howrah station

ইতিহাসের সাক্ষী বাঙালবাবুর গড়া সেতু

গোড়ায় ছিল কাঠের পুল। ১৯৩৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া রেল গড়ে দেয় পাকা সেতু। উনিশ শতকে ঢাকা থেকে হাওড়ায় আসা অভিজাত রামযতন বসুর তৈরি সেই সেতু আজও দাঁড়িয়ে। সমরজিৎ চক্রবর্তীরেললাইন পেরিয়ে বাজারে আসতে মানুষের অসুবিধে, তাই রামযতন বসুর পরিবার কাঠের পুল তৈরি করে দেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২২:১০
Share:

বাঙালবাবু ব্রিজ, এখন যেমন। নিজস্ব চিত্র।

হাওড়া স্টেশনে ঢোকার মুখে, প্ল্যাটফর্ম সিগন্যালের ঠিক পরেই অর্ধচন্দ্রাকৃতি এক সেতুর নীচ দিয়ে ট্রেন এগিয়ে আসে প্ল্যাটফর্মের দিকে। হাওড়ায় আসার সময় বা হাওড়া থেকে যাওয়ার সময় একটু নজর করলে সেতুর মাঝ বরাবর সাত নম্বর স্তম্ভে প্লেটের উপর ইংরেজিতে ‘ইআইআর ১৯৩৩’ লেখা চোখে পড়ে। এই সেতুরই কথ্য নাম ‘বাঙালবাবুর ব্রিজ’। কেউ কেউ বলেন ‘চাঁদমারি ব্রিজ’ও।

Advertisement

সেতুর ঠিক পরেই রেলওয়ে ইয়ার্ড ‘ঝিল সাইডিং’। কথিত, রাজা নরসিংহ দত্তের কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া রেল জমি লিজ় নিয়ে স্থাপন করেছিল এই ইয়ার্ড। বর্তমান হাওড়া স্টেশন ও জি টি রোডের মধ্যবর্তী অঞ্চলটি এক সময়ে ‘চাঁদমারি’ নামে পরিচিত ছিল। এখনকার বঙ্কিম সেতু থেকে যে রাস্তাটি হাওড়া বাসস্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে হাওড়া ব্রিজে গিয়ে উঠছে, তার নীচে পানবাজার ও মেছুয়া (মাছের আড়ত)। এই পানবাজার ও মেছুয়ার পাশে উঁচু-উঁচু ঢিপির মতো জায়গা ছিল, গোলন্দাজ বাহিনীর সৈন্যরা সেখানে অনুশীলন করত। গোলন্দাজি পরিভাষায় এই উঁচু ঢিপিগুলোই ‘চাঁদমারি’, সেই থেকে স্থানটিরও নাম। রেলের বর্তমান আরআরআই কেবিন-এর পাশে ১৯৩৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া রেল (ইআইআর)-এর তৈরি সেতুটি এখনও ওই শব্দটির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।

এই সেতু প্রথম তৈরি করিয়েছিলেন ‘বাঙালবাবু’ নামে প্রসিদ্ধ রামযতন বসু। গোলাবাড়ি থানার সামনে যে গলিটা এখন আশুতোষ মুখার্জি লেন নামে পরিচিত, তখন তার নাম ছিল ‘বাঙালপাড়া’। সেই সময়ে সালকিয়ার এই অঞ্চলে একাধিক ডক ইয়ার্ড বা জাহাজ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র ছিল, যেমন ম্যাকেঞ্জি ডক, ইউনিয়ন ডক ইত্যাদি। হুগলি ডক আজও তার পরম্পরা বয়ে চলেছে। কলকাতার রাধানাথ মল্লিকের উদ্যোগে ও জনৈক রিড সাহেবের সহযোগিতায় সালকিয়ায় এই হুগলি ডক স্থাপিত হয় ১৮৪২ সালে। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কুমিল্লা, চট্টগ্রাম থেকে মাঝিমাল্লারা এখানে এসে মাল খালাস ও মেরামতির জন্য নৌকা, স্টিমার নোঙর করতেন।

Advertisement

অতীত: ইস্ট ইন্ডিয়া রেল-এর নির্মীয়মাণ ‘চাঁদমারি ব্রিজ’। ছবি সৌজন্য: ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাব।

রামযতন বসু তৎকালীন ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ থানার নয়াবাড়ি গ্রাম থেকে এখানে আসেন হোগলা পাতার ব্যবসা করতে। ক্রমে তাঁর পসার জমে ওঠে, ১৮৬৩-র প্রথম দিকে তিনি চলে আসেন হাওড়া স্টেশন সংলগ্ন অঞ্চলে। তাঁর দুই পুত্র রামরতন ও রাজলোচন বসু। রামরতন ইংরেজ সরকারের দেওয়ান ছিলেন। ১৮৬৩ সালে ইংরেজ সরকার প্রথম যে তিন ভারতীয়কে ‘কমিশনার’ পদে নিযুক্ত করেন, রামরতন ছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রথম। কমিশনার মানেই বিশাল প্রভাব। তার জোরেই বাঙালবাবু-পরিবার জমিদারি প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেন। রামরতনের পিতা রামযতন বসু প্রজা তথা সাধারণ মানুষের জন্য রেললাইনের ও পারে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। এরই নাম ‘বাঙালবাবুর বাজার’। ১৮৯৭ সালে এই বাজারের পাশ থেকেই চালু হয় মার্টিন রেল।

১৮৫৪-র অগস্টে পূর্বাঞ্চলে প্রথম রেল চালু হয়। রেললাইন পার হয়ে বাজারে আসতে মানুষের অসুবিধে হত। তাই ‘বাঙালবাবু’ তথা রামযতন বসুর পরিবার একটি বিরাট কাঠের পুল তৈরি করে দেন। ১৯৩৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া রেল এটিকে সিমেন্টের ঢালাই করে পাকা সেতুতে পরিবর্তিত করে, নাম রাখে ‘চাঁদমারি ব্রিজ’। ঠিকানা ৪ গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড, গুলমোহর রেলওয়ে কোয়ার্টার্স, মালি পাঁচঘড়া, হাওড়া-৭১১১০১।

প্রতিদিন এই সেতু দিয়ে যাতায়াত করেন উত্তর ও দক্ষিণ হাওড়ার অজস্র মানুষ। বর্তমানে তীব্র যানজটের হাত থেকে হাওড়াবাসীকে মুক্তি দিতে হাওড়া সিটি পুলিশ এখানে চালু করেছে একমুখী যান চলাচল। সেখানেও প্রায় ৮৫ বছরের এই সেতুর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। এই সেতুর উপর দিয়েই বহমান গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড। সেতুর ভিতরের অংশ রক্ষণাবেক্ষণ করে ভারতীয় রেলওয়ে। আর সেতুর মধ্যে দু’পাশের ফুটপাত-সহ অন্যান্য অংশের রক্ষণাবেক্ষণ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পূর্ত দফতর। কিছু দিন আগে পর্যন্ত সেতুর দুই প্রান্তে লাল রঙের বৃত্তের মধ্যে ‘ই আর জুরিসডিকশন’ শব্দগুলো দেখা যেত। বর্তমানে রং করা হচ্ছে বলে হয়তো দেখা যায় না।

রামযতন বসুর পৌত্র, রামরতন-তনয় হরিমোহন ইংরেজ সরকারের থেকে ‘রায়বাহাদুর ’উপাধি পান এবং ‘অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট’ হন। হরিমোহনের নামাঙ্কিত একটি রাস্তা তাঁকে কিছুটা হলেও স্মরণীয় রেখেছে। রামযতন বসুর আর এক পুত্র রাজলোচনের ছেলে ঈশানচন্দ্র বসু এফএ ও বিএ পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। তাঁর অসাধারণ মেধা ও যোগ্যতার জন্য ১৮৭১ সালে ইংরেজ সরকার তাঁকে ‘কম্পট্রোলার জেনারেল অব কারেন্সি’ পদে নিয়োজিত করেন। প্রসঙ্গত, ১৮৭১ সাল থেকেই ইংরেজ সরকার ভারতে কারেন্সি নোট চালু করে। বলা হয়ে থাকে ঈশানচন্দ্রই প্রথম ভারতীয়, যাঁর স্বাক্ষরে প্রথম কারেন্সি নোট চালু হয়েছিল।

ঈশানচন্দ্র বসুর কন্যা কনকলতার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের। সত্যেন্দ্রনাথ নিঃসন্তান ছিলেন, ১৯২২ সালের ২৫ জুন তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঈশানচন্দ্রের আর এক বেয়াই ছিলেন কলকাতা হেয়ার স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক ঈশানচন্দ্র ঘোষ।

বিভিন্ন ক্ষেত্রের বহু খ্যাতনামা মানুষের স্মৃতি জড়িয়ে আছে ‘বাঙালবাবু ব্রিজ’-এর গায়ে। এই সেতু ভারতীয় রেল ও হাওড়া শহরের গর্বও বটে। সেতুর রূপকার বাঙালবাবু তথা রামযতন বসুর বাড়ি এখানে ঠিক কোথায় ছিল, খোঁজ করেন ইতিহাসসন্ধানী কেউ কেউ। অনেকে বলেন, সেতুর নীচে টেলিফোন অফিসের পাশেই ছিল বাঙালবাবুর বাড়ি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটি হাতবদল হয়ে জনৈক অবাঙালির হাতে গিয়েছে। বাড়ি না থাকুক, ‘বাঙালবাবু ব্রিজ’ আজও দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন