ঠাকুর দেখতাম না, স্টল দিতাম

বিক্রি করতাম ছবি, গ্রিটিং কার্ড। বন্ধুর পীড়াপীড়িতে এক ক্লাবের পুজোয় ঠাকুর গড়লাম। চতুর্থীর বিকেলে অবাক হয়ে দেখি, বিরাট লম্বা লাইন প্যান্ডেলে ঢুকছে, আমারই গড়া ঠাকুর দেখতে! ভবতোষ সুতারবিক্রি করতাম ছবি, গ্রিটিং কার্ড। বন্ধুর পীড়াপীড়িতে এক ক্লাবের পুজোয় ঠাকুর গড়লাম। চতুর্থীর বিকেলে অবাক হয়ে দেখি, বিরাট লম্বা লাইন প্যান্ডেলে ঢুকছে, আমারই গড়া ঠাকুর দেখতে! ভবতোষ সুতার

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৪৪
Share:

—ফাইল চিত্র।

আমাদের বন্ধুদের একটা দল ছিল ‘চাঁদের হাট’ নামে, এখন যেটা বেশ বিখ্যাত। তখন আমাদের কম বয়স, কবীর সুমন-জয় গোস্বামী-প্রতুল মুখোপাধ্যায়-বাদল সরকার আমাদের পথপ্রদর্শক, গভীর রাত পর্যন্ত আমরা গান, ছবি, কবিতা, নাটক নিয়ে চর্চা করি। এই সব নিয়েই থাকতাম। শিল্পকে আমরা সংস্কৃতি থেকে বাদ দিয়ে ভাবতাম না। সামাজিক দিকটাও ভাবতাম— পাশের মানুষটার খেয়াল রাখব, কাজ করব... আমরা পুজোর সময় প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখতে ঘুরতাম না। কিন্তু স্টল দিতাম। ছবি, গ্রিটিং কার্ড বিক্রি করতাম, হাতে-লেখা পত্রিকা বার করতাম। এ রকমই এক বার, চা খেতে খেতে কী মনে করে বাড়ির কাছেই বড়িশার একটা ক্লাবে ঢুকে পড়লাম। দেখি, অসাধারণ এক দুর্গাপ্রতিমা! সম্ভবত সেই প্রতিমা গড়েছিলেন মোহনবাঁশি রুদ্রপাল। দেখে আমার মনে হল, আমাকেও এ রকম একটা ঠাকুর গড়তে হবে।

Advertisement

ঘটনাচক্রে তার বছর দুয়েক পরেই, ২০০০ সালে সুযোগ এল। সে বছরেই আমি গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে ভাল রেজ়াল্ট নিয়ে পাস করেছি। দেশে, বিদেশেও অ্যাপ্লাই করছি পরের পড়াশোনার জন্য, ডাকও আসছে, ছবিও বিক্রি হচ্ছে। সেই সময়েই এমন সুযোগ। এক বন্ধু বলল, তোকে একটা ঠাকুর গড়ার কাজ নিতে হবে। বড়িশার একটা ক্লাবেই। প্রথমে করতে চাইনি, ওর পীড়াপীড়িতে কাজটা নিলাম। ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা বাজেট পুজোর, সব মিলিয়ে। কাজ শুরু হল, সে এক ভয়ঙ্কর উন্মাদনা। আমাদের তখন এমন কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই কোনও, কিন্তু প্রচণ্ড উৎসাহ আছে। সব ঢেলে দিয়েই করলাম। নিজেরাই রাত জেগে প্লাস্টার অব প্যারিসের কাজ করছি, দাড়িগোঁফ সব চুনে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে, সকালে পুকুরে গিয়ে চান করেও ছাড়ানো যাচ্ছে না, কাজ করতে গিয়ে চশমা ভেঙে যাচ্ছে, এমন অবস্থা। ঠাকুর গড়া শেষ হল এই সবের মধ্যেই।

চতুর্থীর দিন বিকেলে বাড়ি থেকে প্যান্ডেলের দিকে যাচ্ছি। শখেরবাজারের পর থেকেই দেখছি, দুটো লম্বা লাইন, দু’দিকে মুখ করা। অবাক হয়ে দেখলাম, এই লাইন যাচ্ছে আমার প্যান্ডেলে! আমার ঠাকুর দেখতে! সেই প্রথম আমার ভিতরটা কে যেন নাড়া দিয়ে গেল। ভাবলাম, আমি কী করেছি যে এত মানুষের কাছে খবর চলে গেছে, এত মানুষ লাইন দিয়ে আমার গড়া ঠাকুর দেখতে আসছেন! এই ঘটনাটাই একটা টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়াল আমার কাছে। আমি বুঝলাম, পুজোয় ঠাকুর গড়াটা একটা বিরাট প্ল্যাটফর্ম; কাজ করার একটা দুর্দান্ত সুযোগ।

Advertisement

পরের বছরেও সুযোগ এল। এটা অন্য একটা ক্লাব। গত বারের ক্লাবের কাছে এ বার ২৫ হাজার টাকা চেয়েছিলাম ঠাকুর গড়তে, কিন্তু ওঁরা রাজি ছিলেন না। এ বার যোগাযোগটা বিখ্যাত শিল্পী অমর সরকারের সূত্রে, উনিই আমাকে নিয়ে গেলেন নতুন ক্লাবের কর্মকর্তার কাছে। কথাবার্তা হল। আমাকে জিজ্ঞেস করা হল ঠাকুর গড়তে আমি কত টাকা চাই। আমি বললাম, আমার ২৫ হাজার টাকা চাই। সেই কর্মকর্তা দাদাটি বললেন, এই দেখো আগের বারের ঠাকুরের ছবি, কী সুন্দর। যিনি বানিয়েছিলেন তিনি ১৫ হাজার নিয়েছিলেন, আর তুমি ২৫ হাজার চাইছ! আমার সে বার একটা রোখ চেপে গিয়েছিল। ওঁকে বললাম, আপনি একটা কাজ করুন। আমাকে কোনও টাকা দিতে হবে না। আপনি খড়, মাটি, দড়ি, রং— যা যা লাগবে, সব কিনে আমাকে দিয়ে দিন। আমি ঠাকুরটা বানাই, তার পর প্রতিমা দেখে আপনার যা মনে হবে, আপনি আমাকে তা-ই দেবেন। ওঁদের ব্যাপারটা মনে ধরল। এ তো উত্তম প্রস্তাব— আগে কাজ দেখি, ঠাকুর দেখি, তার পর টাকাপয়সার ব্যাপার! মানে ওঁদের নিয়ন্ত্রণেই থাকছে পুরো ব্যাপারটা।

ঠাকুর গড়া শেষ হল। নিজের কাজের কথা নিজে বলতে বাধে, কিন্তু সে বার পুজো উদ্বোধনের পর থেকেই, দ্বিতীয়া-তৃতীয়া থেকেই মানুষের ঢল নামল প্রতিমা দেখতে। ‘কলকাতার সাবেকি প্রতিমায় বিরাট ধাক্কা’ গোছের শিরোনাম বেরিয়েছিল কাগজগুলোয়। সাধারণ মানুষ কাতারে কাতারে এসেছিলেন ঠাকুর দেখতে, এসেছিলেন পণ্ডিত শিল্পবোদ্ধারাও। মনে আছে, সেই সময় শ্রদ্ধেয় শিল্পী শুভাপ্রসন্ন প্রতিমা দেখতে এসে আমাকে বলেছিলেন, শোনো, আমি যখন তোমার গড়া প্রতিমা দেখছি, তখন কখনও মনে হচ্ছে যে আমি বাংলার পটচিত্র দেখছি, কখনও মনে হচ্ছে যেন যামিনী রায়ের কাজ দেখছি, কখনও মনে হচ্ছে ওড়িশার শিল্পসুষমা ফুটে উঠছে মনের মধ্যে। আবার কখনও মনে হচ্ছে এগুলোর কোনওটাই দেখছি না, একেবারে অন্য রকম, নতুন কিছু দেখছি। একটা প্রতিমার মধ্যে এ রকম নানান সংঘটন দেখেছিলেন গুণিজনেরা। আর ঠাকুর দেখতে আসা মানুষের ভালবাসা তো পরম পাওয়া। আজ তো থিমের পুজো আমাদের কাছে জলভাত, খুব পরিচিত একটা বিষয়। সে দিন এই ‘থিম’ ব্যাপারটাকে গড়গড়িয়ে শুরু করার ব্যাপারে আমার তৈরি করা ঠাকুর প্রভাবিত করেছিল, এমনও আমাকে বলেছেন অনেকে। আমি নিজে খেয়াল করে দেখেছি, সত্যিই এর পরে কুমোরটুলিতে ঠাকুর গড়ার আঙ্গিকে বদল আসছে, এসেছে। ‘ঠাকুর গড়া’-র মধ্যে জিয়োমেট্রির ব্যবহার তার আগে তেমন খুব একটা ছিল না। আমার গড়া ঠাকুরের মধ্যে এই জিয়োমেট্রির ব্যাপারটা আমি ব্যাপকভাবে রেখেছিলাম। পরে দেখেছি, কুমোরটুলিতে শিল্পীদের হাতে সেই কাজ উঠে আসছে। এও তো কম আনন্দ নয়।

সে বার পুজো শেষে সেই ক্লাব কর্তৃপক্ষ আমাকে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছিল। শিল্পীদের কিন্তু অর্থের প্রয়োজন হয়। আমি নিজে একটা হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলে, আমি জীবনে পয়সাকড়ির গুরুত্ব বুঝি। সে তো পেলামই, কিন্তু আমার আর একটা যাত্রাও শুরু হল সেই থেকে। প্রার্থিত সম্মান এল, মানুষজন একটু ঘুরে তাকাতে শুরু করলেন, তারিফ করতে থাকলেন— কালো, রোগা এই ছেলেটার হাতে ‘কাজ’ আছে। আর এর পর থেকে শুরু হল আমার গ্রামগঞ্জ ঘুরে ঘুরে শিল্পীদের কাজ দেখা, সেখান থেকে ভাবনা জোগাড় করা। আগে আমি ঠাকুর গড়ার কাজটাকে শুধু একটা দিক দিয়ে, সীমিত পরিসরে ভাবতাম। এ বার থেকে শুরু হল নানান দিক থেকে দেখা, ভাবা। গ্রামের মানুষের, শিল্পীদের সঙ্গে মেলামেশা, সংযোগ বাড়ল আমার। আমি তাঁদের ‘হাত’, তাঁদের ‘কাজ’ তুলে এনেছি আমার প্রতিমায়। পুজোয় ঠাকুর গড়া আমাকে একটা ‘বড় আমি’-র সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়— প্রতি বছরই।

অনুলিখন: শিশির রায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন