পান্তাভাতে…

জিনিয়াস ও শিশু ভোলানাথ

পাহাড়ী সান্যালের কাছে বছর দুয়েক থেকে, ভীমসেন জোশী চলে গেলেন জলন্ধরে। সেখানে তখন বছরে এক বার রমরমিয়ে বসে হরবল্লভ সংগীত সম্মেলন। আসেন ভারতবিখ্যাত সব ধ্রুপদী শিল্পীরা। সেখানে এক জন দৃষ্টিহীন ধ্রুপদী সংগীতশিল্পীর কাছে গান শিখতে শুরু করে দিলেন পণ্ডিতজি।

Advertisement

গুলজার

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৩৪
Share:

পাহাড়ী সান্যালের কাছে বছর দুয়েক থেকে, ভীমসেন জোশী চলে গেলেন জলন্ধরে। সেখানে তখন বছরে এক বার রমরমিয়ে বসে হরবল্লভ সংগীত সম্মেলন। আসেন ভারতবিখ্যাত সব ধ্রুপদী শিল্পীরা। সেখানে এক জন দৃষ্টিহীন ধ্রুপদী সংগীতশিল্পীর কাছে গান শিখতে শুরু করে দিলেন পণ্ডিতজি। সেখানেও ছিলেন বছর দুয়েক। সামনের একটা হোটেলে দু’বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন সেই পুণ্যাত্মা।

Advertisement

এই হরবল্লভ সংগীত সম্মেলনে ভীমসেন জোশী গান শুনলেন সওয়াই গন্ধর্ব-এর। তিনি ছিলেন পুণের কাছেই ধারওয়ারের বাসিন্দা। ভীমসেন জোশী তাঁর কাছে গিয়ে, পাকাপাকি ভাবে নাড়া বাঁধলেন তাঁর কাছে। সেখানে গুরুগৃহে থাকার মতো করেই সব পাঠ নিলেন। গুরুর স্নান-খাওয়ার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে গুরুগৃহ পরিষ্কার করার ভারও পালন করেছিলেন পণ্ডিতজি। আমায় এক দিন বলেছিলেন, ‘এক জনের কথা খুব মনে পড়ে। আমি যখন গুরুজির জন্য কলসি করে স্নানের জল আনতে যেতাম, এক মহিলা প্রথম দিকে রোজ আমায় নজর করতেন। তার পর থেকে আমি জল আনতে গেলে আমায় দাঁড় করিয়ে এক গ্লাস করে দুধ খাইয়ে দিতেন। কী আশ্চর্য না?’

শিক্ষা শেষ হলে পণ্ডিতজি চলে আসেন মুম্বইতে। অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে গান করেন। তার পর এইচএমভি থেকে তাঁর রেকর্ড বেরোয়। আর তার পর যা, সে তো ইতিহাস জানে আর আমরাও কিছু কিছু জানি।

Advertisement

পণ্ডিতজি অত বড় মানুষ, আবার তেমনই ছেলেমানুষ। তিনি কত পুরনো লোক, এ কথা এক দিন আমায় বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ওহে বাছা, আমি বেগম আখতার-এর গান তখন শুনেছি, যখন ও দাঁড়িয়ে গাইত।’ অবাক হয়ে বললাম, তার মানে? উনি বললেন, ‘আরে, আগে তো লোকে দাঁড়িয়ে গাইবার সুযোগ পায়। সেই স্তর থেকে উত্তরণ ঘটলে তবে কিনা বসে, জুত করে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইবে। ওকে যখন থেকে চিনি, তখন ও দাঁড়িয়ে গাইত।’

এক বার ভীমসেন জোশী কলকাতায় গান গাইতে এসেছেন। সামনের সারিতে এসে বসলেন পাহাড়ী সান্যাল। গান শেষ হওয়ার পর, পণ্ডিতজি পাহাড়ী সান্যালকে গিয়ে বললেন, ‘ম্যায় আপ কা ওহি জোশী হুঁ।’ পাহাড়ী সান্যাল এত চমকে গেলেন, রিঅ্যাক্টও করতে পারলেন না। যে তাঁকে টিফিন পৌঁছে দিত, সে এত নামকরা গায়ক হয়েছে! পাহাড়ীবাবুর সেই মুখটা পণ্ডিতজি ভোলেননি।

পণ্ডিতজি খুব গাড়ি চালাতে ভালবাসতেন। তখনকার কালে একখানা মার্সিডিজ ছিল। নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন ম্যাঙ্গালোর, ব্যাঙ্গালোর, আরও অনেক জায়গায়। কত সময় নিজে গাড়ি চালিয়ে ফাংশন করতে চলে গিয়েছেন। ওঁকে দেখলে মনে হত, জীবনকে যেন উনি লবডঙ্কা দেখিয়ে বাঁচতে চান। এক দিন সকাল-সকাল ওঁর বাড়ি গিয়ে দেখি, ব্রেকফাস্টে পরোটার সঙ্গে আচার খাচ্ছেন জমিয়ে। আমি দেখে তো থ। বললাম, ‘আপনি আচার খাচ্ছেন! শুনেছি, গায়করা এ সব একেবারে খান না!’ উনি বললেন, ‘এত বছর এত ঘণ্টা করে রেওয়াজ করে আমার গলাটা একটা শক্ত কাঠের মতো হয়ে গিয়েছে। এর ওপর যাই করো, এর কিস্যু হবে না।’

পণ্ডিতজি ড্রিংক করতে সাংঘাতিক ভালবাসতেন। একটা সময় ড্রিংক করাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, ওঁকে চোখে চোখে রাখতে হত। মুম্বইয়ের একটি অনুষ্ঠানে পণ্ডিতজি আর ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে গিয়েছি। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে বললেন, ‘আমি একটু বাথরুম যাচ্ছি।’ আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। হঠাৎ পেছন থেকে হন্তদন্ত হয়ে ওঁর স্ত্রী এসে বললেন, ‘ওকে বাথরুম যেতে দিয়ো না।’ আমি থতমত। একটা লোক বাথরুম যেতে চাইছে, তাঁকে কী করে আটকাই? বললাম, ‘তা আবার হয় নাকি?’ উনি বললেন, ‘আরে বাবা, জানো না, নিশ্চয়ই বাথরুমে কোথাও বোতল লুকনো আছে। ঠিক খেয়ে আসবে।’ আমি আটকাতে পারিনি। পণ্ডিতজি খেয়েছিলেন কি না, সে খোঁজও নিইনি। সিধে সিটে গিয়ে বসে পড়েছিলাম।

এর চেয়েও আশ্চর্য ঘটনা আছে। ডাক্তার নিষেধ করেছেন ড্রিংক করতে, তবু পণ্ডিতজিকে নিরস্ত করা যাচ্ছে না। তাই পণ্ডিতজির স্ত্রী আর দুই ছেলে মিলে ঠিক করলেন, ওঁকে ঘরে নজরবন্দি করে রাখবেন। ঘরেই খাবার-ওষুধ দেওয়া হবে, আর বাথরুম তো লাগোয়া, তাই ওঁর কোনও অসুবিধে হবে না। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ রাখাই স্থির হল। দিন দুয়েক এ রকম কাটল। তার পর বাড়ির সবার মন একটু গলল। পণ্ডিতজিকে দিয়ে প্রমিস করানো হল, আর মদ ছোঁবেন না। যেই দরজা খোলা হল, পণ্ডিতজি একটা মাঝারি সাইজের পোঁটলা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন বাড়ির কাছের মন্দিরে। পোঁটলা খুলে মাতৃমূর্তির সামনে রেখে মা দুর্গাকে বললেন, ‘হে মা, আমার স্ত্রী অত্যন্ত নির্দয়, ওর কোনও কিছুই প্রাপ্য নয়। তাই ওর যত গয়না আমি তোমার চরণে দিয়ে গেলাম।’ বলে গটগট করে হাঁটা দিলেন।

বাড়ির লোকজন খুঁজেপেতে পিছু নিয়ে মন্দিরে এসে দেখে, পণ্ডিতজি ওঁর স্ত্রীর যত গয়না ঘরের আলমারিতে ছিল সব একটা চাদরে বেঁধে মন্দিরে দান করে দিয়েছেন। মদ না খেতে দেওয়ার প্রতিশোধ। কোনও মতে বাড়ির লোকেরা মন্দিরের লোকজনকে বুঝিয়ে সেই গয়না উদ্ধার করে।

এমন একটা লোক, যিনি একটা উচ্চমার্গে বাস করেন সংগীত নিয়ে, আবার একেবারে শিশু ভোলানাথ হয়ে যান প্রাত্যহিক জীবনে। এমন কনট্রাস্ট না থাকলে এমন শিল্পী হওয়া যায়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন