ডেলি প্যাসেঞ্জার

কেউ ট্রেনে উঠেই ঘুমিয়ে পড়েন, কেউ বাসে উঠে কন্ডাক্টরের সঙ্গে ঝগড়ার জন্য মুখিয়ে, কেউ লঞ্চ দেখলেই লং জাম্প।অফিস টাইম। লোকাল ট্রেনে তুমুল ভিড়। শেষ কম্পার্টমেন্টের শেষ দিকে প্রায় জনা দশেকের একটি টিম, বিভিন্ন বয়েসের, খুব হইহই করছে। দু-তিন জনের হাতে বেশ বড় সাইজের একটি করে মিষ্টির প্যাকেট, হাত-চালাচালি হয়ে ঘুরছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে প্যাকেটগুলো শেষ হতেই সবাই বলে উঠল— আবার কবে হবে বোসদা? ‘এ বার পেটাব!’ বলে উঠলেন বোসদা।

Advertisement

বিনোদ ঘোষাল

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৫ ০২:৪৩
Share:

মিষ্টিমুখ

Advertisement

অফিস টাইম। লোকাল ট্রেনে তুমুল ভিড়। শেষ কম্পার্টমেন্টের শেষ দিকে প্রায় জনা দশেকের একটি টিম, বিভিন্ন বয়েসের, খুব হইহই করছে। দু-তিন জনের হাতে বেশ বড় সাইজের একটি করে মিষ্টির প্যাকেট, হাত-চালাচালি হয়ে ঘুরছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে প্যাকেটগুলো শেষ হতেই সবাই বলে উঠল— আবার কবে হবে বোসদা? ‘এ বার পেটাব!’ বলে উঠলেন বোসদা। খাওয়ানোর কারণটা জানা গেল একটু পরে। এই টিমটা রোজই এই ট্রেনেই ওঠে। বিভিন্ন স্টেশন থেকে। তার পর যে কোনও ছুতোয় এক এক দিন এক এক জনকে খাওয়াতে হয়। তার মধ্যে বাড়ির বিড়ালে বাচ্চা দিয়েছে থেকে নতুন কাজের মাসি পাওয়া গেছে অবধি সব আছে। তবে আজকেরটা স্পেশাল। পরশু দিন বোসদার বাড়িতে রাতে চুরি হয়েছিল। ব্যস, খাওয়াতে হল!

Advertisement

‘একটু চেপে বসুন’

এঁরা চির কালের সাচ্চা প্রলেতারিয়েত। চৌত্রিশ বছরের চাকরি জীবনে হয়তো চৌত্রিশ বার ট্রেনে ভাল সিট পেয়েছেন। জানলার ধারে সিট পান একমাত্র জানুয়ারির রাত্রে বাড়ি ফেরার সময়। নইলে বছরভর চতুর্থ ব্যক্তি। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ওই আগের তিন জন, যাঁরা ঠিকঠাক বসেছেন। তাঁদের দিকে ক্রমাগত সামনে ও পিছন দিয়ে উঁকি মারা এবং বলে যাওয়া ‘দাদা একটু চেপে বসবেন, আর একটু চেপে বসুন না।’ কেউই সরেন না। শরীরটা সামান্য দুলিয়ে ‘এই সরলাম’ ভাব করেন।

দাঁড়িয়ে আছ তুমি...

সবাই যখন লাফিয়ে, খামচে, কনুই মেরে সিট দখলের লড়াইতে নামেন, তখন এঁরা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং ট্রেন ছাড়ার পর টুক করে উঠে দরজার ধারে দাঁড়ান। সমীক্ষায় দেখা গেছে এই শ্রেণির অধিকাংশই বাংলা ব্যতীত অন্য ভাষায় কথা বলেন, এঁদের মুখে থাকে গুটখা, চুল লালচে, চেহারা রোগা, দাঁতে ছোপ, এবং এঁদের দেখলে মনে হয় জীবনে কোনও মনখারাপ নেই। শুরুতেই যিনি মহার্ঘ সিট ত্যাগ করতে পারেন তাঁর অবশ্য কষ্ট না থাকাই স্বাভাবিক। ট্রেন চলাকালীন এঁরা বডির অধিকাংশ বাইরে ঝুলিয়ে নানা রকম সার্কাস দেখান, বসে থাকা প্যাসেঞ্জারদের হার্টবিট বাড়িয়ে দেন। এঁদের হাতে থাকে মাইকের থেকেও উচ্চকিত চৈনিক মোবাইল। তাতে দুর্বোধ্য ভাষায় গান হয় এবং এঁরা তালে তালে সোল্লাসে ট্রেনের বডিতে দুমদাম পেটান। প্রতি স্টেশনে নেমে দাঁড়ান এবং প্যাসেঞ্জার ওঠা-নামার পর আবার ট্রেন স্পিড নিলে উঠে পড়েন। কেউ কেউ কখনও এই ট্রাপিজ দেখাতে গিয়ে খসে যান। ট্রেন চলতে থাকে।

ও অন্যান্য

আছেন ভেন্ডরবিলাসী, এঁরা জেনারেল কম্পার্টমেন্ট ফাঁকা থাকলেও ওঠেন না। চারাপোনা এবং ছানার গন্ধ আমোদিত ভেন্ডর-এর কামরাই এঁদের প্রিয়, তার একটা কারণ: এই বগিতেই নিয়মের কড়াকড়ি একটু কম। ধূমপান ও অন্যান্য খেয়ালখুশির বাধানিষেধ নেই বললেই চলে।

আছেন সন্দিহান, এঁদের সব সময় মনে হয় সবাই তাঁকে পিছন থেকে ঠেলছেন।

আছেন কুম্ভকর্ণ। সিটে বসামাত্র নাক ডাকতে শুরু করেন। ট্রেন তাঁর গন্তব্যে পৌঁছনো মাত্র কোনও অলৌকিক প্রক্রিয়ায় ঘুম ভেঙে যায়! অবশ্য ক্যাবলা কুম্ভকর্ণও আছেন, বার বার পাশে বসা সহযাত্রীর ঘাড়ে কাটা কলাগাছের মতো হেলে পড়তে থাকেন, স্টেশন এলে ডেকে তুলে দিতে হয়।

বাসের বাসি

এঁরা বাসে উঠেই টিকিটের ন্যায্য মূল্যের থেকে এক বা দু-টাকার কম টিকিট কাটেন। কন্ডাক্টর যখন একটা নির্দিষ্ট স্টপ পেরিয়ে যাওয়ার পর বলেন, ‘কই, আপনি যে ছ-টাকার কাটলেন, নামলেন না তো?’, ঝগড়া শুরু। ‘কী করে হয়? এত দিন ধরে যাতায়াত করছি? এই কালও ছ-টাকায় গেছি, আজ আট টাকা হল কী করে?’ কন্ডাক্টর চার্ট দেখতে বলেন এবং তাঁরা চার্টের পরোয়া করেন না। উলটে চার্জ: ‘তা হলে কি আমি মিথ্যে বলছি?’ বাস কখনও ট্রাফিক সার্জেন্টের হাতে ‘কেস খেলে’ এঁরা এত মস্তি পান যে প্রোমোশন আটকে যাওয়া কিংবা মেয়ের ‘বিয়ে করলে নুলোদাকেই করব’-র দুঃখ ভুলে যান। খা শালা আরও খা। বাসটাও জ্বালিয়ে দে পারলে। গোটা রাস্তা ঘ্যাতোর ঘ্যাতোর করে চলছে। সব বাস পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। এই ব্যাটাই খালি বাঁ দিক চাপছে আর দাঁড়াচ্ছে বার বার।

বঞ্চিত বাঞ্ছারাম

এঁরা বাসে উঠে কোনও দিন এক চান্সে সিট তো পানই না, উলটে যেখানে দাঁড়ান, সামনে বসা যাত্রীদের কেউ ওঠার নাম করেন না। একেবারে ফেভিকল কেস। এঁরা ‘বসে যাওয়া’ যাত্রীদের কড়া নজরে অবজার্ভ করেন, তার পর কাউকে ‘এই নামব’ টাইপ উসুখুসু দেখলেই ভিড় ঠেলে কায়দা করে সেখানে গিয়ে দাঁড়ান। এবং দেখা যায় আগে যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেখানকার বসে থাকা যাত্রীরা সব একে একে নেমে যাচ্ছেন এবং পরে ওঠা প্যাসেঞ্জাররা সেই সব সিটে টপাটপ বসে পড়ছেন। আর তাঁর ‘এই নামব’রা পুরো রাস্তাই বসে মেরে দিলেন।

জগদ্দল

বাসে ওঠামাত্র সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়েন। নট নড়ন চড়ন। এঁদের চেহারাও সাধারণত সম্ভ্রম উদ্রেককারী হয়। কন্ডাকটর প্রথমে বেশ কিছু ক্ষণ ‘দাদা পিছনের দিকে এগোন’ বলার পর কোনও কাজ না হওয়ায় যেই এক বার গায়ে সামান্য হাত দিয়ে ঠেলেন, ব্যস, কুরুক্ষেত্র! ‘তুই গায়ে হাত দিলি কেন!’ এবং ব্যাপার হুংকারেই থেমে থাকে না।

বেওসাদার

সাধারণত একটু বেলার দিকে বাসে ওঠেন। বড় বড় বস্তা বাসের হেল্পারের হেল্পে টপাটপ তুলে ফেলেন। প্যাসেঞ্জার দাঁড়াতে পারল কি না, সে সব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামান না। শুধু বস্তা নয়, ছানার বাঁকও ওঠে, ছানার জল গড়িয়ে বাসময় হয়ে যায়। এবং অপূর্ব সুবাসে গোটা বাস ভরে যায়। এঁদের কোনও টিকিটের বালাই নেই। পুরোটাই কাঁচা হিসাব। কন্ডাক্টরের সঙ্গে রোজই দর কষাকষি হয়। তার পর বড়বাজার আসতেই কুলিরা বাস লক্ষ্য করে দৌড় দেয় এবং মাল বাস থেকে পড়ামাত্র তাঁরা কুলিদের মাথায় মাল চাপিয়ে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যান।

লং জাম্পার

এঁরা লঞ্চের সওয়ার। হনুমানও বলা যেতে পারে। সীতা মাইয়ার খোঁজে এক লাফে সাগর টপকে স্বর্ণলঙ্কায় ল্যান্ড করলেন হনুমানজি, সেই অনুপ্রেরণায় চলেছেন। জেটিতে লঞ্চ লাগার আগে থেকেই এমন লম্বা লম্বা সব লাফ, প্র্যাকটিসটা আর একটু জোরালো হলে লঞ্চ-ভাড়াটা পুরো বেঁচে যেত। কারও কারও আবার নামার সময়েও লাফটা দেওয়া চাইই। অনেকের পা অবশ্য অনেক সময় লঞ্চ কিংবা জেটি পর্যন্ত পৌঁছয় না, তখনই তাকে ভরপেট জল খাওয়া অবস্থায় অথবা কয়েক দিন পর অন্যত্র ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করা যায়। কখনও আবার তাও পাওয়া যায় না। নিরেট গঙ্গাপ্রাপ্তি। কিন্তু তাই বলে তো আর ট্র্যাডিশন ছাড়া যায় না।

binod.ghosal@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement