‘জন অরণ্য’ ছবির দৃশ্য। পরীক্ষার প্রহসনকে, তখনকার শিক্ষাব্যবস্থার হালকে, তীব্র শ্লেষে তুলে ধরা হয়েছিল এই ছবিতে।
আমাদের বিএসসি পার্ট টু’র সিট পড়েছিল নিউ আলিপুরের একটা কলেজে। সেটা ১৯৭৩। পরীক্ষা শুরুর আগে কলেজের ছাত্রনেতারা সদলবলে হলগুলো দেখে গেলেন। আমরা ঢুকে দেখি, ডেস্কে সাঁটা রোল নম্বরের লেবেলগুলো উধাও। যে যার পছন্দমত সিটে বসে। প্রশ্নপত্র বিলির খানিক পর থেকেই শুরু হয়ে গেল ব্যাপক টোকাটুকি। কেউ টুকছে ভাঁজ করা খুদে কাগজ দেখে, কেউ নোটের খাতা দেখে, কেউ বা সটান বই দেখেই। ইনভিজিলেটর ধৃতরাষ্ট্র। এক বন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যর, একটু টয়লেটে যাব? স্যর বললেন, আধ ঘণ্টাও তো হয়নি! ও সোজা বলে দিল, এই জায়গাটা লিখতে পারছি না স্যর! আমরা সবাই হোহো হেসে উঠলাম। স্যরও পরিস্থিতি বুঝে ছেড়ে দিলেন।
আমার ঠিক সামনের পরীক্ষার্থী অন্য কলেজের। এক অধ্যাপক এসে ওর জামার নীচে লুকোনো একটা মোটা বইয়ের ওপর খোঁচা দিয়ে বললেন, এটা কী? সে বিন্দুমাত্র না ঘাবড়ে উত্তর দিল: এটা আমার না, স্যর! আবার হাহাহিহি। এ ভাবেই সব পরীক্ষা হয়ে গেল। আমার মতো দু-চার জন অপটু গবেট ছাড়া সবাই পরীক্ষা দিয়ে বেজায় খুশি। কলেজের করিডরে এক ছাত্রনেতাকে বীরদর্পে বলতে শুনলাম, দেখলি তো, কোনও ঝামেলা হতে দিইনি!
সে এক হযবরল সময়। হিংসার রাজনীতির পালটা রাষ্ট্রীয় হিংসায় সমাজ, জীবন তছনছ হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা লন্ডভন্ড। পরীক্ষা মানেই প্রহসন। কবে পরীক্ষা হবে, ফলই বা কবে, সব অনিশ্চিত। আমাদের তবু ভাগ্য ভাল যে খাতা জমা দিতে পেরেছিলাম, খাতা ছিঁড়ে কেউ পরীক্ষাটাই ভন্ডুল করে দেয়নি। তখন প্রায়ই হত এটা। এক বার বানচাল হয়ে যাওয়া পরীক্ষা ফের কবে হবে, কেউ জানত না।
ফল বেরোল মাস কয়েক বাদে। তা-ও ভুলভাল, উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে। যাই হোক, গ্র্যাজুয়েট বেকারদের তালিকায় নাম উঠল। সমবয়সি অনেকেরই একই হাল। কাজ বলতে শুধু সকাল-বিকেল আড্ডা। আর চাকরির খোঁজ— দরখাস্ত লেখা আর পাঠানো, পাঠানো আর লেখা। তবে অ্যাপ্লিকেশন ডাকবাক্সে ফেলতাম চুপিচুপি, লুকিয়েচুরিয়ে। অন্যদের কাছে ঠাট্টা-মশকরার পাত্র হয়ে উঠব, সেই ভয়ে। চাকরির বাজারের হাল তখন এতটাই শোচনীয়, ‘অমুক একটা চাকরি পেয়েছে’ বললে লোকে গোড়ায় বিশ্বাসই যাবে না, ঠাট্টা-রগড় চলবে। আর আমার মতো অতি সাধারণ মানের একটা ছেলেও চাকরির জন্য চেষ্টা চালাচ্ছি, শুনলে তো ইয়ার্কি মেরে ভূত ভাগিয়ে দেবে!
এ ভাবেই চলছিল। এক দিন আড্ডায় হারু ব্রেকিং নিউজ দিল, সত্যজিৎ রায়ের ‘জন অরণ্য’ ছবির শুটিং-এর জন্য বেশ কিছু ছেলেপুলের দরকার। ভিড়ের দৃশ্য। তা হোক, সত্যজিৎ রায়ের ছবির এক্সট্রা, সুযোগ ছাড়া যায়? চললাম দল বেঁধে ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়ো। সময়টা ১৯৭৫-এর মাঝামাঝি।
স্টুডিয়োয় ঢুকে দেখি, অজস্র ছেলেমেয়ের ভিড়। ক্যামেরা ঘিরে সবাই ধাক্কাধাক্কি করছে। আমরাও ভিড়ে গেলাম। খুব সুন্দরী, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার এক জন মেয়ে ভিড় সামলাচ্ছেন। দেখেই চিনলাম, ইনি তো মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ ছবির নায়িকা, সুহাসিনী মুলে! জানলাম, তিনি এই ছবির অন্যতম সহ-পরিচালক। ক্যামেরাম্যান সৌমেন্দু রায় লাইট মিটার ধরে আলো মাপছেন। একটা পাটাতনের ওপরে রাখা ক্যামেরার পিছনে টুলে বসে স্বয়ং সত্যজিৎ রায়।
হাজরা মোড়ের ‘ব্যানার্জীস বুক সিন্ডিকেট’-এর হুবহু আদলে সেট। দৃশ্যটা এ রকম, পরীক্ষার রেজাল্টের ‘গেজেট’ বেরিয়েছে, ফল জানতে প্রচণ্ড ঠেলাঠেলির মধ্যে ‘সুকুমার’ ডাকছে ‘সোমনাথ’কে। পঁচিশ পয়সা দিয়ে ফল জানা গেল। মেধাবী সোমনাথ ‘অনার্স’ নিয়ে নয়, ‘পাস’-এ পাশ করেছে। ক্যামেরার ঠিক সামনে সোমনাথ (প্রদীপ মুখোপাধ্যায়) আর সুকুমার (গৌতম চক্রবর্তী) ভিড়ের চাপে ধ্বস্ত। সংলাপ বলতেও অসুবিধে হচ্ছে। ক্যামেরার পেছন থেকে পরিচালকের গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল: ‘তোমরা বলে যাও, আমি দেখে নেব।’ ঠেলাঠেলি বাড়তে বাড়তে যখন ধস্তাধস্তির পর্যায়ে, ফের মন্দ্র কণ্ঠের আশ্বাস: ‘উঠবে উঠবে, (ক্যামেরায়) সবাই উঠবে।’ পাড়ার বন্ধু রাজা ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাসছিল। সেই দেখে ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক জন ভদ্রলোক ভীষণ রেগে গিয়ে ওকে বললেন, ‘এই যে ভাই, তুমি হ্যা-হ্যা করে হাসছ কেন? রেজাল্ট নিতে এসে কেউ হাসে? জানো, এ-সব বই কান-বার্লিন যাবে?’ টেনে হিঁচড়ে ওকে বাইরে বের করে দিলেন। আমরা ক্যামেরার ঠিক সামনের জটলাটায় সেঁধিয়ে গেলাম।
বিরতিতে ডিম-পাঁউরুটি-কলা। আমাদের পারিশ্রমিক। সেই ধুতি-পাঞ্জাবি আমার হাতে কাগজ-কলম ধরিয়ে দিলেন, ‘নাম লিখে লিখে ডিস্ট্রিবিউট করো তো!’ বিরতির পরও হুল্লোড়-চেঁচামেচি। একই শট বার বার তুলতে হচ্ছিল। পরিচালকের কিন্তু সামান্য বিরক্তি নেই, মেজাজ হারানো নেই।
‘নিজস্ব সংবাদদাতা’ হারু-ই এসে খবর দিল, ছবি রিলিজ করবে ২০ ফেব্রুয়ারি (১৯৭৬), মিনার, বিজলী, ছবিঘর-এ। জরুরি অবস্থা তখন পুরোদমে জারি। পাড়ার একটু দূরে ‘পদ্মশ্রী’ হল, সেখানেই গেলাম। ছবি দেখার আগ্রহ যত না, তার চাইতেও ঢের বেশি কৌতূহল— আমাদের মধ্যে কাকে কাকে পরদায় দেখা যাবে। ছবির শুরুতেই পরীক্ষা হল-এর দৃশ্য। চমকে গেলাম। এ তো অবিকল আমাদের পার্ট টু পরীক্ষা! এত নিখুঁত, এমন বিশ্বাসযোগ্য! অসহায় ইনভিজিলেটর বলছেন, ‘কী হচ্ছে ভাই?’ হল-এর এক প্রান্ত থেকে এক ছাত্রের অবজ্ঞা-মেশানো মশকরা: ‘পরীক্ষা হচ্ছে ভাআআআই!’
রেজাল্ট বেরনোর দৃশ্যে আমরা উদ্গ্রীব। কাকে কাকে দেখা যাবে? ওই তো সেই ভিড়! মাত্র কয়েক মুহূর্ত, তবু স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে পাড়ার বন্ধুদের— বুদু, মনু, মিলন, সীতানাথ, গোপাল, ভাইয়া, শেখর... খুব আনন্দ। যদিও ছবির শেষে অতটা আনন্দ রইল না। সোমনাথের মতো, আমরাও তলিয়ে যাব না তো?
পিনাকী দত্ত চৌধুরী, সূর্যনগর, টালিগঞ্জ
pinakidc@rediffmail.com
সত্তরের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে? লিখুন এই ঠিকানায়:
হ্যালো 70’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in