একটা ভয় কষ্ট [লজ্জা]

আমার সব সময় খুব তাড়া। কেন, তা আমি নিজেই ঠিক জানি না। মনোবিদরা হয়তো বলবেন, আমি আসলে আমার বর্তমানকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে ছোটাছুটি করছি! বা আরও শক্ত কিছু। আমি স্রেফ এটুকু জানি, ছোটবেলা থেকেই যে কোনও কাজ খুব তাড়াতাড়ি করতে ভালবাসি। চান-খাওয়া তো বটেই।

Advertisement

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৩০
Share:

আমার সব সময় খুব তাড়া। কেন, তা আমি নিজেই ঠিক জানি না। মনোবিদরা হয়তো বলবেন, আমি আসলে আমার বর্তমানকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে ছোটাছুটি করছি! বা আরও শক্ত কিছু। আমি স্রেফ এটুকু জানি, ছোটবেলা থেকেই যে কোনও কাজ খুব তাড়াতাড়ি করতে ভালবাসি। চান-খাওয়া তো বটেই।

Advertisement

বাবা এক বার বলেছিল, তোর খাওয়া দেখলে মনে হয়, তুই এখুনি ট্রেন ধরতে ছুটবি। শুধু কি তাই? কত বার এমনও হয়েছে, কেউ হয়তো আমাকে বলছে একটা কাজ কী করে করতে হবে, আমি অর্ধেক শুনেই হাত লাগিয়ে ফেললাম, এবং যা হওয়ার তাই হল। তখন হ্যাপা সামলাতে নাকানিচোবানি, মা’র বকুনি।

এই সব করতে গিয়ে, ছোট থেকে একটা ছোট্ট বাক্যের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয়। সেটা হল— অ্যাই যাঃ! অর্থাৎ কিনা, আমি কিছুটা শুনে, কিছুটা না শুনে, কিছুটা ফোর্সে এমন কোনও কাজ করে ফেলেছি, যা পরে করলে চলত, না করলে চলত, অথবা অন্য ভাবে করলেও হত। তবে, এর জন্য বিরাট কোনও ঝামেলা হয়নি। কিন্তু ক’দিন আগে একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হল।

Advertisement

গিয়েছিলাম একটা নেমন্তন্ন-বাড়ি। দুপুরে নেমন্তন্ন। যেতে দেরি হয়েছে। এ দিকে বাড়ি থেকে তেমন কিছু খেয়ে বেরোইনি, ফলে পেট চুঁইচুঁই। পৌঁছবার পর এর-ওর-তার সঙ্গে হাসি-বিনিময়, কথাবার্তা হওয়ার পর গুটিগুটি গিয়ে দেখি, বুফের সামনে খুব ভিড়। তার পরেই দেখি, আমার মা, বাবা আর পিসি একটা গোল টেবিলে বসে খাচ্ছে। পাশে একটা প্লেটে খাবারদাবার সাজানো রয়েছে, কিন্তু কেউ নেই বসে। আমি ভাবলাম, নিশ্চয়ই আমাদেরই কেউ বসেছে এখানে। দেখলাম সেই প্লেটে দুটো ফিশ-ফিংগার রয়েছে। আমি কালবিলম্ব না করে ছোঁ মেরে টপ করে মুখে পুরছি, তখন মা, বাবা আর পিসির সমস্বরে ‘অ্যাই অ্যাই অ্যাই’ শুনছি, কিন্তু আমার তো ডিফল্টে তাড়া, অতএব আমি তত ক্ষণে মুখে পুরে ফেলেছি।

বাবা, মা, পিসির মুখ প্রায় সাদা। আর কিচ্ছু বলছে না। হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার মুখে গরম ফিশ-ফিংগার, বেশি জিগেসজাঁটিও করতে পারছি না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মা-বাবার চোখ ফলো করে দেখলাম, এক বয়স্ক ভদ্রলোক আমার পেছনে একটা বাটিতে রায়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এবং ওঁকে দেখে মনে হচ্ছে, উনি কিছুতেই বিশ্বাস বা হজম করতে পারছেন না যে, একটি শাড়ি পরা মেয়ে, যে কোনও ভাবেই ছোট নয়, এমনকী বছর-পঁচিশের ডানপিটে তরতরেও নয়, বরঞ্চ বেশ মোটাসোটা বউদি টাইপ, সে কী করে অভদ্রের মতো অন্যের পাত থেকে তুলে ফিশ ফিংগার খেয়ে নিল! ফলে বিস্ময়, আচমকা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়ার আঘাত, অভদ্রতার প্রতি অপছন্দ— সব মিলিয়ে ওঁকে অর্ধেক স্তম্ভিত আর অর্ধেক বিরক্ত দেখাল।

আমার অবস্থাটা কী তখন! আক্ষরিক অর্থে, না পারছি খেতে, না পারছি ফেলতে। না পারছি ওঁকে ‘সরি’ বলতে, না ওঁর জন্য অন্য একটা প্লেট সাজিয়ে এনে দেওয়ার সাহস দেখাতে পারছি। মুখে ওঁর রেখে যাওয়া খাবার ঠুসে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি।

কয়েক মুহূর্ত পর গপ করে লজ্জা সমেত ফিশ ফিংগার গিলে ফেলে বললাম, ‘আমি না, ইচ্ছে করে করিনি। ইয়ে, এরা আমার বাবা-মা।’ এই যুক্তি ওঁর কাছে বোধহয় আমার আগের কীর্তিটার চেয়েও উদ্ভট মনে হল। উনি মাথা নাড়তে নাড়তে নিজের প্লেটটা নিয়ে অন্য দিকে চলে গেলেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement