পান্তাভাতে…

বন্ধুত্বের ভাউচারে সই

বা সু আমাকে প্রথম বার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা পড়ে শুনিয়েছিল। চার বাংলা বলে একটা জায়গায় আমি তখন ভাড়া থাকি। সেখানে বিমলদা’র অ্যাসিস্ট্যান্ট দেবু সেনের মারফত আমার আলাপ বাসু ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তখন আমাদের একটা হইচই বাঙালি আড্ডা ছিল। এমন মজেছিলাম, মাঝে মাঝে ধুতি-পাঞ্জাবি পরাও শুরু করে দিলাম।

Advertisement

গুলজার

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৫ ০০:০০
Share:

বা সু আমাকে প্রথম বার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা পড়ে শুনিয়েছিল। চার বাংলা বলে একটা জায়গায় আমি তখন ভাড়া থাকি। সেখানে বিমলদা’র অ্যাসিস্ট্যান্ট দেবু সেনের মারফত আমার আলাপ বাসু ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তখন আমাদের একটা হইচই বাঙালি আড্ডা ছিল। এমন মজেছিলাম, মাঝে মাঝে ধুতি-পাঞ্জাবি পরাও শুরু করে দিলাম। বাঙালি খাবার তো চিরকালই পছন্দ। কেবল তখনও একটা বাঙালি প্রেমিকা ছিল না, এই যা খামতি। বাসুর আর আমার মধ্যে বন্ধুত্বটা তৈরি করেছিল কবিতা। ও নানা রকম কবিতা আবৃত্তি করত। বাসু নিজেও যে এক জন কবি ছিল, সে কথা কম লোকই জানে। ওর বহু কবিতা তখন বাংলার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। আমিও তখন উৎসাহী হয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা অনুবাদ করি।

Advertisement

বাসু তখন বিমলদার সঙ্গে কাজ করে, আমি করি না। পরে আমি বিমলদার সঙ্গে কাজ করা শুরু করি, তত দিনে বাসু নিজে সিনেমা করবে বলে মেতে উঠেছে। ওর প্রথম সিনেমা ‘উসকি কহানি’। ছোট বাজেটের সিনেমা। আর তার পর থেকে ওর সব সিনেমাই ছোট বাজেটের। আমরা বন্ধুরা মিলে কাজ করি। কেউ কখনও কোনও পয়সা পাই না। এবং আমাদের পয়সা না দেওয়াটা, বাসু মনে করত, ওর জন্মসিদ্ধ অধিকার। ওর যুক্তি: যারা কাজ করছে, তারা যদি অন্য কোথাও থেকে রোজগার করে, তা হলে তাদের পয়সা দেওয়ার মানেই নেই। এমনকী ‘আবিষ্কার’ সিনেমাটা করার সময় বাসু রাজেশ খন্নাকে বলেছিল, ‘শোনো, তোমার দরকার একটা ভাল সিনেমা, একটা ভাল চরিত্র, তোমার টাকার দরকার নেই। তুমি অলরেডি এক জন সুপারস্টার।’ স্মল বাজেটের ফিল্মের ক্ষেত্রে এ যুক্তিটা আমি কতকটা ঠিকই মনে করি। আমরা বন্ধুরা মিলে এ রকম অনেক সিনেমা নিজেদের মনের মতো করে তৈরি করেছি। দর্শক নেয়নি, কিন্তু দারুণ তৃপ্তি পেয়েছি।

প্রথম থেকেই অন্য ধাঁচের সিনেমা তৈরি করার ঝোঁক ছিল ওর। ওর সিনেমা ফেস্টিভ্যাল-এ যেত। এক বার মস্কো গিয়েছি ওর সঙ্গে। খুব ঠান্ডা। নিজের ওভারকোটটা দিয়ে বলল, ‘তুই এটা পর, আমায় তোর শালটা দে।’ দিলাম। এক দিন পরেই বাসুকে ফেরত দিয়ে বললাম, ‘শোন, আমি এত ভারী ওভারকোট পরতে পারব না। মনে হচ্ছে, তোকেই ঘাড়ে করে নিয়ে বেড়াচ্ছি।’ ওভারকোট ফেরত হল বটে, তবে আমার শালটা আর হল না। বাসুর কোনও দিন মনেও হয়নি শালটা ফেরত দেওয়ার দরকার আছে। এত বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলাম আমরা।

Advertisement

এক দিন সকালে বাসু ফোন করে বলল, ‘চলে আয়। আমাদের সঙ্গে খাবি। আমিই রান্না করছি।’ বাঙালি রান্নার লোভে লোভে চলে গেলাম। বাসু খুব ভাল রাঁধত। আমার তো মনে পড়ে না রিঙ্কি, মানে বাসুর বউ, কোনও দিন রেঁধে খাইয়েছে। বাড়িতে নেমন্তন্ন মানেই বাসু রাঁধবে। গিয়ে দেখি এক বিড়ম্বনা। ও তখন ‘গৃহপ্রবেশ’ সিনেমাটা তৈরির তোড়জোড় করছে। আমায় বলল, ‘লোগোঁ কে ঘর মে রহতা হুঁ’ এই গানটার সময়, আর অন্য একটা সিনে অভিনয় করতে হবে। আমি তো কিছুতেই রাজি হব না। বাসু স্ট্রেট বলল, ‘তা হলে তোমায় খেতে দেব না আজ।’ খাওয়ার লোভে রাজি হলাম। গানটায় বসে থাকার আর চা খাওয়ার অভিনয় করলাম। অন্য আরও একটু করেছিলাম, সেটা বোধহয় ডাবিং-এর সময় দেখা গেল, জুতসই হয়নি। এক দিন সকালে হন্তদন্ত হয়ে আমার বাড়ি এল। তখন আমি জুহুতে থাকি। হাতে একটা ভাউচার। বলল, ‘সই কর, আমার সিনেমায় গান লেখার জন্য তোকে টাকা দেব।’ আমি হতভম্ব। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। তা-ও আবার ফাঁকা ভাউচার। বললাম, এ তো ফাঁকা। বলল, ‘হ্যাঁ, এটা আমার ইনকাম ট্যাক্সের জন্য দরকার। আর শোন, আমায় দুশোটা টাকা দে তো।’ সটান বেরিয়ে গেল।

বাসুর আর একটা দোষ বা গুণ, যাই বলি— ভারী বকবক করত। হয়তো আমার বাড়ি এসেছে। সেখানে আমার সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছে। বাসু তাকে চেনেও না, কিন্তু নানা গল্প করতে শুরু করত। তার কী সমস্যা, তার এলাকায় কী হচ্ছে। কী করে তার সমস্যার সমাধান করা যায়। এমনকী পরের দিন এসে আমায় জিজ্ঞেস করছে, ‘হ্যাঁ রে, ওই লোকটার সেই সমস্যাটা মিটেছে? না হলে আমি ওকে চিফ মিনিস্টার পর্যন্ত নিয়ে যাব।’ বাসু প্রায় দৌড়ে গিয়ে লোকজনকে সাহায্য করতে ভালবাসত। আর খুব সহজে লোকের খুব কাছের হয়ে উঠত। তবে বলতেই হবে, বাসুর এই বকবকানি এক বারই মাত্র আমায় বিরক্ত করে তুলেছিল। সে দিন সকালে বিমলদা চলে গেছেন। আমি দিশেহারা। তখনও বাসু বিমলদার মৃত্যু নিয়ে হাজার কথা বলে চলেছে, এমনকী শ্মশানেও।

আবার এই বাসু যখন হাসপাতালে, তখনও ভারী খারাপ লেগেছিল, ভারী খারাপ। খুব যে অসুস্থ ছিল, তেমনটা নয়। ‘আস্থা’ রিলিজ হয়েছে তখন। সেই সিনেমারই প্রিমিয়ার হওয়ার কথা আমেরিকায়। আমায় বলল, ‘তুই চলে যা আমার হয়ে। আমি তো আর কোনও দিন যেতে পারব না।’ বোধ হয় ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে কিছু বুঝেছিল। আমি এমনিতে বন্ধুদের মধ্যে খুব জেদাজেদি করি না। কিন্তু সে দিন গোঁয়ারের মতো বললাম, ‘বাসু, আমি এখন তোর কাছেই থাকব। তাতে আমেরিকায় তোর ফিল্ম-প্রিমিয়ার ভাল না হয়, না হবে। তুই অন্য লোক দেখ।’

এখন ভাবি, কত ঠিক করেছিলাম। দিন কয়েক পর বাসু সব বকবকানি নিয়ে চলে গেল। হঠাৎ যেন একটা নিস্তব্ধতা আমায় গ্রাস করে নিল। এখনও মাঝে মাঝে চারদিকটা অসহ্য চুপচাপ হয়ে থাকলে মনে হয়, বাসুকে এক বার ডাকলে হত না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন