একটা ভয় [কষ্ট়] লজ্জা

আ মার মায়ের একটা পোষা নেড়ি কুকুর ছিল। কালো রঙের। তার চিকন চিকন গা, ছোট্ট একটা লেজ, নরম নরম চোখ, ঘন্টি বাঁধা কলার। সেই কলার আবার তখনকার দিনে কলকাতা থেকে অর্ডার দিয়ে করিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এমনতরো স্পেশাল ট্রিটমেন্ট যে পেত, সে যে কত আদরের ছিল, তা আমি চোখ বন্ধ করে কল্পনা করতে পারি। অতএব কালুয়ানাথ খুব আদুরে ছিল।

Advertisement

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৬ ০০:০৩
Share:

আ মার মায়ের একটা পোষা নেড়ি কুকুর ছিল। কালো রঙের। তার চিকন চিকন গা, ছোট্ট একটা লেজ, নরম নরম চোখ, ঘন্টি বাঁধা কলার। সেই কলার আবার তখনকার দিনে কলকাতা থেকে অর্ডার দিয়ে করিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এমনতরো স্পেশাল ট্রিটমেন্ট যে পেত, সে যে কত আদরের ছিল, তা আমি চোখ বন্ধ করে কল্পনা করতে পারি। অতএব কালুয়ানাথ খুব আদুরে ছিল।

Advertisement

আমার মামাবাড়ি ছিল বীরভূমের একটা গ্রামে। সেখানে ময়ূরাক্ষীর ক্যানাল চলে গিয়েছে ঘন জঙ্গলের পাশ ঘেঁষে। সেখানে ছোট ছোট টিলার পাশ দিয়ে কাঁকরের রাস্তা ধরে মা হাঁটত, আর হাঁটত কালুয়া। কালুয়া নাকি আবার গরমকালে পান্তাভাত ছাড়া কিছু খেত না। রোদ পড়লে তবে সে বাড়ির বাইরে বেরোত। বাকি সময় মায়ের আগুপিছু ঘুরে বেড়াত। আর আমার দিদিমা নাকি তেলেবেগুনে জ্বলে যেত। তখনকার দিনে গাঁয়ে-ঘরে কুকুর নিয়ে এমন আদিখ্যেতা কেউ বাপের জম্মেও দেখেনি কিনা!

এক দিন মা দুপুর থেকে দেখে কালুয়া নেই। খোঁজ খোঁজ খোঁজ! কোথাও নেই সে। গ্রামের সব জায়গা, সব ঘর, জঙ্গলের দিক সব খোঁজা হল, কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না। মা নাওয়া-খাওয়া ছাড়ল। আলুথালু হয়ে বসে থাকল অনেক দিন। তার পর, যেমন হয়, বেশ কিছু দিন পর আবার নাওয়া-খাওয়া শুরু হল। পরিপাটি চুল। বিকেলে জঙ্গলের ধারে হাঁটতে যাওয়া, সবই হল। কেবল ভেতরের গোঙানি আর ফোঁপানি গেল না।

Advertisement

মাস তিনেক পরে এক দিন হঠাৎ রে-রে আওয়াজ। বাড়ির সামনে এত শোরগোল শুনে মা দেখতে গেল। দেখে, কতকগুলো ছেলে একটা কালো রোগা কুকুরকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেগুলো গ্রামের এক প্রান্তেই থাকে, কিন্তু মোটের ওপর অচেনা। আর সেই কুকুর মায়েদের বাড়ির সামনে এসে ছটফট করছে।

মায়ের ভুল হয়নি, সে মায়ের কালুয়া। মাকে দেখে পাগলের মতো ছিটকে কাছে আসতে চেয়েছিল সে। মা-ও তাকে জড়িয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। তার গলায় ঘন্টি বাঁধা কলার ছিল না, বদলে একটা দড়ি, কিন্তু দাগটা ছিল, কালুয়ার গলায় আর মায়ের মনে। মা অনেক করে বলেছিল ছেলেদের কালুয়াকে ফেরত দিতে। কাকুতি-মিনতি করেছিল। ওরা দেয়নি। কালুয়া প্রথমে খুব চেঁচিয়েছিল আর যাওয়ার সময় কেঁউ কেঁউ করে খুব কেঁদেছিল। দুজনেই দুজনের দিকে দিকে তাকিয়ে ছিল, যত ক্ষণ তাকানো যায়।

এর পর অনেকে মাকে বলেছিল, ওরা নাকি কালুয়াকে মেরে ফেলেছে, কেউ কেউ বলল খেয়ে নিয়েছে। ওরা নাকি কুকুরও খায়। এ বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করা যায়নি। কালুয়া নিজেই হারিয়ে গিয়েছিল, না কি ওই বেপাড়ার ছেলেরা ওকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তা-ও অজানা। কিন্তু কালুয়া আর কখনও ফিরে আসেনি।

কালুয়ার হারিয়ে যাওয়া আমার মাকে বদলে দিয়েছিল। সবেতেই উৎকন্ঠা, সবেতেই ভয়, টেনশন।

অনেক বড় হওয়ার পর বুঝতে পেরেছি, আমাদের ছোটবেলায় কেন মা সব সময় ভাবত আমাকে আর দিদিকে ছেলেধরায় ধরে নিয়ে যাবে। কেন কলেজ থেকে ফিরতে দেরি হলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মা ঘামত, কেন বন্ধুদের সঙ্গে কোনও এক্সকারশনে যেতে দিত না। কেন আমার আর দিদির ওপর এত বাধানিষেধ ছিল। কালুয়া তো আসলে মায়ের প্রথম সন্তান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন