ছবি: রৌদ্র মিত্র।
নমস্কার! আমার নাম তিলক মিত্র, বয়স পঁয়ত্রিশ, থাকি গুরুগ্রামের একটি বহুতলের সতেরো তলায়। জাতীয় স্তরের একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায় চিফ ক্রিয়েটিভ অফিসারের চাকরি করি।
বিজ্ঞাপন সংস্থার সিসিও হিসেবে দশ, পনেরো বা তিরিশ সেকেন্ডে গল্প বলাটা আমার স্কিল-সেটের মধ্যে পড়ে। আমি এখন তোমাদের একটা গল্প বলব। বড়দিন উপলক্ষে ‘মিত্তি’ একটা প্রেমের গপ্পো।
‘আমি বলব, তুমি শুনবে!’ গানের লাইন ধার করে বললাম বটে, তবে আদতে তুমি গল্পটা পড়ছ, তাই না? সেই হিসেবে তুমি শ্রোতা নও, পাঠক। লিঙ্গনিরপেক্ষ ভাবে, এই গল্পে, আমি তোমাকে ‘পাঠক’ বলে সম্বোধন করব, কেমন?
যদি ভেবে থাকো যে, বড়দিনের প্রেমের গল্প মানেই পার্ক স্ট্রিটের মদিরা-লাঞ্ছিত হুল্লোড়, নাহুমের দোকানের সামনের লম্বা লাইন, রক ব্যান্ডের মেধাবী উচ্ছ্বাস, লিটল ব্ল্যাক ড্রেস পরিহিতাদের নাভি-নৃত্যের ঘূর্ণিপাক, বো ব্যারাকের মিসেস লোবোর হোম-মেড ওয়াইন বা সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রালের মিডনাইট মাস— তা হলে এই গল্প তোমার জন্য নয়। কারণ এই গল্পের পটভূমি কলকাতা নয়। এই গল্প আমিরপুর নামের একটি গ্রাম আর জারুলতলা নামের এক মফস্সলের। যে রকম অজস্র গ্রাম আর মফস্সল দিয়ে তৈরি আমাদের বাংলা।
গল্পে কী নেই, সেটা বলেছি। ক্লিকবেটের কায়দায় এ বার বলি, কী আছে। আছে রাতের কুয়াশা আর ভোরের শিশির, আছে দীর্ঘ-হতে-থাকা রাত আর হ্রস্ব-হতে-থাকা দিন, আছে শাল সোয়েটার থেকে উঠে আসা ন্যাপথলিনের গন্ধ, আছে কমলালেবুর অম্লমধুর স্বাদ, জয়নগরের মোয়ার বার্ষিক সুঘ্রাণ, আছে প্রথম প্রেম ও প্রথম চুমু।
আর আছে সীমা আন্টির কেক।
আগ্রহ জন্মেছে, পাঠক? তা হলে শুরু করি?
*****
আমিরপুর বা জারুলতলা নামে কোনও জায়গা নেই। ওগুলো বানানো নাম। বাস্তবে আছে এমন জায়গার দরকারটাই বা কী! রিয়্যালিটি নিয়ে বেশি মাথা ঘামালে গল্পের রসাস্বাদনে বাধার সৃষ্টি হয়।
আমিরপুরে শ’দুয়েক বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারের বাস। এঁদের উৎস খুঁজতে গেলে যেতে হবে তিনশো বছর আগে। যখন বর্গিরা জাহাজে করে এসে বাংলার গ্রামে লুটপাট করত। (খোকা ঘুমোলো, পাড়া জুড়োলো, বর্গি এল দেশে... এটসেটরা!) এই বর্গিদের হাত থেকে রাজপরিবারকে বাঁচাতে আমিরপুরের রানিমা গোয়া থেকে এক ডজন জাঁদরেল পর্তুগিজ সৈন্য আনেন। জাহাজি লড়াইতে ওঁরা বিরাট তালেবর! ওঁদের জন্যেই বর্গি হানা থেকে রক্ষা পায় রাজপরিবার। রানিমা পুরস্কার হিসেবে সৈন্যদের উপহার দেন অনেকটা নিষ্কর জমি। সেখানেই জন্ম নেয় পর্তুগিজ কলোনি।
সৈন্যদের পদবি ছিল রোজ়ারিয়ো, তেসরা, লোবো বা ডিক্রুজ়। এঁরা জীবনসঙ্গী হিসেবে আমিরপুরের মেয়েদের বেছে নেন। সুজলা, সুফলা বাংলার জমি এবং নারীর মায়ায় পড়ে ওঁদের কেউ আর গোয়ায় ফেরত যাননি। স্থানীয় মেয়েদের ধর্ম ও পদবি বদলে গেল। বদলে গেলেন সৈন্যরাও। মাছ-ভাত খেয়ে তাঁদের ব্যায়াম করা পেটে স্নেহপদার্থ জমে নেয়াপাতি ভুঁড়ি গজাল। জীবনবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে পর্তুগিজ রক্তে মিশল বাঙালিয়ানা। ছেলেপুলে, নাতিনাতনির মাতৃভাষা হল বাংলা। বদল এল চোখের মণি এবং গায়ের রঙে।
তিনশো বছর পরে পর্তুগিজ বাড়ির গেরস্থ বৌরা শাড়ি পরেন, সিঁথিতে সিঁদুর দেন, শাঁখা-পলা পরেন। বাড়ির উঠোনে তুলসীমঞ্চ আর মা মেরির থান থাকে পাশাপাশি। আমিরপুরে জিশুর মন্দির এবং রোমান ক্যাথলিক গির্জা— দুই-ই আছে। ওঁরা সেখানে প্রার্থনা করেন।
বিশে ডিসেম্বর থেকে পয়লা জানুয়ারি পর্যন্ত আমিরপুরে জিশু-মেলা চলে। দু’টি গির্জায় রঙের পোঁচ পড়ে। কীর্তনের দল খোল-করতাল বাজিয়ে গাইতে থাকে— “আয় আয় আয় রে নগরবাসী,
প্রাণনাথের দর্শন নিতে আয় রে জগৎবাসী,
জন্মিলেন রাজা জিশু স্মরণ নিতে আয় রে...”
মেলাতলা সাজানো হয় বেলুন, মালা, রাংতা আর তারা দিয়ে। নাগরদোলা, ঘোড়ার-দোলা, আট-পা-ওয়ালা মাকড়সা-মানবী, বাইকবাজের মরণকূপ, বন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটানো— সব আসে। দেদার বিক্রি হয় জিলিপি, বাদাম, ফুচকা, জিবেগজা!
আর থাকে সীমা আন্টির কেক। অপূর্ব তার স্বাদ।
আমার বাড়ি ছিল আমিরপুর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে, জারুলতলায়। বাবা-মা শিক্ষক। ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের হাত ধরে মেলায় এসে সীমা আন্টির কেক খেতাম।
সীমা আন্টির বয়স এখন পঞ্চান্ন। এই গল্পটি ঘটছে পনেরো বছর আগের এক ক্রিসমাস ইভে। তখন আমি কুড়ি আর সীমা আন্টি চল্লিশ।
আন্টির চোখের মণির রং কালচে-নীল। গায়ের রং শ্বেতপদ্মের পাপড়ির মতো, যার মধ্যে নীল ধমনী দেখতে পাওয়া যায়। আন্টি বলতেন, “আমার বাবার চোখের মণি ছিল নীল রঙের। আমারটা আর সে রকম হল না!”
একটু বড় হওয়ার পরে ক্লাসমেটদের মুখে শুনেছি যে, আন্টির স্বামী, সুবিনয় রোজ়ারিয়ো, কনসালটেন্সি ফার্মে চাকরি করেন। প্রচুর মাইনে, রাজারহাটে ফ্ল্যাট আছে। ওঁদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। সীমা আন্টি আর একটা বিয়ে করেছেন।
ক্লাস টুয়েলভের পর ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে পড়ব বলে আমি কলকাতার হস্টেলে চলে আসি। সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরলেও আমিরপুরে যেতাম না। কিন্তু উত্তুরে হাওয়ায় শিরশিরে ভাব শুরু হলেই মনে পড়ত জিশুপুজো আর সীমা আন্টির কেকের কথা। শালপাতার প্লেটে সাজিয়ে, ছুরি দিয়ে চার টুকরো করে কেকটি দেন আন্টি। সে স্বাদ ভোলার নয়।
গল্পের শুরুতে, পনেরো বছর আগে, কুড়ি বছরের আমি সীমা আন্টির স্টলে বসে কেক অর্ডার করেছি। ছোটখাটো চেহারার সীমা আন্টির পরনে হলুদ রঙের ছাপা শাড়ি, গায়ে জড়ানো নীল শাল। শালপাতার প্লেটে চার টুকরো কেক এগিয়ে দিলেন আন্টি। আমি একটা টুকরো মুখে পুরলাম।
বাকি তিনটে টুকরোর কী হবে? বলছি পাঠক, একটু অপেক্ষা করো। এখন প্রেমের গল্প ফ্ল্যাশব্যাক মোডে চলে যাবে! কারণ নায়িকার প্রবেশ ঘটবে!
*****
ক্লাস ওয়ান থেকে আমি জারুলতলা সেন্ট মার্টিন স্কুলের ছাত্র। কো-এড স্কুলে ক্লাস এইটে ভর্তি হল সুবর্ণরেখা রায়। এবং তাকে দেখে গোটা স্কুলে, সাধু বাংলায় ‘হিল্লোল বয়ে গেল’ আর চালু কথায় সবার চোখ টেরিয়ে গেল।
দেখো পাঠক, চোদ্দো বছরের একটি মেয়েকে দেখেছিল সমবয়সি এক ছেলে। পঁয়ত্রিশ বছরের আমি কাব্যিক রূপবর্ণনা করতে পারি। বলতে পারি যে ওর গায়ের রং ছিল সকালের আয়নার মতো, মুখশ্রী ছিল হারানো মন্দিরের স্বর্ণপ্রতিমার মতো, হাসি ছিল নদীর বুকে ফোটা প্রথম রোদের মতো। কিন্তু এই সব ‘খুকু গদ্য’ ও বোকাটে উপমার কোনও মানে নেই। সুবর্ণরেখাকে সেই বয়সে কারণহীন ভাবে ভাল লেগেছিল।
ওর বাবা অস্মিত রায় আইএএস অফিসার। বিভিন্ন রাজ্যে চাকরি করার পরে কেরিয়ারের মাঝামাঝি পোস্টিং হয়েছে আমাদের জেলাশাসক হিসেবে। সুবর্ণরেখার মা গৃহবধূ। কিন্তু এখন কারও বাবা-মাকে নিয়ে আলোচনা হবে না। এখন আলোচনা হবে সুবর্ণরেখার রূপ নিয়ে। ওই রকম তুলকালাম, ডাকসাইটে, কেলেঙ্কারিয়াস, হইচই ফেলে দেওয়া সুন্দরী অতীতে পয়দা হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। এটা আমার দাবি! এবং হে পাঠক, তুমি ‘স্পিকটি নট’ হয়ে দাবিটি মেনে নাও। যদি আপত্তি থাকে, তা হলে তিন কপি লিখিত এবং প্রত্যয়িত দরখাস্ত আমার কাছে জমা করতে পারো। আমি সেগুলো কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলব। মানছি, আমার চোদ্দো বছরের ক্ষুদ্র জীবনে তখনও পর্যন্ত মাত্র গোটা বিশেক মেয়ে দেখেছিলাম। তারা সবাই আমার স্কুলে পড়ত। কিন্তু, স্বল্প অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও আমার কথা সত্যি যে, সুবর্ণরেখা পৃথিবীর সব থেকে সুন্দরী মেয়ে।
পাঠক, লুকিয়ে লুকিয়ে হেসো না! এটা জেনে রাখো যে, আমার ওকে একতরফা ভাল লাগেনি। কিছু দিনের মধ্যেই জেনে যাই যে, ওরও আমাকে ভাল লেগেছে। ক্লাস এইটের পারস্পরিক মুগ্ধতা বদলে যায় প্রেমে। পরের চারটি বছর আমরা লুকিয়ে প্রেম করেছি। ক্লাস চলাকালীন আড়চোখে দেখা, টিফিনবাক্সে চিরকুট বিনিময়, লাইব্রেরিতে গ্রুপ-স্টাডির নামে টুক করে গাল ছুঁয়ে দেওয়া, স্যরের কাছে পড়তে গিয়ে সিঁড়ির নীচে অন্ধকারে হঠাৎ সর্বগ্রাসী চুমু— সবই হয়েছিল। তবে আমরা মন দিয়ে লেখাপড়া করতাম। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কয়েক জনকে দেখেছি প্রেমে পড়ে লেখাপড়ার বারোটা বাজাতে। আমাদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। সুবর্ণরেখার কথা ভাবলেই আমার মন শান্ত হয়ে আসত। মনে হত ভাল করে লেখাপড়া করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে বিয়ে করে এক সঙ্গে থাকা যায়।
জানি পাঠক, জানি! মফস্সলি ছেলেমেয়েদের বোকা-বোকা প্রেমের গপ্পো শুনে তুমি হাসছ! কিন্তু আমরা এই রকমই ছিলাম গো! বোকা আর সরল!
কাজের কথায় ফিরি? টুয়েল্ভের পরীক্ষার ফল বেরোনোর পরে আমি চলে এলাম কলকাতায়, প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরিজিতে অনার্স নিয়ে পড়তে। সুবর্ণরেখা চলে গেল দিল্লি, সেন্ট স্টিফেন’স কলেজে ইকনমিক্সে অনার্স নিয়ে পড়তে। দিল্লি গেল কারণ ওর বাবার দিল্লিতে বদলি হয়েছে।
এখানে বলে রাখি, সুবর্ণরেখার সঙ্গে আলাপের পর থেকে বাবা-মায়ের বদলে প্রতি বছর ওর সঙ্গেই আসি জিশুমেলায়। তবে গত বছর এই রিচুয়ালে ছেদ পড়েছিল। কারণ ও দিল্লি থেকে আসতে পারেনি। আমি একাই এসেছিলাম।
ফ্ল্যাশব্যাক মোড থেকে এত ক্ষণে বর্তমানে ফেরা গেছে। এক বছর পরে আজ আর এক ক্রিসমাস ইভ। আবার সীমা আন্টির স্টল! সুবর্ণরেখার সঙ্গে দেড় বছর পর দেখা হবে। ও দিল্লি থেকে আসছে! কলেজে ভর্তি হওয়ার পর এই আমাদের প্রথম সাক্ষাত।
দেখা না হলেও রোজই যোগাযোগ ছিল ভিডিয়ো কল, অডিয়ো কল আর মেসেজের মাধ্যমে। আজকালকার দিনে লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপ কোনও ব্যাপার নাকি?
তবে গত তিন মাস ওর সঙ্গে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। লেখাপড়ার এমন চাপ যে ‘ভিসি’ করতে পারছে না। অডিয়ো কলেও কথা হচ্ছে না। মেসেজের উত্তরে ইমোজি পাঠায়। দ্যাট ইনফেমাস, নন-কমিটাল স্মাইলি!
পড়ার চাপ কি আমারও নেই? আছে। কিন্তু ভালবাসার মানুষের জন্যে দিনে দশটা মিনিট বার করাই যায়।
এই যে! সুবর্ণরেখা এসে গেছে। পরনে জলপাই সবুজ রঙের পুলওভার আর জিন্স। পুলওভারের হাতা অনেকটা লম্বা বলে হাতের আঙুলগুলো দেখা যাচ্ছে না। চুলে টপ-নট, পায়ে ফ্ল্যাটহিল। কী কিউট যে লাগছে!
ও সীমা আন্টিকে দেখে হাত নাড়ল। আমার সামনে বসে প্লেটে রাখা তিন টুকরো কেক থেকে একটা টুকরো তুলে মুখে পোরার আগে বলল, “তিলু, তোর সঙ্গে সিরিয়াস কথা আছে।”
*****
“কী তোর সিরিয়াস কথা? তাড়াতাড়ি বলে ফেল! তার পর বেলুন ফাটাতে যাব...” সুবর্ণরেখার দিকে তাকিয়ে বললাম। দেড় বছর পরে ওকে দেখে আশ আর মিটছে না। মেয়েটা আরও সুন্দরী হয়েছে! কিউটনেসের ডাব্বা!
সীমা আন্টি কফি দিয়েছেন। কেক শেষ করে, কফিতে চুমুক দিয়ে সুবর্ণরেখা বলল, “বেলুন পরে ফাটাস। আগে যা বলছি শোন। দিল্লিতে গিয়ে, আই অ্যাম ইন লাভ উইথ সামবডি। ওর নাম সন্দীপ সেন। ডাকনাম স্যান্ডি। তোর সঙ্গে স্যান্ডি আলাপ করতে চায়।”
মাইকে ভেসে আসছে আট পা-ওয়ালা মাকড়সা-মানবীর ভয়ঙ্কর খেলা দেখার আমন্ত্রণ। চিৎকারের মধ্যে শুনতে পেলাম না সুবর্ণরেখা কী বলল। কান বাড়িয়ে চিৎকার করলাম, “কী?”
“আমি। স্যান্ডিকে। ভালবাসি।” পাল্টা চিৎকার করে, কেটে কেটে বলল সুবর্ণরেখা।
ও পাঠক! আমি প্রথমবারই কথাগুলো শুনতে পেয়েছিলাম! শুনতে চাইনি বলে না-শোনার ভান করেছি। দ্বিতীয় বার একই কথা শুনে মাথা ঘুরে গেল। মনে হল বরফ-ঠান্ডা অ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যে কেউ আমাকে ফেলে দিয়েছে। আমি আবছা দেখছি! আবছা শুনছি। খুব শীত করছে! এগুলো দুঃস্বপ্ন, তাই না? চিমটি কেটে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দাও পাঠক! প্লিজ় ঘুম ভাঙিয়ে দাও।
জলের মধ্যে হাঁকপাঁক করতে করতে দেখলাম, ছ’ফুট লম্বা, বলিষ্ঠ চেহারার এক ছোকরা এসে সুবর্ণরেখার পাশে বসল। (কী সাহস! আমার পারমিশান পর্যন্ত নিল না!) চুলে বাজ় কাট, ক্লিন শেভন, এক কানে স্টাড, পরনে লুজ় ফিট রিপ্ড ডেনিম আর কালো হুডেড জ্যাকেট। পায়ে লাল টকটকে স্নিকার্স।
“আলাপ করিয়ে দিই,” বলল সুবর্ণরেখা, “এ হল স্যান্ডি সেন। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার। আর এ হল তিলু মিত্তির, স্কুলের বন্ধু।”
আমার জায়গায় তুমি থাকলে এই পরিস্থিতিতে কী করতে, পাঠক? নির্ঘাত সন্দীপের গায়ে গরম কফি ছুড়ে বলতে, ‘তোর জন্যেই গত তিন মাস সুবর্ণরেখা আমার সঙ্গে কথা বলছিল না? চল বে! ফোট!’ অথবা সুবর্ণরেখার দিকে ঘেন্নার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতে, “শাঁসালো বরের খোঁজ পেতেই আমাকে বিট্রে করলি? তুই জাস্ট মরে যা!’ অথবা নিজের মাথাটা সীমা আন্টির মাইক্রোআভেনে ঢুকিয়ে প্রবল যন্ত্রণায় জ্বলতে-জ্বলতে পুড়তে-পুড়তে মারা যেতে। তাই না?
আমি এ সব কিছুই করে উঠতে পারলাম না। তার বদলে এক গ্লাস জল ঢকঢক করে খেয়ে বললাম, “তোমাদের আলাপ হল কী করে?”
“সোশ্যাল মিডিয়া!” আমার প্রশ্ন শুনে ভুরু তুলে বিস্ময় প্রকাশ করল যমের অরুচি সন্দীপ। যেন অঙ্কের শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে ‘টু প্লাস টু কত হয়?’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “লাইক, ফলো, চ্যাট, রিয়্যাল মিট। কলকেতা, ডায়মন্ড হারবার, রানাঘাট, তিব্বত! ব্যস্। সিধে রাস্তা!”
বাবা! শুয়োরটা আবার সুকুমার রায় আওড়ায়! এখনই ঘুসি মেরে ব্যাটার মুখ ফাটিয়ে দিই? এক বার পারমিশন দাও, পাঠক...
সন্দীপ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি জানি তোমার সঙ্গে সুবুর একটা রিলেশনের মতো ছিল। সেটা আর নেই।”
সুবু? আমার সুবর্ণরেখা কবে থেকে তোর ‘সুবু’ হয়ে গেল রে শুয়োর?
“ও পাস্ট অ্যাফেয়ারের কথা আমাকে বলেছে। এতে আমি হ্যাপি।” সন্দীপ বকেই যাচ্ছে। আমি ভেবে চলেছি, কবে থেকে আমি সুবর্ণরেখার ‘পাস্ট’ হয়ে গেলাম?
ছোকরা বলছে, “আমিই তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছিলাম। সুবু বলল, ‘তা হলে ক্রিসমাসে আমিরপুর চলো। দারুণ একটা মেলা দেখাব। এক্সের সঙ্গে আলাপও করিয়ে দেব।’”
আমি বিড়বিড় করলাম, “এক্স...” মুখে বললাম, “নাইস মিটিং ইউ।” তার পর মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের মতো হাসলাম। মানে... আমি জানি যে, মৃত্যুপথযাত্রীরা হাসে না! কিন্তু এর থেকে ভাল উপমা তখন মনে পড়ছিল না।
“তোমাকে দেখে বোঝা যায় যে তুমি ভাল মানুষ।” বলল সন্দীপ।
আমি পাক্কা ইডিয়টের মতো শালপাতার প্লেট বাড়িয়ে বললাম, “খাও।”
সন্দীপ নাক কুঁচকে বলল, “আমি মিষ্টি অ্যাভয়েড করি। কিন্তু তুমি যখন বলছ...” তার পর এক টুকরো কেক মুখে পুরল।
নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে বললাম, “তুমি কি দিল্লিতে থাকো?”
আবারও কাঁধ ঝাঁকায় সন্দীপ, “আমাদের বাড়ি জিকে। আই মিন গ্রেটার কৈলাস। নেক্সট ইয়ারে সুবুকে নিয়ে ইউকে শিফ্ট করছি। তাই তো, সুবু?”
সুবর্ণরেখা উৎসাহভরে ঘাড় নেড়ে জানাল যে ও ইংল্যান্ডেই থাকতে চায়।
আমি মনে মনে বিড়বিড় করছি, ‘ও সুবর্ণরেখা! আমার কোথায় ভুল ছিল? তুমি বলে যাও। আমার কি তোমাকে আরও ভালবাসা উচিত ছিল? আমার কি তোমাকে আরও গিফ্ট দেওয়া উচিত ছিল? আমার কি তোমার সঙ্গে শারীরিক ভাবে ঘনিষ্ঠ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল? বলে যাও! প্লিজ় বলে যাও!’
পঁয়ত্রিশ বছরের আমি জানি যে, এ সব প্রশ্নের উত্তর কোনও দিনও পাওয়া যায় না! আমি তখন বাচ্চা ছিলাম।
চেয়ার থেকে উঠে সন্দীপ বলল, “থ্যাঙ্কস ফর দ্য কেক।”
সুবর্ণরেখা বলল, “বাই তিলু। আমরা যাচ্ছি!”
গভীরতর জলে তলিয়ে যেতে যেতে বললাম, “যাই বলতে নেই, বলো আসি।”
*****
ও পাঠক, তুমি তো জানো যে আমি আদৌ তলিয়ে যাচ্ছিলাম না। অসহায়তা বোঝানোর জন্যে ও সব বলা। আমি তখন টেবিলে দু’হাত রেখে তার মধ্যে মুখ গুঁজে কান্না চাপার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলাম। সম্বিত ফিরল সীমা আন্টির গলার আওয়াজে, “এটা ফেলে রেখেছ কেন? খেতে ভাল হয়নি?”
মাথা তুলে দেখলাম প্লেটে এক টুকরো কেক পড়ে রয়েছে।
“খুব ভাল খেতে হয়েছে!” নিজেকে সামলে উত্তর দিলাম।
“ওরা কোথায় গেল?” জানতে চাইলেন আন্টি।
এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। প্রসঙ্গ বদলাতে প্রতিপ্রশ্ন করলাম, “এই কেক তুমি কত বছর ধরে বানাচ্ছ, আন্টি?”
“বারো-চোদ্দো বছর বয়স থেকে...” খদ্দেরকে কেক দিচ্ছেন আন্টি। “সুবিনয়ের প্রেমে পড়ার পরে ওকে ইমপ্রেস করার জন্যে আরও ভাল কেক বানানোর চেষ্টা করতাম। যে কোনও রান্নায় যা-যা উপাদান লাগে, তার সঙ্গে রাঁধুনির ভালবাসা না-মিশলে পদটা অ্যাভারেজ থেকে যায়। অসাধারণ হতে পারে না। বড়দিনে সুবিনয়ের জন্যে যখন কেক বানাতাম তখন ময়দা, চিনি দুধ, মাখন, ডিম আর বেকিং সোডার সঙ্গে অনেকটা ভালবাসা মিশিয়ে দিতাম। এক টুকরো মুখে দিয়েই সুবিমল বলত, ‘এক্সেলেন্ট! তোমার কেক আর তুমি— আমার জীবনে দুটো মাত্র লাভ অ্যাফেয়ার।’ শুনে খুব ভাল লাগত, জানো তিলু।” একটু থেমে আন্টি বললেন, “আজ সুবিনয় না থাকলেও অসাধারণ কেক বানানোর অভ্যেসটা রয়ে গেছে।”
মাথায় কী ভূত চাপল কে জানে! জিজ্ঞেস করে ফেললাম, “আচ্ছা আন্টি, সুবিনয় আঙ্কলের সঙ্গে তোমার কী হয়েছিল?”
“কী আর হবে!” ম্লান হাসলেন আন্টি, “এক দিন জানতে পারলাম যে, এখানকার ডাকসাইটে সুন্দরী লতারানি তেসরার সঙ্গে ওর লটঘট চলছে। মেয়েটার সঙ্গে রাজারহাটের ফ্ল্যাটে থাকে। সুবিনয়কে চেপে ধরায় নির্লিপ্ত মুখে বলল আমার প্রতি ওর ভালবাসা নাকি মরে গেছে।” শালের খুঁটে মুখ মুছে, ফিক করে হেসে আন্টি বললেন, “সেটা শুনে আমি বলেছিলাম, ‘তোমার প্রতি আমার যত্ত ভালবাসা ছিল, সব এক্ষুনি কলেরা হয়ে মরে গেল গো! যাও, এ বার উকিলের কাছ থেকে একটা ডেথ সাট্টিফিকেট নিয়ে এসো।’ তার পর আর কী? ডিভোর্স! তবে সেই দিন থেকেই সুবিনয় আর আমার জীবনে নেই। যেমন আজ থেকে তোমার জীবনে সুবর্ণরেখাআর রইল না।”
চমকে উঠে আন্টির দিকে তাকালাম। আন্টি মৃদু হেসে বললেন, “আমি সবটাই শুনেছি।”
আবার প্রসঙ্গ বদলাতে হবে। বললাম, “তোমার কেকের রেসিপিটা বলো না আন্টি!”
“কেকের রেসিপি তো আর বলতে পারি না।” পর পর তিন জন খদ্দেরকে কেক বিক্রি করে ফিরে এলেন আন্টি। “তার বদলে ভাল থাকার একটা সিক্রেট রেসিপি বলি? দাঁতে দাঁত চেপে আজকের দিনটা কাটিয়ে দাও।”
“এটা কী রকম রেসিপি?” আমি অবাক।
“তোমার জীবনের সব থেকে অন্ধকার রাত হল আজকের এই রাত। শীতকালে দিন ছোট, রাত বড়। কিন্তু যত বড় রাতই হোক না কেন, ঠিক সকাল হবে। দেখবে, কালকের সকালটা আজকের থেকে কম খারাপ। পরশু দুপুরে মন খারাপ আরও কমবে। আমি এই ধাপগুলো জানি। কারণ আমি এগুলোর মধ্যে দিয়ে গেছি। সুবিনয়কে ভুলতে মাস তিনেক সময় লেগেছিল। ডিভোর্সের এক বছরের মাথায় মহেশ ডিক্রুজ়কে বিয়ে করি। এখন দিব্যি আছি। আমি তোমাকে লিখে দিচ্ছি, সুবর্ণরেখার প্রত্যাখ্যান ভুলতে তোমার বড়জোর মাস ছয়েক লাগবে।”
“বলছ?” আমি হাউহাউ করে কাঁদছি।
“বলছি। এটাও বলছি যে তার পর তোমার জীবনে নতুন প্রেম আসবে। যাও, এখন বাড়ি যাও।”
আমি চেয়ার থেকে উঠে কেক আর কফির দাম মেটালাম। উদ্ভ্রান্তের মতো মেলা থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরলাম। রাত্তিরে মনে পড়ল, কেকের অন্তিম টুকরোটি সীমা আন্টির দোকানে ফেলে এসেছি।
*****
হে পাঠক, গল্পের শুরুতেই বলেছিলাম যে আমি গুরুগ্রামে থাকি। যা বলিনি, তা হল আমার ফ্ল্যাটের নাম ‘গাঁও।’ স্থানীয় উচ্চারণে গুরুগ্রামকে ‘গুড়গাঁও’ বলে। তাই আমার স্ত্রী লীলা আমাদের ফ্ল্যাটের নাম দিয়েছে ‘গাঁও।’
গাঁওয়ের বাসিন্দা বলতে আমার বৌ আর এক ছেলে। পিকলুর বয়স চার। ওদের নিয়ে দিব্যি আছি।
গল্পটা এ বার শেষ করতে হবে, তাই তো, পাঠক? তা হলে, টু কাট আ লং স্টোরি শর্ট, সুবর্ণরেখার আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সেই সন্ধে থেকে আজকের মধ্যে যে ক’টা বছর গড়িয়েছে তার মধ্যে আমি লেখাপড়ার পাট শেষ করেছি, মোটামুটি ভাল চাকরি পেয়েছি, কয়েকবার চাকরি বদলে এখন ঠিকঠাক জায়গায় আছি।
‘দিব্যি আছি।’ ‘ঠিকঠাক আছি।’ এক্ষুনি বললাম। এবং এগুলো সত্যি কথা। পাশাপাশি এটাও সত্যি যে, সমস্ত সফল প্রেম এক দিন অভ্যাসে পরিণত হয়। যেমন হয়েছে লীলার সঙ্গে আমার বৈবাহিক সম্পর্ক। কিন্তু ব্যর্থ প্রেমের ভার আজীবন বহন করতে হয়, যেভাবে জিশু অন্তিম যাত্রায় নিজের ক্রস বহন করেছিলেন।
যখনই শীতকাল আসে, কুয়াশায় ঢেকে যায় চরাচর, ঘাসের উপরে শিশিরবিন্দু দেখা যায়, কথা বললে মুখ থেকে ধোঁয়া বেরোয়; যখন আকাশে ওড়ে পরিযায়ী পাখির ঝাঁক, ‘একদিন দল বেঁধে ক’জনে মিলে’ হাইওয়ে ধরে ম্যাটাডরে চেপে পিকনিক করতে যায়; যখন কড়াইশুঁটির কচুরি, আলুর দম, জয়নগরের মোয়া, নতুন গুড় আর কমলালেবুর সুঘ্রাণ সবাইকে ঘিরে ধরে... ঠিক তখনই আমার মনে পড়ে সুবর্ণরেখার কথা। সে এখন কোথায়, জানি না। জানতে চাইও না। আমি দিন তিনেকের জন্যে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে প্লেন ধরি। অফিস জানে, লীলাও জানে যে জারুলতলার গাঁয়ের বাড়ির বাৎসরিক দেখাশোনা করতে যাচ্ছি।
পাঠক, তুমি জানো যে এটা ছুতো। আসলে আমি ফিরে ফিরে আসি সীমা আন্টির স্টলে। কেকের যে টুকরোটা ফেলে গিয়েছিলাম, সেটা খুঁজতে। এক টুকরো ব্যর্থ প্রেম না থাকলে, জীবন স্বাদু হয় না যে!
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে