লা-পান-লেজে

তা র পর কী হল?’ চিনিদাদুরও চোখ বড় হয়ে গেছে। ‘কিছু ক্ষণ পরে মাহুত তার হাতের বেতটা দিয়ে অল্প-অল্প মারল হাতিকে। মুখেও কী সব আওয়াজ করল। ব্যস! হাতি অন্য দিকে সরে গেল। বাইসন, হাতির লড়াই আর হল না।’

Advertisement

অশোককুমার মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৩৬
Share:

ছবি: সম্প্রীতি মুখোপাধ্যায়

তা র পর কী হল?’ চিনিদাদুরও চোখ বড় হয়ে গেছে। ‘কিছু ক্ষণ পরে মাহুত তার হাতের বেতটা দিয়ে অল্প-অল্প মারল হাতিকে। মুখেও কী সব আওয়াজ করল। ব্যস! হাতি অন্য দিকে সরে গেল। বাইসন, হাতির লড়াই আর হল না।’

Advertisement

‘বাঃ!, দারুণ তো লেডি তিতির!’ দাদু হাততালি দিয়ে উঠল। চিনিদাদু মা-র মামা।
এ বার পুজোর ছুটিতে ওঁর কাছেই আসা হয়েছে। দাদু বনবিভাগে কাজ করতেন। ভাল নাম চীনাংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও কলকাতায় বাগবাজারে বাড়ি, কিন্তু উনি চাকরির মেয়াদ শেষে এই মাদারিহাটেই ছোটখাটো বাড়ি করে থেকে গেছেন। এখানে আসবার আগেই মা এই কথাটা তার সামনে বাবাকে বলেছে বহু বার। কিন্তু যা বলেনি, ছোটখাটো হলে কী হয় চিনিদাদুর বাড়ি খুব সুন্দর। আশেপাশে অনেক লম্বা লম্বা গাছ। আকাশের দিকে হাত নাড়ছে। দাদু বলেছে ওই সব শিমুল গাছ। এই গাছে ঘেরা দাদুর বাড়ি। বাগানে ফুলের মেলা— লাল, নীল, হলুদ।

সব গল্প শুনে দাদু বলল, ‘জঙ্গলে জীবজন্তু দেখতে তো ভালই লাগে, তবে কী জান লেডি, এখানে এমন কিছু মানুষ আছে যাদের সঙ্গে আলাপ করলে তোমার ভাল লেগে যেতে পারে’। বেড়াবার কথায় তিতির তো সর্বদায় রাজি।

Advertisement

পর দিন সকালে জলখাবার খাওয়ার পর রওনা হল সবাই। গাড়িটা বড় আর বেশ উঁচু। সামনের দরজা খুলে দাদু বসল। বাবা-মা আর তিতির পিছনে। গাড়ি চলতেই মা বলে উঠল, ‘এই বার তো বলবে চিনিমামা, আমরা যাচ্ছিটা কোথায়?’। দাদু মাথা ঘুরিয়ে বলল, ‘টোটোপাড়া। এখান থেকে তেইশ কিলোমিটার। ওখানে টোটোরা থাকে। মাঝে ওদের সংখ্যা খুবই কমে গিয়েছিল। এখন পড়াশুনো, টাকা-পয়সা, চাকরি এই সব ব্যাপারে নানা রকম সাহায্য পেয়ে সংখ্যাটা একটু বেড়ে পনেরোশো ছিয়াত্তর হয়েছে। তবু কত কম বল।’ মা অবাক, ‘তাই তো দেখছি গো, কী কাণ্ড।’ বাবা বলল, ‘আরে! আমরা গড়িয়াহাটের যে আবাসনে থাকি তার সব লোককে যোগ করলেই তো এর চেয়ে বেশি হবে।’ দাদু হাসল, ‘হ্যাঁ, আরও কী জানো আর্য, ক’দিন আগেও ওদের মধ্যে মেয়ে আর ছেলের সংখ্যা প্রায় সমান-সমান ছিল, এখন ছেলেদের সংখ্যাটা অল্প একটু বেড়েছে। জন্মের পর কোনও বিজোড় দিনে, মানে তিন-পাঁচ কী সাত দিনের মাথায় ওদের নামকরণ করা হয়। তবে তেরো দিনের মধ্যে নাম দিতেই হবে।’ বাবা মাথা নাড়ল। ‘হ্যাঁ, চিনিমামা এই নামকরণের অনুষ্ঠানকেই তো ওরা মদিপা-পাওয়া বলে আর সমাজের পাও এসে এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন, তাই না?’ ‘একেবারে ঠিক’, দাদু খুশি হয়ে হাসল, ‘বাহ! তুমি তো অনেক কিছু জানো দেখছি।’ বাবা একটু লজ্জা পেল মনে হয়, ‘না না মামা, এইটুকুই জানি, তিন-চার বছর আগে একটা পত্রিকায় পড়েছিলাম’। মা দাদুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘পাও মানে কি পুরোহিত?’ বাবা মাথা নাড়িয়ে বোধ হয় হ্যাঁ বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই দাদু বলল, ‘না, ঠিক পুরোহিত বলা যাবে না, পাও হল ওঝা। ওদের পুরোহিতকে বলে ‘কাইজি’ আর মোড়ল হল ‘গাপ্পু’।’

এই সব বড়দের কথা ভাল বুঝতে পারছিল না তিতির। অবশ্য একেবারেই যে বুঝতে পারছে না, ঠিক তা নয়, সে এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। কিন্তু, দুচ্ছাই! কেউ তার সঙ্গে কথা বলছে না কেন? একটু একটু রাগও হচ্ছিল। ভাবছিল বাবাকে একটা রাম-চিমটি কাটবে। নাঃ, বাবার খুব লাগবে। অতএব, একটা শ্যাম-চিমটি দেওয়াই ঠিক। সবে হাত বাড়িয়েছে, বাবা তিতিরের দিকে ফিরল, ‘শোন, যেখানে যাওয়া হচ্ছে টোটোরা ওই অঞ্চলের অনেক অনেক পুরনো বাসিন্দা। ওদেরকে এখন জনজাতি বলা হয়।’ এই বার দাদু তিতিরের দিকে ফিরে বলতে থাকল টোটোদের কথা। তিন বর্গমাইলের কিছু বেশি এলাকা নিয়ে ওদের বাস। এরই মধ্যে টোটোদের মোট ছ’টা গ্রাম। টোটোপাড়ার পূর্বে তোর্সা নদী, পশ্চিমে পদুয়া পাহাড়। উত্তরে হিপসা পাহাড়, আর দক্ষিণে জলদাপাড়া বন।

গাড়িটা বড় হলে কী হয়, বড্ড ক্যাঁচর-ম্যাঁচর আওয়াজ। দাদুর কথা ভাল শোনা যাচ্ছে না। বাবাকে বলে তিতির সামনে দাদুর কাছে গিয়ে বসল। গাড়ির সামনে থেকে তিন দিক দেখা যায়, পিছনের থেকে অনেক ভাল। তা ছাড়া, সত্যি বলতে কী, দাদুর মুখে গল্প শুনতে ভাল লাগে। এত মজার মুখ করে কথা বলে দাদু; তিতিরের চোখের সামনে ছবি ভেসে ওঠে। সে মনে মনে সেই জায়গায় পৌঁছে যায়। সামনে বসে চুপিচুপি কথাও বলা যাবে দাদুর সঙ্গে! সে ভাবছে একটা হরিণের বাচ্চা পুষবে। কিন্তু দাদু মৃদু গলায় জানাল, এখন ও কাজ বারণ। ডান দিকে, একটু দূরে তোর্সা নদী। ‘জানো তো, টোটোরা এই নদীকে বলে মুটি’, দাদু হাসল। মুটি? তিতির ঝরঝর করে হেসে ফেলল।

‘পথে তিনটে নদী পড়বে— বাংরি, তিতি আর হাউড়ি’, বলেই দাদু ভুরু নাচাল, ‘তিতির নয় কিন্তু, তিতি।’ তিতির হেসে ফেলল, ‘হ্যাঁ তিতি, তিতি।’ চিনিদাদু বলল, ‘লেডি, তুমি চাইলে আমরা অবশ্য এখানকার কোনও ছোটখাটো নদীকে তিতির বলে ডাকতে পারি, টোটোরা আবার নদীকেও পুজো করে, তার মানে তোমার নামের নদীকেও ওরা পুজো দেবে, ভেবে দেখো।’ ঠাকুর দেবতা হওয়া খুব মুশকিল, সবাই তোমার দিকে তাকিয়ে ফুল ছুড়ছে, মন্ত্র পড়ছে! ভাবতেই গা শিরশির করল। তিতির প্রবল মাথা নেড়ে আপত্তি জানাল, ‘না, না তার চেয়ে এক হরিণছানার নাম রাখব তিতির, সে তার ইচ্ছেমতন এখানে যাবে, ওখানে যাবে, কিংবা কোনও শিমুল গাছের নাম রাখব তিতির, সে সারা দিন রাত আকাশের সঙ্গে কথা বলবে, মাথা নাড়াবে।’ ‘বাঃ লেডি বাঃ’, তিতিরের মাথায় ডান হাত রেখে দাদু সামনের দিকে তাকিয়েই জোরে জোরে বলল, ‘বুঝলি সোমা, তোর মেয়ে অনেক বড় হবে, দেখিস, কী সুন্দর কল্পনা।’

টোটোপাড়ায় ঢুকেই একটা কাঠের বাড়ি দেখিয়ে দাদু বলল, ‘লেডি তিতির দেখো, এক জন টোটোর বাড়ি। আর ওই দেখো বাচ্চারা, সব তোমারই মতো, ওদের সঙ্গে ভাব করবে নাকি?’ তিতিরের চোখেমুখে খুশি। দাদুর হাত ধরে গাড়ি থেকে নেমে ওদের দিকে এগিয়ে গেল। বাবা-মা পিছনে। ওরা দাঁড়িয়ে দু’ধারের আম-কাঁঠাল আর সুপুরি বাগান দেখছে। দাদু বলল, ‘যাও ওই মেয়েটার নাম জিজ্ঞাসা করো’। তিতির বলল, ‘নকো মিং হাঙ্গা?’ মেয়েটা হাসতে হাসতে বলল, ‘কুং মিং মেঘা’। তিতির বুঝে গেল, এই নতুন বন্ধুর নাম মেঘা। যদিও তার নাম জানতে চায়নি, তবু সে নিজেই বলল, ‘কুং মিং তিতির।’ মেয়েটা আবার হাসল। ইতিমধ্যে বাবা-মা এসে গেছে। বাবা আর মাকে ছুঁয়ে তিতির বলল, ‘কুং আপা আয়ু’। মেঘা চোখ বড় বড় করে হেসে উঠল। বাবা-মা তো অবাক। মা বলল, ‘আরে! তুই আবার এর মধ্যে টোটোদের ভাষা কী করে শিখলি!’ চিনিদাদু একটু দূরে দাঁড়িয়ে হাসছিল। এই বার দাদু এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল মেঘাকে, ‘নাতিবিকো লোইকো মিং হাঙ্গা?’ বলেই তিতিরের দিকে ফিরে এর মানে বুঝিয়ে দিল কোন গ্রামে থাকো? মেঘা এক গাল হেসে বলল, ‘দুমসি গাঁও।’ তিতির দাদুকে দেখিয়ে বলল, ‘কুং আটা।’ আবার বাংলাতেও বলে ফেলল, ‘আমার দাদু!’ ব্যস, এই চারটি বাক্যই এখানে আসবার পথে দাদু তাকে চুপিচুপি শিখিয়েছে। চিনিদাদু একমাথা সাদা চুল ঝাঁকিয়ে হাসতে হাসতে তালি দিয়ে বলল, ‘একদম ঠিক বলেছ লেডি, একশোয় একশো।’ মেঘাও হাসতে হাসতে তালি দিতে থাকল।

টোটোপাড়া থেকে ফেরবার পথে দাদু বলল, ‘একটা গল্প বলি শোনো। অনেক দিন আগের কথা। তখন তো বনমুরগি বাঁদর এরা একে অন্যের বন্ধু। একসঙ্গে চাষাবাদ করে। এক দিন বনমুরগি বাঁদরকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করল। তার পর ডিম পেড়ে রান্না করে বাঁদরকে খেতে দিল। বাঁদর মুরগির ডিম খেয়ে খুব খুশি। এর আগে কোনও দিন সে ডিম খায়নি। কয়েক দিন পরে বাঁদর বনমুরগিকে তার বাড়িতে খাওয়ার জন্য ডাকল। ভাবল মুরগিকে ডিম খাইয়ে সেও অবাক করে দেবে। সারা দিন জঙ্গলে ঘুরে বাঁদর নানান রকমের ফলমূল জোগাড় করল ঠিকই, কিন্তু ডিম পেল না কোথাও। শেষে মুরগিকে বলল, কোথায় ডিম পাওয়া যায় বল তো? মুরগি বলল, তুমি উনুনে কড়াইটা চাপাও, ওইটা যখন লাল হয়ে আসবে, তার ওপর বস, দেখবে তোমার পেটের ডিম বেরিয়ে আসবে। কথামতো কড়াইতে বসতেই বাঁদর তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল। তার পর চিৎকার করে লম্ফঝম্প জুড়ে দিল। পেছনটা জ্বলে যাচ্ছে! মুরগি বলল, তাড়াতাড়ি জলে ঝাঁপ দাও। বাঁদর নদীতে ঝাঁপ দিল। এ দিকে ও সাঁতার জানে না। জলে তলিয়ে যাচ্ছে। মুরগির সাহস হল না তাকে উদ্ধার করবার। সে হাঁ-করে দেখছে বাঁদরের অবস্থা। এমন সময় শিকারের খোঁজে এক বাঘ উপস্থিত। বাঁদর বলল, আমাকে বাঁচাও। বাঘ জানাল, সে তাকে বাঁচাতে পারে, তবে একটা শর্তে। কী শর্ত? বাঘ তাকে জল থেকে তুলবে ঠিকই কিন্তু তার পর সে বাঁদরকে খাবে। বাঁদর বলল, দাঁড়াও, আমি তো একেবারে ভিজে সপসপ করছি, একটু রোদ্দুরে শুকিয়ে নিই তার পর না-হয় খেয়ো, কেমন? এই বলে, সে একটা গাছের ডালে উঠে বসল। কিছুক্ষণ পরে বাঘ বলল, কী হল? এই বার তো শুকিয়ে গেছে? বাঁদর বলল, হ্যাঁ, গা শুকিয়েছে বটে, কিন্তু পা দুটো যে ভেজা। এই বলে, সে আর একটু উঁচু ডালে চড়ে বসল। কিছু পরে বাঘ আবার তাগাদা দিল, কী হল? বাঁদর বলল, পা শুকিয়েছে ঠিকই, কিন্তু নখগুলো যে ভেজা। বলেই বাঁদর এক লাফে মগডালে। সেখান থেকে সোজা অন্য গাছে। বাঘ সেখানে ধাওয়া করলে, আবার অন্য গাছে। এই ভাবে বাঘকে বোকা বানিয়ে বাঁদর পালিয়ে গেল।

চিনিদাদু মুচকি হেসে বলল, ব্যস।

লা-পান-লেজে। তার মানে? গল্প ফুরোল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement