গ্যাংস্টার ও মিষ্টি মেয়ে। ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন মুম্বই দোবারা’ ছবির দৃশ্য।
সাধারণ বাঙালি মেয়ের কেমন প্রেমিক পছন্দ? এট্টু গদগদ, দেরি করে আসার জন্য যাকে ইচ্ছেমত দাবড়ানো যায়, এবং অবশ্যই যার পকেটে হাত পুরলেই হাফ ডজন ডেবিট আর ক্রেডিট কার্ডের চৌকোনা অস্তিত্বের হদিশ মেলে। মোদ্দা কথা, বিয়ের পর একটা থ্রি বিএইচকে ফ্ল্যাট, একটা হ্যাচব্যাক, বছরে এক বার সিঙ্গাপুর: এই আয়েসটাকে নিশ্চিত করতে সবাই চায়। কিন্তু রোজ বিকেলে কফির কাপ হাতে তুলে দেওয়া প্রেমিকপুরুষটি যদি এক জন সন্ত্রাসবাদী হয়? কিংবা জ্বরের সময় রাত জেগে জলপট্টি দেওয়া মানুষটি যদি হয় সিরিয়াল কিলার? শুনলেই বুক ধড়াস। বোমা-বন্দুক, ছোরাছুরির সঙ্গে যাদের নিত্য ওঠাবসা, তাদের জীবনেও রোমান্স? কারা হয় এদের গার্লফ্রেন্ড? ‘হ্যাঁ’ বলার সময় কি সেই মেয়েদের মাথায় পিস্তল ঠেকানো থাকে?
বাস্তবটা কিন্তু মোটেই এমন ভয়-থরথর গপ্পো হয় না। একদা ডি-কোম্পানির ডান হাত আবু সালেমের কথাই ধরা যাক। মোনিকা বেদীর সঙ্গে তার সম্পর্ক নাকি আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই ছিল। মোনিকার ব্যাপারে ভীষণ পজেসিভ, আবার মোনিকাকে যোগ্য সম্মান দিতেও কসুর করত না সে। অনেক খুনের রক্ত তার হাতে। অথচ মোনিকার চোখে সে-ই আবার লোকের বিপদে-আপদে হাত বাড়িয়ে দেওয়া এক দয়ালু পুরুষ। এক ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই কথাই জানিয়েছিল মোনিকা। তার সঙ্গে আবু সালেমের দেখা হওয়াটাও একেবারে হঠাৎই। মোনিকা তখন সালেমের নামও জানত না। জানবেই বা কী করে? মোনিকার জন্ম পঞ্জাবে, কিন্তু ছোটবেলা তো নরওয়েতে। এক বার ছুটি কাটাতে সে এল ভারতে। ছোট থেকেই এ দেশের ক্লাসিকাল ডান্স তাকে বেজায় টানে। সুতরাং, ওই সময়ই নাচের ক্লাসে ভর্তি, এবং শিক্ষার শুরু। স্টেজ পারফরমেন্স-এর টুকটাক অফারও আসতে লাগল। কিন্তু দিনগুলো পালটে গেল একটামাত্র ফোনের পর। দুবাই থেকে আসা ফোন। অচেনা গলা। জানাল, দুবাইয়ে সে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। মেয়েটি যেন অংশ নেয়। তার পর ফোনেই এগোল পরিচয়, ফোনেই কথাবার্তা। দুবাইয়ে পরিচয়ও হল মানুষটির সঙ্গে। নাম, আরসালান আলি। তার ডাকে মেয়েটির তখন দু’বার দুবাই ঘোরা হয়ে গিয়েছে। এ বার সে তৃতীয় বারের জন্য দুবাই যাবে। আর জানতে পারবে সেই মানুষটির একটা অন্য পরিচয়। আসল পরিচয়। গ্যাংস্টার আবু সালেম। যার মাথার ওপর ঝুলছে ’৯৩ সালের মুম্বই বিস্ফোরণে জড়িত থাকার অভিযোগ। প্রেমিক সালেম কিন্তু জানাল, সব কালো অতীত মুছে ফেলার জন্য সে তৈরি। ঝকঝকে নতুন একটা জীবন শুরু করতে চায় সে। মোনিকা তত দিনে গ্যাংস্টারের প্রেমে হাবুডুবু। তাদের সম্পর্কটা আদৌ ‘টাইম পাস’-মার্কা ছিল না। দুজনেই রীতিমত সিরিয়াস। কিন্তু পরবর্তী জীবনে হাজার চেষ্টাতেও অতীত নাকি পিছু ছাড়েনি সালেমের। আর তখন থেকেই মোনিকার আলাদা থাকার ভাবনা-চিন্তার শুরু।
নিহিতার প্রেমিক আবার ভারী রংদার মানুষ। রীতিমত তারকা। ঝকঝকে ব্যক্তিত্ব, একাধিক ভাষায় সড়গড়, আর উওম্যানাইজার তো বটেই। চার্লস শোভরাজ। এ দিকে প্রায় দু’ডজন খুনের অভিযোগ তার নামে। বেশির ভাগ শিকারই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ঘুরতে আসা পশ্চিমি পর্যটক। গপ্পোটা প্রায় এক। বন্ধুত্ব, ড্রাগ, লুঠপাট। অথবা বন্ধুত্ব, ড্রাগ, খুন। পাসপোর্ট জালিয়াতি, ছিনতাই-সহ অন্য অপরাধের তালিকা না হয় বাদই রইল। শোভরাজ নিজে তখন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে কুখ্যাতিটুকু। চড়া দর হাঁকছে নিজের ইন্টারভিউ আর ছবির স্বত্বের জন্য। কিন্তু সত্তর-আশির দশক কাঁপিয়ে দেওয়া এ হেন শোভরাজকে ‘অপরাধী’ দাগিয়ে দেওয়া বিলকুল না-পসন্দ নিহিতার। ভারী ভাল মানুষ সে, বলেছে নিহিতা। তাই সে আজও লড়ছে প্রেমিকের মুক্তির জন্য। নেপালের জেলে ২০০৮ সালে নাকি আংটি বদল হয়েছে তাদের। আসল অনুষ্ঠানটা হবে সেই দিন, যে দিন ‘বিকিনি কিলার’ জেল থেকে বেরোবে। জেলেই তো তাদের পরিচয়। শোভরাজ তখন সেখানকার পাকাপাকি বাসিন্দা। আর নিহিতা এসেছিল তার দোভাষী হয়ে। তার পর একদম বলিউড-মার্কা লাভস্টোরি। চার চোখের মিলন, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। জেলরক্ষীদের কৌতূহলী চাউনি আর ভিজিটিং রুমে প্রবল চেঁচামেচির মধ্যেই তরতরিয়ে এগোল প্রেম। সেখানে কোথাও শোভরাজের সিরিয়াল কিলিং-এর ছায়ামাত্র পড়ল না। শোভরাজ তখন ৬৪, আর নিহিতা ২০।
এই মেয়েরা অন্যায়ের সঙ্গে ঘর করেছে। সংসারের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে একটা বেয়াড়া, লোমখাড়া করা জীবন বেছে নিয়েছে। তার পর ভুলের মাশুল দিতে দিতে আর সমঝোতা করতে করতে যখন দেওয়ালে পিঠ, পুলিশের জেরা, সমাজের ঘেন্না-মাখা চোখ, তখন তারা সেই সমাজের কাছেই ফিরে এসেছে। স্বাভাবিক জীবনের খোঁজে। কিন্তু গ্যাংস্টারের হাত ধরা, সিরিয়াল কিলারের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করা অথবা সন্ত্রাসবাদীকে প্রথম চুমু খাওয়া মেয়েগুলোর সেই খোঁজ এখনও শেষ হয়নি, হয়তো ভবিষ্যতেও হবে না। এদের পরিণতি অনেকটাই ‘গ্যাংস্টার’ ছবির সিমরনের মতো। যাদের সুস্থ জীবনে ফেরার স্বপ্নটাকে ব্যবহার করা যায়, তার সঙ্গীকে ধরার ফাঁদ হিসেবে। কিন্তু একেবারে সব অতীত মুছে ক্ষমাঘেন্না করে দেওয়া যায় না। মোনিকা বেদীও পারেনি অন্ধকার জগতের ছায়া থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে নিজের কেরিয়ারটাকে আরও এক বার গুছিয়ে নিতে। জেল থেকে ফিরে যত বারই সেই চেষ্টা করেছে, কিছু ফিসফিস, বিশ্রী মন্তব্য তার দিকে উড়ে এসেছে। নিহিতার দিকেও যেমন এক
টিভি-অনুষ্ঠানে ছুটে এসেছিল প্রশ্ন, শোভরাজের সঙ্গে সেক্স হয়েছে নাকি তার?
আজও দাউদের প্রসঙ্গ উঠলে তার বলিউডি গার্লফ্রেন্ডের প্রসঙ্গও টুক করে হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ, মন্দাকিনী নিজে বার বার ‘ডন’-এর সঙ্গে সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেছেন। দুবাইয়ে শো করার সময় দাউদের সঙ্গে তাঁর সামান্য কুশল বিনিময় ছাড়া কোনও সম্পর্কই কোনও কালে ছিল না, জোর দিয়ে জানিয়েছেন। তবু রগরগে আলোচনা থেকে মুক্তি পাননি। লোকে তাঁকে মনে রেখেছে ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’-র জন্য। আর মনে রেখেছে দাউদ ইব্রাহিমের ‘গার্লফ্রেন্ড’, ‘বউ’, ‘এক সন্তানের মা’ হওয়ার জন্যও।
১৯৮৫ সালের ছবিটাতে পরিচালক রাজ কপূর নতুন মেয়েটিকে লিড রোলে বেছে নিয়েছিলেন। ঝরনায় ফিনফিনে শাড়ির ভেজা মন্দাকিনী আর বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে ব্যস্ত মা মন্দাকিনী-সমেত ছবি হইচই হিট। জেট গতিতে না হলেও ভালই এগোচ্ছিল তাঁর ফিল্মি কেরিয়ার। কিন্তু বাদ সাধল একটা ফোটোগ্রাফ। ’৯৪ সালের সেই ফোটোয় দেখা গেল দাউদের পাশে মন্দাকিনী। ব্যস, রটল, প্রবল বলিউড-অনুরাগী দাউদকে বিয়ে করে দুবাই পাড়ি দিয়েছেন তিনি। আরও শোনা গেল, রাজ কপূরের ছবিতে মন্দাকিনীর আবির্ভাব নাকি দাউদেরই চাপে। এর পর থেকেই মন্দাকিনীর বলিউড কেরিয়ারও একেবারেই ঢিমে হয়ে এল। ফিল্মি দুনিয়া থেকে প্রায় উধাও হয়ে গেলেন তিনি।
আরও আছেন অনেকে। স্বাতী পাল, বীণা মালিক, মমতা কুলকার্নি, এমনকী অতি সম্প্রতি পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে অভিযুক্ত কাদের খানের বান্ধবী এক টলিউড অভিনেত্রীও আছেন। সারদা কেলেংকারির গোড়ায় দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের পাশাপাশি সুদীপ্ত সেনের দুই স্ত্রী, তাদের সংসার নিয়েও তো কম ফিসফাস শোনা যায়নি। সত্যিই তো, মনে হওয়া স্বাভাবিক, এই অন্যায়কারীগুলোর সঙ্গে এরা প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করে কী করে? এদের সঙ্গে হেসেখুশে থাকে কেন? যে হাতে রক্ত, সেই হাতে হাত সঁপে দিতে গা শিরশির করে না?
গ্যাংস্টার-এর বউ হওয়া খুব কৃতিত্বের নয়। ধর্ষকের প্রেমিকা হওয়াও প্রচণ্ড অপমানের, লজ্জারও। কিন্তু একটু তলিয়ে ভেবে দেখলে, হয়তো মনে হবে, প্রিয়জনের অপরাধ সহ্য করে আমরাও দিব্যি থাকি। প্রতি দিন। হয়তো সেটা ড্রাগ-চালানের মতো বড় অন্যায় নয়, হয়তো খুন-জখমও নয়। কিন্তু কাস্টমস-এ চাকরি করে তিনমহলা বাড়ি তুলে ফেলা সেজদার সঙ্গে একেবারে সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলার কথা ভাবি কি? আড়ালে টিটকিরি কাটি, কিন্তু নবমীর দুপুরে তাদের বাড়িতে পাঁঠার মাংসের নেমন্তন্নও মহানন্দে গ্রহণ করি। তাদের সঙ্গেই রাজস্থান যাওয়ার টিকিট কাটি। যে পুলিশটি দিনরাত ঘুষ নেয়, তার ছেলেও কিন্তু বাড়িতে রাত জাগে, বাবার সঙ্গে এক টেবিলে খাবে বলে। তার স্ত্রী উপরি রোজগারের টাকায় ধনতেরসে কানের দুল গড়ায়। অথচ, টাকা তছরুপের দায়ে ধৃত লোকটির ছেলেমেয়ের নাম স্কুল থেকে কেটে যায়। এই স্ত্রীর প্রেমে, এই সন্তানের প্রীতিতে কোনও ফাঁকি নেই কিন্তু।
আদর্শের রাস্তাই যদি ‘ভাল’ হওয়ার মাপকাঠি হয়, তা হলে সবার আগে নিজের ঘরটাকে সাফসুতরো করার প্রয়োজন। কিন্তু তা হলে তো নিজের ছেলে স্কুলে বন্ধুকে ঠেঙিয়ে এলে, তক্ষুনি ফোন করে হেডমাস্টারকে বলা উচিত, আপনি আমার ছেলেকে শাস্তি দিন। কিংবা ছেলে যদি ডাইনিং টেবিলে বসে গর্ব করে বলে গোটা পরীক্ষাটাই সে টুকেছে, তক্ষুনি প্রিন্সিপালের কাছে গিয়ে বলা উচিত, আমার ছেলেকে টি.সি. দিন। আমরা কি তা করি? উলটে ‘ছি বাবা, আর কক্ষনও কোরো না’ বলে সিরিয়ালে মন দিই। আসলে ভালবেসে ফেললে, তার পর তার দোষত্রুটিকে চাপাচুপি দিয়ে রাখাই দস্তুর। তাকে কেউ নীতি দিয়ে বিচার করে না, প্রীতি দিয়েই সব কিছুর ওপর কম্বল চাপা দিয়ে দেয়। সেটাই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। মানবিক না-ই বা হল।
‘দহন’ সিনেমায়, রোহিতের সঙ্গে এনগেজমেন্ট ভেঙে দিতে চেয়েছিল তৃণা। কারণ রোহিত একটা মেয়ের শ্লীলতাহানি করেছে। কিন্তু তৃণার মা তৃণাকে বোঝান, খবরকাগজ তো বাড়িয়েই লেখে। রোহিত নিজে যখন বলছে ও কিছু করেনি, তা হলে ওকে বিশ্বাস না করে তৃণা হঠাৎ উলটোপালটা ভাবছে কেন? আর তৃণার বাবা বলেন, এত দিন ধরে যে তোমরা একসঙ্গে ঘুরেছ, এমনকী বাইরে বেড়াতে পর্যন্ত গেছ, সে কথা তো সবাই জানে। এর পর সম্পর্ক ভেঙে দিলে সমাজ কী বলবে? আমরাই বা মুখ দেখাব কী করে?
এ ভাবেই কখনও সম্মান, কখনও সমাজ, আবার কখনও পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে আমরা যেমন করে হোক সম্পর্কটাকে, স্থিতাবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে চাই। অন্যায়কে সয়ে যেতে শিখি, মুখ বুজে মানিয়ে নিই। এমনকী সন্তানকেও তা-ই শেখাই।
হয়তো পার্ক স্ট্রিটের রেপিস্ট-এর প্রেমিকার দিকে আঙুল তোলার আগে, আয়নাটা একটু ভাল করে দেখে নেওয়া দরকার।