নড়বড়ে পৃথিবীর সাঁকো

আঠেরো বছরের জন্মদিনের পার্টিতে ডোরার নড়বড়ে হাত থেকে কেকের ক্রিম ছিটকে পড়ে, ঝকমকে জুতো-জোড়ায় লেপটে একাকার হয়ে গেল। মা’কে মুছে দিতে হল। সব সময় সেটাই হয়! সে ঘরের সব কাজেই হাত লাগাতে চায়। কিন্তু প্রায় কোনওটাই পেরে ওঠে না। ও নিজেকে মানসিক প্রতিবন্ধী ভাবতে চায় না।

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৬ ০০:০০
Share:

আঠেরো বছরের জন্মদিনের পার্টিতে ডোরার নড়বড়ে হাত থেকে কেকের ক্রিম ছিটকে পড়ে, ঝকমকে জুতো-জোড়ায় লেপটে একাকার হয়ে গেল। মা’কে মুছে দিতে হল। সব সময় সেটাই হয়! সে ঘরের সব কাজেই হাত লাগাতে চায়। কিন্তু প্রায় কোনওটাই পেরে ওঠে না। ও নিজেকে মানসিক প্রতিবন্ধী ভাবতে চায় না। অথচ, বাইরের দুনিয়া তাকে সেটা ভাবিয়েই ছাড়বে। গলার ভেতর দলা-পাকানো কান্না নিয়ে ডোরা ওর ভাঙা ভাঙা আধো বুলিতে মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিল, আমি কি প্রতিবন্ধী? মা বলেছিল, না, তুমি অন্য রকম। ওর ভেতরের জমানো কষ্টটা এ বার ফেটে পড়ল। আমি কক্ষনও প্রতিবন্ধী হতে চাই না। আমি আর পাঁচটা মেয়ের মতো বাঁচতে চাই মা। ডোরার মা ক্রিস্টিনও তো তা-ই চেয়েছিল। বর ফেলিক্সের সঙ্গে কোনও কথা না বলেই ডোরার সমস্ত ওষুধপত্তর বন্ধ করে দিয়েছিল। ওষুধে নয়, ডোরা সব্বার ভালবাসায় বাঁচুক— এ রকমই হয়তো চেয়েছিল মা।

Advertisement

অথচ তার পরেও সে আর ফেলিক্স শুধু ‘সুস্থ স্বাভাবিক’ দ্বিতীয় একটা বাচ্চা চেয়ে জোর করে বিছানায় যায়। যৌবন পেরিয়ে আসা বয়সে, যন্ত্রের মতো উদ্দেশ্য পূরণের সেই মিলনে, এমনিতেই শরীরের সাড়া তেমন ছিল না। তার ওপর তুঙ্গ মুহূর্তে, ভেজানো দরজা খুলে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে ডোরা! শিশুর কৌতূহল আর কৌতুকে, অপ্রস্তুত বাবার তখনও উত্থিত লিঙ্গ নিয়ে সরল প্রশ্ন করে। মা-বাবার এই ‘মিশন সন্তানলাভ’-এর প্রকল্প এর পরেও চালু থাকে। এ দিকে ডোরাকে ‘স্বাভাবিক’ জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত করানোর চেষ্টাটাও তারা ছেড়ে দেয় না। মেয়েটা যখন তার আঠেরো বছরের যুবতী শরীর, সেই শরীরের নানা চাহিদা-ইচ্ছে আর শিশুর মতো মনটা সঙ্গে নিয়ে, মা-বাবার আদর আর আগলের বাইরে, ‘স্বাভাবিক মানুষ’দের পৃথিবীর মুখোমুখি হয়, তখন কী ঘটে, সেটা নিয়েই বাকি ছবিটা। ছবিটার উপনাম— ‘দ্য সেক্সুয়াল নিউরোসেস অব আওয়ার পেরেন্টস’। এ নামটার মধ্যে একটা মুচকি ঠাট্টা আছে, ছবিটা চলতে চলতে সেটা ক্রমশ মর্মান্তিক হয়ে ওঠে। মানসিক অসুস্থদের প্রতি বাইরের সুস্থ সমাজ, এমনকী বাবা-মায়েদের সহানুভূতির ভান, বাড়তি দেখানেপনার আড়ালে, কোথাও একটা না-বোঝা দূরত্বের উদাসীন ফাঁক থেকে যায়। ভেঙে যাওয়া বা কখনও তৈরিই না হওয়া সেই সাঁকোর দুপাশে দু-তরফ বিচ্ছিন্ন দাঁড়িয়ে থাকে।

‘স্বাভাবিক’ আর ‘প্রতিবন্ধী’ মনের এই দুই পৃথিবীর গল্পে পরিচালিকা আশ্চর্য, প্রায় অবিশ্বাস্য যৌন ঈর্ষার কাঁটা বুনেছেন। মা ক্রিস্টিন আর মেয়ে ডোরা এখানে মুখোমুখি। বাইরের জগতে শরীরের অ্যাডভেঞ্চার খুঁজতে গিয়ে ডোরা পিটার নামে ‘প্রেমিক’কে জোটায়, যে তাকে এক রকম ধর্ষণই করে। আর ডোরার কাছে সেটাই শরীরের সমস্ত বন্ধ দরজা খুলে যাওয়া! সে তৃপ্ত হয়। গর্ভবতী হয়। দু’বার। প্রথম বার গর্ভপাত করালেও পরের বার সে মা হতে চায়। আর ডোরার শরীর ভরে উপচে আসা মাতৃত্বের জয়-পতাকা ক্রিস্টিনকে যেন বার বার তাদের বন্ধ্যা, নিষ্ফলা সন্তান-প্রয়াসের কথা মনে করিয়ে দেয়। চোখের সামনে ডোরার শরীরের বাইরে-ভেতরের ওই উৎসব তার সহ্য হয় না। পিটারের কাছে প্রতারণার ঠোক্কর খেয়ে ফিরে আসা ডোরাকে সে নিষ্ঠুর আক্রোশে মানসিক প্রতিবন্ধীদের হোমে পাঠিয়ে দেয়। তীব্র অভিমানে ডোরাও মায়ের মুখের ওপর মনের সমস্ত জানলা বন্ধ করে দেয়।

Advertisement

গোটা ছবিতে ক্যামেরা বার বার ডোরার দৃষ্টিকোণ থেকেই বাদবাকি পৃথিবীকে দেখেছে। রাত-পার্টিতে দেখা স্ট্রিপটিজ নর্তকীর নগ্ন শরীর, প্রথম ধর্ষণের (বা মিলনের!) একটু আগে তার ঠোঁটের কাছে এগিয়ে আসা পিটারের উন্মুখ পুরুষাঙ্গ, কিংবা তার স্ফীত-গর্বিত গর্ভ— ক্যামেরার অ্যাঙ্গলে ডোরার দেখা আর বোঝাটাই ধরা পড়েছে। ছবির শেষ ভিস্যুয়ালের সদ্যোজাত শিশুটিও ডোরার দৃষ্টিকোণেই আমরা দেখি। সে কি ডোরার স্বপ্নে জন্মায়? না তার শরীরের স্বপ্ন-সাধ সত্যি করেই বাইরে আসে?

sanajkol@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement