ছবি: সুমন চৌধুরী।
ছো টবেলায় বাবার সঙ্গে কত অদ্ভুত অদ্ভুত জায়গায় যে ঘুরে বেড়িয়েছি, ভাবলে এখনও মন ভাল হয়ে ওঠে। কোথাও প্রথম বর্ষার পর নতুন ঘাসের ভেতর বেরিয়ে পড়ত লাল লাল পোকারা, কোথাও পাহাড়ের গায়ের জঙ্গলে আগুন লেগে যেত, জ্বলত সপ্তাহ ভর, কোথাও এনামেলের রঙে রাঙানো ডোরাকাটা বাঘ-মানুষ নেচে বেড়াত। কোথাও মুখোশ পরে গান গাইতে গাইতে চলে যেত ঝুমুরের দল। ক্লাস ফাইভের ফাইনাল পরীক্ষা। শেষ দিন অঙ্ক। প্রত্যেকটা অঙ্ক ঠিকঠাক করেছি। বাড়ি ফিরলে বাবা বললেন, কেমন হয়েছে? কত পাবি? আমি বললাম, একশোর মধ্যে একশো তো পাবই। বাবা বেরিয়ে গেলেন। আমি বেরিয়ে গেলাম তার পরেই, লাল পোকাদের পিছু ধাওয়া করতে। সেখান থেকে জঙ্গল। জঙ্গল থেকে ফিরে ‘রাজিয়া সুলতানা’ নাটকের মহড়া দেখা। এক দিন স্কুলে গিয়ে শুনলাম অঙ্কের রেজাল্ট বেরোবে। বগলে দিস্তে দিস্তে অঙ্ক খাতা নিয়ে স্যর ঢুকলেন। কেউ দশ পেয়েছে, কেউ ষাট, কেউ আশি। এক সময় সমস্ত খাতাই ফুরিয়ে গেল, টেবিলে একটা মাত্র খাতা। ওটাই আমার আমি জানি, এবং একশো যে পেয়েইছি, সেটাও জানি। তা না হলে সবার শেষে আমার খাতা দেওয়া হবে কেন! স্যর আমাকে ডাকলেন, আয়, সামনে এসে দাঁড়া, সবাই দেখুক তোকে। আমি গর্বিত মুখে এগিয়ে গেলাম স্যরের টেবিলের কাছে, দেখাই তো উচিত আমাকে— একশোয় একশো। স্যর খাতাটা বুকের সামনে ধরে দাঁড়াতে বললেন। আমি মহা আনন্দে তা-ই করলাম, আর হোহো হাসির শব্দে ক্লাসরুম ফেটে গেল। এই বার খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি, বিশাল একটা শূন্য। ‘হেডমাস্টারকে বলেছি তোর বাবাকে ডেকে পাঠাতে, এমন গুণধর ছেলে! তোর মূর্তি গড়ে স্কুলের মাঝখানে বসিয়ে দিতে হবে।’
হেডমাস্টারমশাই বাবাকে কী বলেছিলেন জানি না, কয়েক দিন পর থেকে বাড়িতে আসতে শুরু করলেন এক প্রাইভেট টিউটর। মা বললেন, এখানকার সবচেয়ে ভাল প্রাইভেট মাস্টার উনি, এর কাছে পড়ে গাধারাও দৌড়ে ঘোড়াদের হারিয়ে দেয়। এক মাস কাটল, দু’মাস কাটল, তিন মাসের মাথায় স্যর বাবাকে বললেন, আমি আর কাল থেকে আসছি না। আপনি একে দুটো বলদ আর একটু জমি কিনে দিন। এ ছাড়া আর ওর কিছু হবে না।
তার পর আরও কয়েকটা বছর কেটে গেল। তত দিনে বুঝতে পারছি বাঘ-নাচের দলের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো, পিঁপড়েদের হাতের মুঠোয় বন্ধ করে মন্ত্র বলা আর বিন্দ্যা পর্বতের জঙ্গলে সাপের পেছনে ধাওয়া করা আর চলবে না। একটা কিছু করতে হবে। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার আর মাস দুয়েক বাকি, বাড়িতে এক সাধু এসে হাজির। ভাই-বোনেদের মধ্যে আমাকে নিয়ে মা’র সবচেয়ে বেশি চিন্তা, কেননা পাড়াপড়শি থেকে আত্মীয়স্বজন, সকলেরই ধারণা— আমাকে শেষ পর্যন্ত আলু-পেঁয়াজই বেচতে হবে। মা আমার হাত নিয়ে বাড়িয়ে দিলেন সাধুর দিকে, জিজ্ঞেস করলেন, পাস করেগা? সাধু মা’র দিকে তাকিয়ে বললেন, দশ সাল ছোড় দো, উসকা বাদ দেখা যায়েগা। মা চোখের জল মুছতে মুছতে চলে গেলেন রান্নাঘর। আর আমি সেখান থেকে ছুটতে ছুটতে বাসস্ট্যান্ডে এসে প্রথম একা একা বাসে করে চলে এলাম দিদিমার কাছে। সব শুনে দিদিমা বললেন, ওইডা সাধু না, হারামজাদা! অর মুখে হাইগ্যা দিলি না ক্যান? আর ছবিটার (আমার মা) বুদ্ধিসুদ্ধি যে কবে হইব! ছোটমামু বললেন, এসব আলফাল বকা সাধুদের ভেজে মদের সঙ্গে খাওয়া উচিত।
তার পর আরও কয়েক বছর কেটে গেছে। আমি কলেজে অর্থনীতি পড়াই। আমি আর বাবা লঞ্চে করে নদী পেরিয়ে হাওড়া ফিরছি। গিজগিজে ভিড়, আর তার মাঝখানেই একটা মুখ দেখে চমকে উঠলাম আমি, চমকালেন বাবাও। তার পর ভিড়ের মধ্যে সাঁ করে ঢুকে পড়ে তাড়া করতে লাগলেন এক জনকে। সে যেখানেই যায়, বাবা তার পাশে গিয়ে হাজির হন। শেষ কালে জলে ঝাঁপ দিতে যাবেন, বাবা তার শার্ট ধরে টেনে আনলেন আমার কাছে: চিনতে পারছেন? ইকোনোমেট্রিক্স নিয়ে এমএ পাশ করে এখন প্রফেসর। বাবাকে আমি কিছুতেই প্রফেসর আর লেকচারার-এর তফাত বোঝাতে পারিনি। তত ক্ষণে আমার সেই গৃহশিক্ষকের প্রায় কেঁদে বঁাচার মতো অবস্থা, আর বাবার মুখ বহু দিনের পুরনো এক অপমান ফিরিয়ে দেওয়ার আনন্দে দিব্যসুন্দর।
অসম্ভব ভাল কিছু মাস্টারমশাই পেয়েছি জীবনে। এক জন ছিলেন তরুণ সান্যাল। সে সময়ের বিশাল বড় মাপের কবি। স্কটিশ কলেজে আমাদের স্ট্যাটিসটিক্স পড়াতেন। ক্লাসে পড়াতে পড়াতে মাঝেমাঝেই বলতেন ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল মিউজিকের ইতিহাস, বাখ-বেঠোফেন-মোৎজার্টদের গল্প। কলেজের একদম কাছেই থাকতেন তরুণদা। ছোট্ট দুটো ঘর, ঘরভর্তি শুধু বই আর রেকর্ড। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেকর্ড বাজিয়ে শোনাতেন, শোনাতেন সুরের এক আশ্চর্য পৃথিবীর গল্প। পরে বিদেশের অনেক মানুষের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে যাঁরা এ বিষয়ে দিগ্গজ, অনেক কথা হয়েছে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল মিউজিক নিয়ে, কিন্তু কখনওই মনে হয়নি, ওই বিষয়ে তাঁদের বৈদগ্ধ্য তরুণ সান্যালকে ছাপিয়ে যায়।
আর ছিলেন বিপ্লব দাশগুপ্ত। পড়াতেন বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস। সকালবেলা মাঝে মাঝে পাইকপাড়ায় বিপ্লবদাদের বাড়ি চলে যেতাম। কথায় কথায় সকাল গড়িয়ে যেত দুপুরে, দুপুর গড়িয়ে যেত সন্ধ্যায়। শুধু অর্থনীতি নয়, বেঁচে থাকার কত আশ্চর্য গল্প শুনিয়েছিলেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসে ছিলেন অসীম দাশগুপ্ত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকনমিক্সের ঈশান স্কলার। সমস্ত পৃথিবীটাই যাঁঁর পায়ের তলায় ছিল, তিনি সব কিছু সরিয়ে রেখে চলে এলেন পড়াতে। যে পড়ানো ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে টিচার্স রুম, টিচার্স রুম থেকে তাঁর বাড়ি অবধি পৌঁছে যেত। অদ্ভুত মাস্টারমশাই ছিলেন। একটা চেয়ারকে এক ঘণ্টা পড়ালে চেয়ারটা অনায়াসে ভেক্টরম্যাট্রিক্স-এ অঙ্ক কষতে শুরু করে দিত। এঁদের কাছে আর এ রকম আরও কয়েক জন মাস্টারমশাইয়ের কাছে আমার ঋণ ফুরনোর নয়। তাঁদের টেবিলে কোনও নোটস-এর পাতা থাকত না। টিউশন করে অর্থ উপার্জন করার কোনও দাবি ছিল না। দাবি ছিল শুধু নিজেদের নানান বিষয়ে অধীত বিদ্যার সবটুকু আমাদের কাছে উজাড় করে দেওয়ার। অথচ কতটুকুই বা মাইনে তাঁরা পেতেন সেই সময়! বিপ্লবদাদের বাড়িতে একটাই গামছা ছিল। যে আসত সে সেই গামছাটা দিয়েই স্নান করত। আমিও বাদ যাইনি। তরুণদা নিজে বিডন স্ট্রিট থেকে আমাদের জন্য চপ-মুড়ি কিনে আনতেন। ভবানীপুরে হেডমিস্ট্রেস মায়ের ছোট্ট কোয়ার্টার্সে বিস্কুট-সিঙাড়া আর চায়ের পর চা আসত অসীমদার কাছে গেলে। আর কত রকম গল্প ভিজে জল হয়ে যেত আমাদের মন, হৃদয়।
বিপ্লবদা চলে গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। তরুণদাকে এই সে দিন দেখতে গিয়েছিলাম হাসপাতালে। অসীমদা ফাটাফাটি লড়ে যাচ্ছেন। নিজের কথা ভাবলে মাঝে মাঝেই মনে হয়, সবাইকেই কবিতা লিখতে হবে, গান গাইতে হবে, সিনেমা করতে হবে বা ছবি আঁকতে হবে, এমন নয়। তার কোনও প্রয়োজন নেই। কিন্তু পরের প্রজন্মের কাছে এগুলো সম্বন্ধে আগ্রহ, ভালবাসা তৈরি করে দেওয়াটা তো খুব দরকার। সেই দিন অনেক রাতে বাড়ি ফিরছি। নানা কারণে মেজাজ একদম খাট্টা। ঘরে ঢুকে চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়লাম, খেয়াল করিনি, পাশের ঘরের বন্ধ দরজার ভেতর থেকে ভেসে আলছে বোলেরো। পুরনো পিয়ানোয় আমার মেয়ে সুর তুলছে। আর একটু পরেই বুঝতে পারলাম, আমার খাট বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। ভেসে চলেছে মেঘের মধ্যে দিয়ে।