দূরদর্শনের ২৫ বৈশাখ ও শঙ্খ ঘোষ

কলকাতায় টেলিভিশনের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটা বিশেষ অনুষ্ঠান হোক, ইচ্ছে নিয়ে গেলাম আমার শিক্ষক শঙ্খ ঘোষের কাছে। শঙ্খদা স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে বললেন, এ তো ছবি বানানোর কাজ, এটা তো আমার কাজ নয়। অনেক দিনের অনুরোধ, আবদারের পরে রাজি হলেন। সে বারে বাইশে শ্রাবণ পড়েছিল ৭ অগস্ট, অবনীন্দ্রনাথের জন্মদিনও ৭ অগস্ট। দুই অসামান্য মানুষের সম্পর্ক নিয়ে শঙ্খদা লিখে দিলেন অসাধারণ স্ক্রিপ্ট— ‘জন্মদিন মৃত্যুদিন’। সেই শুরু।

Advertisement

পঙ্কজ সাহা

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৫ ০০:০৪
Share:

দূরদর্শনের এডিটিং রুমে শঙ্খ ঘোষ (ডান দিকে), সঙ্গে পঙ্কজ সাহা। ১৯৮৪ সালের ছবি।

কলকাতায় টেলিভিশনের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটা বিশেষ অনুষ্ঠান হোক, ইচ্ছে নিয়ে গেলাম আমার শিক্ষক শঙ্খ ঘোষের কাছে। শঙ্খদা স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে বললেন, এ তো ছবি বানানোর কাজ, এটা তো আমার কাজ নয়। অনেক দিনের অনুরোধ, আবদারের পরে রাজি হলেন। সে বারে বাইশে শ্রাবণ পড়েছিল ৭ অগস্ট, অবনীন্দ্রনাথের জন্মদিনও ৭ অগস্ট। দুই অসামান্য মানুষের সম্পর্ক নিয়ে শঙ্খদা লিখে দিলেন অসাধারণ স্ক্রিপ্ট— ‘জন্মদিন মৃত্যুদিন’। সেই শুরু। পর পর কয়েক বছর ওঁর কাছ থেকে কয়েকটি অসামান্য স্ক্রিপ্ট পেয়েছি। পরের বছর রবীন্দ্রনাথের জীবনকালে নানা পঁচিশে বৈশাখ উদ্‌যাপন নিয়ে ‘জন্মদিনের ধারা’, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা নিয়ে ভিন্ন ধারার তথ্যচিত্র ‘রূপের অদৃশ্য অন্তঃপুরে’ ১৯৭৭-এ, আর ১৯৮৪-তে ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’।

Advertisement

দৈনন্দিন সব অনুষ্ঠান করে তার পর এই সব বিশেষ অনুষ্ঠান করতে হত। তাই দু-তিন দিনের বেশি সময় পেতাম না। ‘জন্মদিনের ধারা’ করার সময়, শঙ্খদাকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমেই গেলাম প্রমথনাথ বিশীর কাছে। শান্তিনিকেতনে তাঁর ছাত্রজীবনে দেখা কবির জন্মোৎসবের কথা বললেন তিনি। সেখান থেকে মৈত্রেয়ী দেবীর কাছে যাব জেনে মৃদু একটি শ্লেষের হাসি হাসলেন। মৈত্রেয়ী দেবী বললেন, মংপুতে ১৩৪৭ সনের ২২ বৈশাখ, আমন্ত্রিত পাহাড়িয়াদের নিয়ে কেমন ভাবে উদ্‌যাপন করেছিলেন কবির জন্মদিন। সেখান থেকে রাণী মহলানবিশের বাড়িতে যখন পৌঁছলাম, রাত দশটা বেজে গেছে। মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে দেরি জেনে রাগ করে উঠে গেলেন রাণীদি। অনেক বুঝিয়েশুনিয়ে তাঁকে ফেরত আনতে, তিনি বললেন ১৩৩৫ সনের জন্মদিনে জোড়াসাঁকোয় কবিকে দাঁড়িপাল্লার এক দিকে চাপিয়ে, অন্য দিকে তাঁর লেখা বইপত্র দিয়ে ওজন নেওয়ার মজার কাহিনি।

পরের দিন শঙ্খদাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সাতসকালে একটা অ্যামবাসাডরে ঠেসাঠেসি করে চললাম শান্তিনিকেতনে। কোথাও থামার সময় নেই, ওই প্রখর গ্রীষ্মের রৌদ্রে, সঙ্গে নেওয়া খাবার খেতে খেতে, অনুষ্ঠান নিয়ে কথা বলতে বলতে শান্তিনিকেতন পৌঁছেই ছুটলাম প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের কাছে। ১৯১০ সালে রবীন্দ্রনাথ পঞ্চাশে পা দিচ্ছেন, শান্তিনিকেতনের শিক্ষক ছাত্ররা কেমন ভাবে কবির জন্মদিন পালন করেছিলেন, শুনলাম। শান্তিদেব ঘোষ জানালেন, রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করে পেয়েছিলেন ১৯৪১ সালে তাঁর শেষ জন্মদিনে গান ‘হে নূতন দেখা দিক আর-বার।’ নন্দলাল বসুর কন্যা গৌরী ভঞ্জ বললেন, ১৩৩৩ সনের ২৫ বৈশাখ শান্তিনিকেতনে ‘নটীর পূজা’র প্রথম সফল অভিনয়ের পর জোড়াসাঁকোয় যখন অভিনয়ের কথা ভাবা হল, কথা উঠল, ভদ্রবাড়ির মেয়েরা কলকাতায় মঞ্চে নাচবে! রবীন্দ্রনাথের কানে গেলে তিনি সস্ত্রীক নন্দলাল বসুকে ডেকে পাঠালেন। নন্দলাল বসুর স্ত্রী বললেন, শান্তিনিকেতনে আমরা একটা পরিবার, আপনি আমাদের কর্তা। প্রশ‌ংসা হলে আপনার হবে, নিন্দে হলেও আপনারই হবে। শুনে রবীন্দ্রনাথ ‘নটীর পূজা’য় যোগ করলেন এক নতুন চরিত্র ‘উপালী’, নিজে সেই ভূমিকায় মঞ্চে এলেন। তাতেও সমালোচনা এড়াতে পারেননি।

Advertisement

অনুষ্ঠানের জন্য রাণী চন্দের স্মৃতিকথাও ফিল্ম করতে চেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু তাঁর চেহারায় সেই আগের লাবণ্য নেই বলে তিনি ক্যামেরার সামনে আসতে রাজি হলেন না।

শান্তিনিকেতনে অনেক রাত পর্যন্ত শুটিং করে আমরা যখন কলকাতায় ফিরব বলে গাড়িতে উঠছি, সবাই বলল, এত রাতে এ রাস্তায় কোনও গাড়ি চলে না, মাঝে দুটি জঙ্গল আছে, ওখানে ডাকাতরা চড়াও হয়ে সব কেড়ে নেবে, মেরেও ফেলতে পারে। কিন্তু আমাদের যে করে হোক ফিরতে হবে, সকালে এডিটিংয়ে বসতে হবে, না হলে পঁচিশে বৈশাখে অনুষ্ঠান যাবে না। শঙ্খদা আর আমি গেলাম বোলপুর থানায়, পাহারারত পুলিশ বন্দুক উঁচিয়ে ‘হল্ট, হল্ট!’ বলে চিৎকার। আমরা তো এগিয়েই চলেছি। কাছে পৌঁছতে বললেন, আমি তো এখুনি গুলি করতে যাচ্ছিলাম, আপনারা কারা! পুলিশের সাহায্য চাইছি শুনে বললেন, তাঁদেরই কে সাহায্য করে তার ঠিক নেই। প্রাণ হাতে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। মনে হল, ডাকাতদের হাতে পড়লে যা করার করুক, ক্যামেরাটাকে যে করে হোক বাঁচাতে হবে। শঙ্খদা মজার মজার গল্প করে আমাদের মনোবল জাগিয়ে রাখতে লাগলেন। দার্জিলিং মোড়ে পৌঁছতেই যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। সেখানে ছোট্ট একটা ধাবা ছাড়া আর কিছু ছিল না। ক্লান্ত ড্রাইভার একটা খাটিয়ায় শুয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল, তার আর ওঠার শক্তি নেই। আমরা হতাশ হয়ে বসে পড়েছি, এত করেও শেষরক্ষা হল না! হঠাৎ সাউন্ড রেকর্ডিস্ট শান্তনু মজুমদার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তোরা সব গাড়িতে ওঠ। তার পর শান্তনু স্টিয়ারিংয়ে বসে সারা রাত ড্রাইভ করে ভোরবেলায় টালিগঞ্জে স্টুডিয়োতে পৌঁছে দিল। আমরা কোনও রকমে স্নান সেরে এসে বসলাম এডিটিংয়ে। শঙ্খদাও এসে গেলেন। কোনও বিরতি নেই, ওঠা নেই, খাওয়া নেই, একটানা এডিটিংয়ে গড়ে উঠল বাংলা টেলিভিশনের প্রথম পঁচিশে বৈশাখের অনুষ্ঠান ‘জন্মদিনের ধারা’।

pankajsaha.kolkata@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন