙ্কশাস্ত্রে আর বেশি নেই। যুক্তি এত জলবৎ তরলং যে, সবাই বুঝবে।
বোঝানো যাক। ধরা যাক, ২, ৩, ৫, ৭, ১১ এবং ১৩-র পরে আর কোনও মৌলিক সংখ্যা নেই। ১৩ সবচেয়ে বড় মৌলিক। এমনটা মেনে নিলে কী হয়, তা দেখা যাক। ইউক্লিড যা বললেন, তা ওই উদাহরণে প্রয়োগ করলে একটা সংখ্যায় পৌঁছনো যায়। সংখ্যাটা হল ২x৩x৫x৭x১১x১৩+১= ৩০০৩০+১=৩০০৩১। এই সংখ্যাটা কি মৌলিক? ১৩ সবচেয়ে বড় মৌলিক হলে, ৩০০৩১ আর কেন মৌলিক হবে? অথচ, যে পদ্ধতিতে তৈরি হল ৩০০৩১, তা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ৩০০৩১ কোনও মৌলিকের গুণিতক নয়। ৩০০৩১-কে ২, ৩, ৫, ৭, ১১ বা ১৩ দিয়ে ভাগ করলে সব সময় ভাগশেষ থাকবে ১ (কারণ, ৩০০৩০ যে ২, ৩, ৫, ৭, ১১ এবং ১৩-র গুণফল)। সুতরাং, দেখা গেল, যতগুলো সংখ্যা মৌলিক বলে দাবি করা হয়েছিল, তাদের মোট গুণফলের সঙ্গে ১ যোগ করলে নতুন একটা মৌলিক পাওয়া যায়। তা হলে তো ১৩ সবচেয়ে বড় মৌলিক নয়। সে রকম দাবি করা ভুল। কোনও সংখ্যাকেই সবচেয়ে বড় মৌলিক দাবি করা ভুল।
সত্যের খাতিরে জানানো দরকার, ৩০০৩১ কিন্তু মৌলিক নয়, যৌগিক। কারণ, ৩০০৩১ অন্য দুই মৌলিক ৫৯ এবং ৫০৯-এর গুণফল। তা সে যা-ই হোক, সে ক্ষেত্রেও ১৩-কে সবচেয়ে বড় মৌলিক বলা যায় না। ১৩-র চেয়ে বড় দুই মৌলিক ৫৯ এবং ৫০৯ যখন আছে, তখন ১৩ কি করে ওই তকমা পায়? ইউক্লিডের সহজ অথচ গভীর যুক্তি বলে দিচ্ছে, সবচেয়ে বড় মৌলিক বলে কিছু হয় না।
২৩০০ বছর আগে ওই সত্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে বড়, আরও বড়, মৌলিকের খোঁজ চলেছে। এই প্রবন্ধের শুরুতে যে খবরের কথা বলেছি, তা ও ব্যাপারে সাফল্যের। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মৌলিকের খোঁজ মিলেছে। গত মাসের ৭ তারিখে ওই আবিষ্কারের খবর দিয়েছেন আমেরিকায় সেন্ট্রাল মিসৌরি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক কার্টিস কুপার। তিনি এবং তার সহযোগীরা অনেক কম্পিউটারে পাশাপাশি খুঁজে চলেন মৌলিক সংখ্যা। উদ্যোগের নাম গ্রেট ইন্টারনেট মার্সেন প্রাইম সার্চ (জি আই এম পি এস)। সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসি সন্ন্যাসী মারিন মার্সেন উৎসাহের বশে মৌলিক আবিষ্কারের একটা নিয়ম খুঁজতে গিয়েছিলেন। দেখেছিলেন মৌলিক যে সংখ্যাগুলো, ততগুলো ২-এর গুণফল থেকে ১ বাদ দিলে যে সংখ্যা মেলে, তা নিজে মৌলিক। ২টো ২-এর গুণফল -১=৩ মৌলিক। ৩টে ২-এর গুণফল -১=৭ মৌলিক। ওই নিয়ম কিন্তু সব সময় খাটে না। যেমন, ১১টা ২-এর গুণফল -১=২০৪৭ কিন্তু যৌগিক। কারণ, ২০৪৭=২৩x৮৯।
সে যা-ই হোক, মৌলিক পরিমাণ ২-এর গুণফল থেকে ১ বাদ দিয়ে যে সব সংখ্যা মেলে, সেগুলোর মধ্যে কোনটা নিজে মৌলিক, তা খুঁজে চলেছেন কুপার এবং তাঁর বন্ধুরা। ২০১৩ সালের ২৫ জানুয়ারি ওঁরা ঘোষণা করেছিলেন ৫,৭৮,৮৫,১৬১টি ২-এর গুণফল থেকে ১ বাদ দিলে যে সংখ্যা দাঁড়ায়, তা মৌলিক। তখন পর্যন্ত ওটাই ছিল সবচেয়ে বড় মৌলিক।
রেকর্ড ভাঙল এ বার। কুপার এবং তাঁর বন্ধুরা জানাচ্ছেন, ৭,৪২,০৭,২৮১-টা ২-এর গুণফল থেকে ১ বাদ দিলে যে সংখ্যা মেলে, তাও এক মৌলিক। সে সংখ্যাটা কত? নাহ্, এখানে তা লেখা যাবে না। শুধু জেনে রাখো, ওতে অঙ্ক (২৩৭ হল সংখ্যা, আর ২, ৩ বা ৭ হল অঙ্ক) রয়েছে ২,২৩,৩৮,৬১৮-টা!
অনিবার্য কারণবশত এই সংখ্যায় ‘ইসকুলে মুশকিল’ প্রকাশিত হল না।