Looking back at 2025

দিনগুলি রাতগুলি

সীমান্তের এ পারে-ও পারে যেমন কাঁটাতার ভিন্ন কোনও বৈসাদৃশ্য থাকে না, একত্রিশে ডিসেম্বর আর পয়লা জানুয়ারির কাঁপুনিতে তফাত থাকে না কোনও। তবু এক তারিখ, ছুটির ভোরে কুয়াশার মশারি ছিঁড়ে যতটুকু কুসুমরং আলো এসে পড়ে, ওকেই মনে হয় মহার্ঘ ‘ফার্স্ট ফ্লাশ’। প্রতি বছরের মতো, এ বারও শুরু হয়ে গিয়েছে ওই দিনটির জন্য উল্টোগুনতি।

সেবন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:১৫
Share:

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।

পঞ্চাশের পর থেকে বছরগুলো এমন দৌড়চ্ছে, যেন প্যাসেঞ্জারের ঝিমুনি ছেড়ে বুলেট ট্রেন। জীবনের অর্ধাংশ শালগ্রাম শিলারূপে কাটিয়ে দিয়েছি বলে অধুনা তৎপরতার একটা বেশ মোহময় মর্যাদা আছে। আগে ঢিমে তেতালায় হেলাফেলায় গড়াত দিন। এখন সে বলছে সন্ধ্যার বাতি নিবু-নিবু, বন্দরের কাল হল শেষ। ধাবমান ট্রেনের জানলা দিয়ে ছুটে যাওয়া নগর, গ্রাম, বৃক্ষ, লতা, শালুক, কচুরিপানার মতো দেখা দিয়েই দিন ও রাতগুলি দ্রুত মুছে যাচ্ছে। এক-একটা বছর যেন শুরু হয়েই ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে হুড়মুড়িয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে।

তবে এ দেশের বুলেট ট্রেন তো! জুতো কিনতে মোজা ফুরানোর মতো ট্রেনের সম্ভাব্য গতির সঙ্গে তার দেশীয় ট্র্যাকের মিলমিশ হয় না। ঠিক তেমনই দৌড়বাজ দিনের মধ্যে অলস অকেজো দু’-চারটে ফালতু দিন এমনিই পড়ে থাকে। স্রেফ কিছু না করে কোলবালিশে পা তুলে পছন্দের বইয়ে ডুবে যাওয়া, অথবা বাগানের পড়ন্ত রোদ্দুরে পরিশ্রমী পিঁপড়ের হেঁটে যাওয়া দেখা‌। যতই দৌড়োক দিন বা আলস্যে অঢেল হোক, সাকুল্যে হাতে তো ওই চব্বিশ ঘণ্টাই। এ তো তিন প্রজন্মে ফলদায়িনী তালগাছ কিংবা চারশো বছুরে প্রাজ্ঞ কচ্ছপের সময়কাল নয়, ফলে বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের মতো তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের পর তার একটা হিসাব-নিকাশের অভ্যাস থেকে যায়।

বছর গুটিয়ে আসে ইংরেজি নববর্ষের পৃথিবীজোড়া উৎসব ঘিরে। এক দয়ালু মহামানবের কাল্পনিক জন্মদিন পালন করে যে উৎসবের সূচনা, একত্রিশ তারিখের সুসজ্জিত আলোকমালায় তার সমাপ্তি-ঘণ্টা বাজে। অধুনা কালান্তক বর্ষার শেষে দু’-চার দিন হেমন্তর বিষণ্ণতা উপহার দিয়েই শীত এসে পড়ে। শুধু রাজ্য নয়, জেলাভেদেই শীতের উষ্ণতা ও দংশন আলাদা। পুরনো শাড়ি আর ফোঁড়ের ওম দেওয়া কাঁথা এখন গ্রামগঞ্জের বা মধ্যবিত্তের নিত্য অভ্যাস থেকে শৌখিনের মজুরি খাটছে। তরুণ প্রজন্মের অবহেলায় লেপও গেছে অস্তাচলে। টিকে আছে মাত্র কম্বল। ঢালাও সস্তা, দামি, চিনে কম্বল ড্রাই ওয়াশের প্যাকেট থেকে নেমে পড়তে পড়তেই মনে হয়, বছরটা ভাল গেল না তেমন।‌ কত কিছু ভেবেও করা হল না।‌ কত কথা রাখা হল না।‌ যেমন বছর শুরুতেই যে সব বিষয়ে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা নেওয়া হয়েছিল, বচ্ছর শেষে সে সব গেল কোথায়? ওই যে পেনের মুখ লাগিয়ে রাখার কথা ছিল, ওই তো হাঁ-মুখ পেন‌ এক দিকে, ছিপি বইয়ের ভাঁজে। হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের মহাভারত তাকে তুলে না রেখে, হয় পড়ার একটা চেষ্টা, না হলে কোথাও দান করে দেওয়া, সেও তো এ বছর হল না।‌

জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে একেবারে প্রথম দিকে যে আমি উৎসাহে টগবগে হয়ে হাঁটতে লেগেছিলাম পাক্কা কুড়ি মিনিট, পাড়ার লাল্টুর জিমে গিয়েও ভর্তি হয়ে গেলাম, তার পর ক্রমশ ডান হাত কনকন, মাথা বনবন, কাঁধে টান, সন্ধেবেলা ঘুম-ঘুম, অমুক পত্রিকার লেখার তাগাদা, অমুক সমিতিতে ভাষণ— জিমের ট্রেনার কঠিন মুখে বলে‌ দিলেন, “ম্যাডাম, আপনার ব্যায়ামের অ্যালার্জি হয়েছে, আপনি বরং যেমন হাঁটছিলেন, তেমন হাঁটুন।”

জানুয়ারির শেষ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে আবার গভীর ব্যস্ততা। কলকাতা বইমেলা বলে কথা। মনে মনে ভাবনা, এ বারে আর যাব না, আর বই কিনব না, আগের বারেরগুলোই পড়া হয়নি। মেলা মানে তো সেই থোড় বড়ি খাড়া, আর খাড়া বড়ি থোড়। বাবা রে বাবা, এত লোকজন, গুঁতোগুঁতি! ডিসকাউন্ট তো কলেজ স্ট্রিটে অন্য সময়ে বেশি! ওই তো সবাই সেলেবদেরই বই কিনবে, এ সব ভেবেটেবে টকাস করে প্রথম দিনেই দোকান খুলতে না খুলতে হাজির। ঝলমলে মোটাসোটা বইয়ের মাঝে নিজের সরু মতো একখানি কবিতার বই খুঁজছি তখন। পিরিতি পরমনিধি তিনিই যেন প্রাণভোমরা! এ দিক-ও দিক ঘুরছি আর স্টলের কাছে এসে অজুহাতে এক বার উঁকি মেরে যাচ্ছি। কেউ কি আদৌ দেখল? কিনল কি কেউ? তার পর দু’-চার পাতা পড়ার পর ‘দুচ্ছাই, রাবিশ!’ বলে তাকে রেখে চলে গেল? মন বিচিত্রগতিতে বিভিন্ন দিকে দৌড়োয়। এত্তবড় বইমেলায় তরুণ কবিদের নতুন বই বেরোল? রাধারাণী দেবী, কবিতা সিংহ, নবনীতা দেব সেন, দেবারতি মিত্র, বিজয়া মুখোপাধ্যায়দের কবিতা নিয়ে মেলায় কি কোথাও আলোচনার বন্দোবস্ত হল? একই বঙ্গে থেকে ‘অপর’ করে দেওয়া বাক্য ‘সুদূর উত্তরবঙ্গ থেকে অমুক কবি এসেছেন’, এই ঘোষণা কবে বদলে গিয়ে অমুক কবি ও লেখক এসেছেন শুনতে পাব?

এর পর মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন পেরিয়ে দুদ্দাড়িয়ে বছর দৌড়তে থাকল। সেই তো এক রুটিনে বাঁধা দিন। সকাল-সকাল টিফিনবক্স, ফ্লাস্ক, জলের বোতল, ওষুধ, চশমা, ফোন, শাড়ি, কানের দুল এ-ওকে খুঁজতে থাকে। একটা ছুটির দিন দশটা না-পড়া বই জড়ো করে, একটাও শেষ না করে আবার বই কিনে ফেলি। অর্ধসমাপ্ত দেশবন্দনা লেখার ফাঁকে রাষ্ট্র দ্বারা বিপ্লবী, প্রতিবিপ্লবীদের ছিন্নভিন্ন করার উল্লাস দেখি, আর চলে যাই এ বছরে আসা পরিযায়ী পাখিদের সালতামামিতে।

এ ভাবেই কিছু মাস গড়াতে গড়াতে পুজো এসে গেল, মানে শেষপাতে মিষ্টির দিকে চলে যাওয়া।

শৈশবে যে ঢিমে তেতালার বছর গড়াত, তাদের জৌলুস ছিল না, কিন্তু ঘটনার ঘনঘটা ছিল। নিশ্চিন্দিপুরের অপুর চোখে ঘেঁটুফুল যে বিস্ময় নিয়ে আসত, আমাদের মফস্সল শহর ছিল খানিক তেমনটাই। ছড়ানো-ছিটানো একান্নবর্তী বাড়ি। সব সময় কিছু না কিছু ঘটবেই। শৈশবের বহু উল্লেখযোগ্য ঘটনা মুছে কিঞ্চিৎ অনুল্লেখ্যরা কেন থেকে যায় জানি না। যেমন মনে থেকে যাওয়া একটা বছর প্রায় গড়িয়ে গেছিল কসমস ক্লাবের পেলের জন্য। মোহনবাগানের সঙ্গে খেললেন পেলে, যাঁর তৎকালীন ক্রীড়াকৌশল দেখে বঙ্গনিন্দুকরা বলতে শুরু করলেন, যাত্রাভিনেতা শান্তিগোপাল পেলে সেজে খেলতে নেমেছেন। চার দিকে শুধু এই বিষয়ে আলোচনা। স্কুলে সুলতা, লেখা, শ্রবণাদের চমকে দিয়ে পেলের এই এত বড় পারিবারিক নাম মুখস্থ করার জন্য পাওয়া যাচ্ছিল স্পেশাল পিঠ চাপড়ানি। যে-হেতু মোহনবাগানের সঙ্গে খেলেছিলেন পেলে, তাই ঘোরতর বাঙাল পরিবেশে আমি হয়ে গেলাম ঘটি ক্লাবের সমর্থক!

আর এক বছর যেমন গেল উনিশ বছরের জাঠ যুবা কপিল দেব নিখাঞ্জের জন্য। এক দিকে রুল, অন্য দিকে সাদা একখানা লম্বা খাতা বহু কষ্টে জোগাড় করা হল। খবরের কাগজ কেটে তাঁর আবছা ছায়ামাখা ছবি সেঁটে ,পাশে স্কোর লিখে, মাঝেমধ্যে পাতা খুলে দেখে নেওয়া শুরু হল। ক্রমশ কপিল দেব ছক্কা হাঁকাচ্ছেন আর অঙ্কের খাতায় শূন্য জমা হচ্ছে। অঙ্কে, সংস্কৃতে যাকে বলে ‘কিং অব স্পেকট্যাকল’ অর্থাৎ দু’-ইনিংসে শূন্য! এই মগ্নতার খেসারত দিতে হল বছর শেষে, অর্থাৎ, ২৪ ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষার রেজ়াল্টের পাতায়। কপিল দেবের জন্য বল একেবারে প্রায় স্কুলের মাঠের বাইরে!

এ তো গেল তারকার প্রতি হৃদয়দৌর্বল্য। আর এক বছর গেল মাংসের বাজারে বিক্রি হয়ে যাওয়া হাঁসের জন্য। এমনিতেই আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে চিড়িয়ার অভাব নেই। এক দিন জেঠতুতো ভাই আম-কাঁঠাল ঘেরা খোলা উঠোনে, বগলে এক ঘোলাটে পাতিহাঁস নিয়ে উপস্থিত হল। সে রসনালোভেই কিনেছিল, কিন্তু বাড়িতে জ্যান্ত হাঁস কাটার পরিকল্পনায় জেঠিমা বাধ সাধলেন। ভাগ্যের ফলে আমাদের বাড়িতে হাজির হয়েছে। দাঁড়িয়েই গোল বৈঠক শুরু হল। অবলা প্রাণী, কাউকে দিয়ে দিলে সে আবার কেটে খেয়ে ফেলবে, ফলে ঠাকুমা মা বাবা কাকা কাকিমা দোলাচলে ভুগছেন। বাড়িতে কুকুর পায়রা মুরগি ইত্যাদির অভাব না থাকলেও হাঁসের মতো জলে-কাদায় চরে বেড়ানোর মতো প্রাণীকে এই শুকনো মাটিতে রাখা হবে কী ভাবে? সর্বসমস্যা সমাধানকারী ছোট কাকা নিদান দিলেন, উঠোনেই এক গর্ত করে ফেলা হোক! এমনিতেই আমাদের আস্ত শহরটা পাহাড়ি নদীর পরিত্যক্ত খাতের উপর বসে আছে। বালি মাটির জন্য একখানি পুকুর নেই সারা শহরে, সেখানে চৌবাচ্চা হেন জলাধারে জল আসবে কোত্থেকে? কিন্তু এ বাড়ির লোকগুলোর পশুপাখি গাছপালা বিষয়ে চিরকাল কুছ পরোয়া নেই ভাব! ফলে খোঁড়া হল গর্ত। কুয়ো, টিউবওয়েল থেকে বালতি-বালতি জল ঢালা হল। কোথায় কী! বালি মাটি হুশ-হুশ করে টেনে নিচ্ছে জল। ও দিকে ড্যাবডেবে চোখের নির্বিকার হাঁস, ঝুড়িবন্দি হয়ে প্যাঁকপেকিয়ে ডেকে চলেছে। এ বারে পলিথিন লাও! তখন এত প্লাস্টিকের রমরমা নেই। বিছানা ভেজানো কোনও খোকা-খুকুর অয়েল ক্লথ চলে এল। গর্তের ভিতর বিছিয়ে তার চার পাশে পাথর চাপা দিয়ে সেই অয়েল ক্লথের উপর জল ঢালা শুরু হল। কাকা একটি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের হেডমাস্টার, বাবা একটি কলেজের অধ্যক্ষ, কিন্তু তখন তারা বুড়ো আংলার মতো সুবচনী খোঁড়া হাঁসের সঙ্গে মানসভ্রমণে মগ্ন! এর পর শুরু হল মুক্তজীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধু ইচ্ছায় হাঁসকে জলের ভিতর ছাড়ার জন্য ঠেলাঠেলি। রান্নাঘর থেকে কাঁচা মাছ চলে এল। হাঁস মাছও খায় না, জলেও নামে না। কিছুতেই হাঁসের মন পাওয়া যায় না। জলে ঠেলা হয় আর সে ভীত ত্রস্ত হয়ে জল থেকে উঠে, উঠোন পেরিয়ে ঘরের দিকে রওনা দেয়। ‘হাঁসে উঠোন নোংরা করে’ বলা হলেও ঠাকুমার কথা ধোপে টিকল না। বাবা হিসাব করতে বসল, ধাতস্থ হলেই দিনে ক’টা ডিম দেওয়ার সম্ভাবনা আছে এর! বলা বাহুল্য, সে হাঁস এ বাড়িতে থাকাকালীন একটিও ডিম দেয়নি। হাঁস ও দুই বালক-পুরুষের কর্মকাণ্ডে সে বছরটা ভারী মনোরম ছিল।

বছর-শেষ মানে বাঙালির কাছে কেক-পেস্ট্রির পাশে পিঠে-পায়েসও।‌ দার্জিলিং কার্শিয়াং-এর পাহাড়ে, বাঙালি চাকুরেদের বাড়িতে হ্যাট-কোট-প্যান্ট বজায় থাকলেও বাঙালিয়ানা থাকত পুরোদমে। খেলনা ট্রেনে ইউরোপিয়ান ক্লাবের জন্যে ক্রেট ক্রেট সোডার পাশে শিলিগুড়ি থেকে চলে আসত নারকেল, চালগুঁড়ো। কেকের মধ্যে মুরগির ডিমের ম্লেচ্ছপনা গিন্নিরা হেঁশেল অবধি ঢুকতেই দিতেন না। অবশ্য পাহাড়ে থাকা বাঙালিদের একেবারে সমতলের মতো নিখুঁত নিয়মে সব কিছু চলত না। এক তো ছিল প্রতিবেশীর প্রভাব, তায় সহজলভ্যতার অভাব। যেমন নিয়মিত বেলপাতা পাওয়া যেত না বলে ঠাকুরের আসনে পিতলের বেলপাতা থাকত। ঠাকুর-দেবতারা সে আমলে খানিক স্নেহ মায়া ক্ষমা ঘেন্নায় মর্তবাসীদের দেখতেন। তাদের সুবিধা-অসুবিধাগুলো বুঝতেন বোধহয়! আমরা পাহাড় থেকে খানিক নীচে নেমে এলেও সমতলের নিয়মভ্রষ্টই ছিলাম বলা যায়। ফলে কেক-পেস্ট্রির বদলে অনেক আগেই বাড়িতে পিঠে তৈরি শুরু হয়ে যেত। সে সময়ে যৌথ পরিবার ছাড়া পাড়াপ্রতিবেশী মিলে লোকবল ছিল দেখার মতো। ঘরে ঘরে সুরমা পিসি, চারু মাসি, শঙ্করের মা, লক্ষ্মীদিদের আনাগোনা। কেউ সন্ধ্যায় বঁটি পেতে বসে গেলেন। বাগান থেকে কলাপাতা কাটার জন্যে ছুটলাম কেউ। কর্তিত পাতা থেকে রস গড়ানো দেখলে থম মেরে বসে থাকতাম। কে যেন বলেছিল, ওই তাদের রক্ত! ওই কাজ করতে আসা মাসিদের কারও মুখে শুনতাম নবান্নের কথা। যদিও আমরা সে সব জানতাম না। কলাপাতায় জমে ওঠা সাদা খইফুলের মতো নারকেল কোরায় রস টসটস করত।

উৎসব-পালাপার্বণে ভরা বছরে জড়িয়ে মড়িয়ে সবাইকে নিয়ে হেঁটে চলা পরিবারগুলোয় এক ধরনের নিভৃতি ছিল, স্বস্তি ছিল। ছিল না ধার করে হলেও সাধ্যাতিরিক্ত আড়ম্বরের প্রদর্শন। ‘হেলিকপ্টার মম’দের উৎসাহও ছিল না তেমন। বাড়ির সামনে বাঘা যতীন পার্কে খেলতে যাচ্ছি। ফিরতে হবে পাক্কা ছ’টায়। ব্যস। ওই সময়টায় আর কোনও নজরদারি নেই। সারা বছর মাঠে খেলতে খেলতে, হাঁটতে, আড্ডা দিতেই শেষ।

এই যে দিনগুলি চলে গেল, নিয়ে গেল শৈশব আর আস্ত একটা পরিবার। যেন স্লেটে ফুটে ওঠা অক্ষরগুলি মুছে মুছে নতুন অক্ষর যুক্ত হচ্ছে, আবার অনন্ত ইরেজ়ার দিয়ে সেগুলো মুছে দিয়ে যাচ্ছে কেউ। প্রতি বছরের মতোই এ বছরও স্লেট থেকে কত যে কাছের আর দূরের লোক মুছে গেল! নব্বই বছর বয়সে ছোট পিসেমশাই চলে গেলেন। আমাদের পরিবারে প্রথম বিদেশে চাকরি করতে যাওয়া ইঞ্জিনিয়ার, প্রথম প্রেমজ বিবাহের বরও। তাঁর সূত্রেই সেই কোন আমলে ইউরোপের পথেঘাটে চোর-ডাকাতের কথা শুনে মনে হয়েছিল, যাক, গল্পের বইয়ে যতই সাদা রাজপুত্তুর-রাজকন্যার মতো দেখাক, এরাও তা হলে আমাদের মতোই!

খুব হতভম্ব করে দিয়ে হৃদ্‌রোগে ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল বিদিশা নামের এক লেখক মেয়ে। আগের রাতে তার দেওয়া স্টেটাস জ্বলজ্বল করছিল পরদিনও। নীলাব্জ বলে এক আদ্যন্ত কবি ছেলেও চলে গেল। রেখে গেল স্বীকৃতিহীন মায়াময় কিছু পঙ্‌ক্তি। বিদায়ের মধ্যে যেন একটু আয়োজন থাকলে মনে হয়, মানুষটার প্রতি মনোযোগ ছিল আমাদের। এই যে ঝপ করে দরজা খুলে চিরদিনের মতো বেরিয়ে চলে যাওয়া, এ যেন হাতের মুঠো থেকে বালি খসে পড়া সময়ের মতোই, আফসোসে কোন ফল নেই।

গায়ক জ়ুবিন গর্গের অকালপ্রয়াণে তাঁর অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা দেখলাম আমরা। বিশেষ করে উত্তর-পূর্বের মানুষ নিজেদের পরম সম্পদের মতো আগলে রাখল তাঁর মায়াবী জাদু। চলে গেলেন জেন গুডঅলের মতো একজন প্রাণিবিজ্ঞানী ও পরিবেশ সংরক্ষণ কর্মী।‌

আমরা বেদনাহত বিস্ময়ে দেখলাম, যাঁরা স্বজনহত্যার নারকীয় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেল, তারাই গাজ়ার নরহত্যার সক্রিয় বা পরোক্ষ সমর্থক হয়ে উঠল। তাদের বিশ্বজোড়া সংগঠন ‘হলোকস্ট’-এর কথা ভুলতে দেয় না, কিন্তু গাজ়া ভূখণ্ডের রক্তমাখা ছিন্নশির শিশুর লাশ সন্ধ্যার শান্ত উপহারের মতো গ্রহণ করে। বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় খবরের কাগজ, সোশ্যাল মিডিয়া ভরে থাকল ক্ষুধার্ত শিশু, ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া বাড়িঘর, শরণার্থীদের অবমাননায়। অন্য দিকে ধর্মীয় রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত কমল না আর। দেশপ্রেম আর বিপ্লবের নামে যে হিংসার জয়ধ্বজা উড়ছে, সে বিষয়ে কবেই আমাদের রবীন্দ্রনাথ সতর্ক করে গেছেন। ‌ কিন্তু এখন আমরা যুক্তি, বিশ্বাস সমস্ত পেরিয়ে অর্থহীনতায় প্রবেশ করেছি। আর হিংসাই বা বলব কাকে? দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তীর উক্তি স্মরণ করে বলা যায়, “সন্ত্রাসবাদীর গুলিতে হত্যা বেশি ভায়োলেন্স, নাকি প্রতিবছর হাজার হাজার কৃষকের আত্মহত্যা বেশি ভায়োলেন্স?” যে কোনও রূপেই এই চরম পন্থার ব্যাখ্যা দেওয়া হোক না কেন, সামগ্রিক ভাবে জনমন হিংসার দিকে ঝুঁকে গেছে। না হলে জনপ্রিয়তম ‘শোলে’র যে সেন্সর করা রূপেই আপামর ভারতবাসী এত দিন মজে থেকেছে, তার ‘আনকাট আনসেন্সরড’ রূপটি দেখানোর ও দেখার জন্যে এত উদগ্র আগ্রহ থাকে কেন? ঠাকুর সাহেবের জুতোর তলার পেরেক দিয়ে থেঁতলে মারা গব্বরকে দেখার জন্য এত আহ্লাদ উথলে উঠছে কেন দেশে?

এ বছরই আমরা কয়েকটি আপাত-তুচ্ছ বিষয়কে ফুলেফেঁপে উঠতে দেখলাম। আমরা যারা টেস্ট ক্রিকেট থেকে মন বেঁধে রেখে ওয়ান ডে-তে আসতে পেরেছিলাম, তাদের চোখের সামনে তৈরি হয়ে সম্পূর্ণ হল দু’মিনিটের রিল প্রজন্ম। অণুগল্পের চেয়েও ছোট এই মৌহূর্তিক সুখকে আমরা প্রকাশ্যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেও, এর অভিঘাত প্রায় বিস্ফোরণের মতোই। অস্থির, অতি দ্রুত ধাবমান মানবপ্রজন্মের প্রতিনিধি এই রিল-সংস্কৃতি। গ্রামে, মফস্সলে, সমাজের নিচু তলায় রিল বানায় না, এখন এমন মেয়ে প্রায় খুঁজেই পাওয়া যাবে না। আর চিত্তাকর্ষক বিষয়বস্তু না পেলে বাজারে বেচা যাবে না, এমনটাও কিন্তু নয়।

আপাতভাবে যাকে আপনার সম্পূর্ণ অর্থহীন মনে হবে, এমন কর্মকাণ্ডও লোকে হাঁ করে দেখছে। এই অর্থহীনতা থেকে আর এক চলমান দৃশ্য ছবির দিকে ঘুরে গেছে পাঁচ-ছয় বছর থেকে দশ-বারোর বাচ্চারা। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘ব্রেন রট’ নামে অ্যানিমেটেড চরিত্র। ‘ব্রেন রট’ বলতে সাধারণত মানসিক ক্লান্তি, মনোযোগের অভাব এবং তুচ্ছ বা নিম্নমানের ডিজিটাল সামগ্রীতে অতিরিক্ত ডুবে থাকা বোঝায়। এটি শারীরিক সমস্যা নয়, বরং ডিজিটাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট মানসিক ও আচরণগত প্রভাবের একটি অনানুষ্ঠানিক শব্দ। ইটালীয় ‘ব্রেন রট’ এক বিশেষ ধরনের ইন্টারনেট ট্রেন্ড, যেখানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দ্বারা তৈরি অদ্ভুত এবং পরাবাস্তব ভিডিয়ো বা ছবি দেখানো হয়।

এ বিষয়ে আপনার মনে হবে, সুকুমার রায়ের হাঁসজারুর স্থূল সংস্করণ এই চরিত্ররা। কিন্তু কার্টুন চরিত্রগুলোর নাম খেয়াল করুন। জেট ইঞ্জিন লাগানো, বোমা-সহ উড়ন্ত কুমিরের নাম ‘বোম্বার্ডিয়ো ক্রোকোডিলো’। ‘বমবমবিনি গুজ়িনি’ হল উড়ন্ত রাজহাঁস, যার ডানা গুলি-বোমা বর্ষণ করছে। ‘কাপুচিনো আসাসিনো’ আর ‘এসপ্রেসোনা সিঙ্গোরা’ কফি-সুন্দরী দুই বোন মেয়ে বলেই যথারীতি ছলাকলাবিলাসী। এক চরিত্রের নামে ‘টুং টুং টুং টুং...’ এই আওয়াজ শেষই হবে না! এই যে চরিত্ররা, তাদের প্রায় অর্থশূন্য একঘেয়ে ক্রিয়াকলাপ শিশুমনকে ভোঁতা করে দিতে ওস্তাদ। যে চালাকি আর দুষ্টুমির ‘টম অ্যান্ড জেরি’ দিয়ে কার্টুনজগতে আমাদের প্রবেশ, সে রসাতলে গেছে বলা যায়।

পেলাম না কি কিছুই? অজস্র উপেক্ষা-অবজ্ঞা না দেখতে চাওয়ার মাঝে দলে দলে কবি মেয়েরা লিখতে এল। যত বছর গড়ায়, লিখতে আসা মেয়েদের সংখ্যা বাড়ে আর পুরুষ লেখক-কবিরা দৃশ্য-অদৃশ্য খাপ নিয়ে বসে। কিন্তু অন্ধ হলে তো প্রলয় বন্ধ হয় না। মেয়েরা তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দিচ্ছে ব্যঙ্গ আর অপভাষার চাবুক।

এই সাম্প্রতিক ও পরিবর্তনশীল সময়চিহ্নের পাশে চিরন্তন পৃথিবীর এক টুকরো সব সময় পড়ে থাকে। ঋতুনির্ভর পৃথিবীতে বছর শেষ মানে কিন্তু তার পরিবর্তন নয়। সীমান্তের এ পারে-ও পারে যেমন কাঁটাতার ভিন্ন কোনও বৈসাদৃশ্য থাকে না, একত্রিশে ডিসেম্বর আর পয়লা জানুয়ারির কাঁপুনিতে তফাত থাকে না কোনও। তবে ওই যে কল্পনার বাস্তবতা? এক তারিখ, ছুটির ভোরে কুয়াশার মশারি ছিঁড়ে যতটুকু কুসুমরং আলো এসে পড়ে, ওকেই মনে হয় মহার্ঘ ‘ফার্স্ট ফ্লাশ’। ভাবি, নিজেকে একটু আহ্লাদ দিয়ে বছর শুরু করা যাক। সোহাগের পমেটম ঢেকে দিক বিগত বছরের সব ভুলচুক, গ্লানি, কালিমা, ভীষ্মের মস্ত মস্ত প্রতিজ্ঞা! পয়লা তারিখটা যেন বছরের মাথায় রাজমুকুট। সারা বছর কেউ তা পরেই থাকে, কেউ মুহূর্তের জন্য পেয়ে তা হারায়, কারও হয়ে ওঠে কাঁটার বিড়ম্বনা।

যতই বলি, বছরের শুরুতে আবার সেই ছটফটানি শুরু হবে। আগামী তিনশো চৌষট্টি দিন ফেলে ছড়িয়ে না রেখে কষে বাঁধতে হবে। বড় আশা হয়, জীবন সুযোগ দেবে সব্বাইকে। যে যেমন সাধনা করবে, গায়ে গতরের পরিশ্রম ঢেলে দেবে, সে সে ভাবেই দু’-মুঠো অন্নের পাশে টিয়া-সবুজ কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজ, শুকনো লঙ্কামাখা ডিম-আলুসেদ্ধ পাবেই পাবে। বছরের প্রথম দিনটি এমনই সম্ভাবনাময়। গত বছর, তারও আগের আগের বছর যা করতে চেয়েছি, পারিনি, করিনি, স্রেফ আলস্যে এ ঘর-ও ঘর করেছি, এ বছরটা সেই আমি, বিলকুল বদলে নেব নিজেকে। হব না জেনেও হয়ে উঠব আস্ত এক সফল, আলো-ঝলমল, সদর্থক মনের মানুষ। যেমন এ বছরের শেষটা খানিক জমজমাট হয়ে গেল। একটি সত্যের জয় অনেকগুলি মিথ্যের মাঝে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা রূপে দেখা দেয়।‌ আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ অধিবাসীরা যে নিজেরাই পরদেশদখলকারী এবং দেশটা যে আফ্রিকা থেকে তুলে আনা দাস ও অভিবাসীদের দ্বারা নির্মিত, সেটা ভোলানোর চেষ্টায় খানিক জল ঢেলে দিলেন তরুণ জ়োহরান মামদানি। ইংরেজি ভাষার ভারতীয় লেখক অমিতাভ ঘোষ, কিরণ দেশাই, অরুন্ধতী রায়েরা তাঁদের নতুন বই নিয়ে আবার সাড়া ফেলে দিলেন‌।

মেয়েরা চিরকালই আট পেলে তা থেকে সংসারে আশি নম্বর জোগাড় করে। ফেলাছড়ার রান্না থেকে কত সামান্য আয়োজনে নড়বড়ে ঘরের সম্মান রক্ষা করে এসেছে, তার হিসাব নিশ্চয়ই সমাজবিজ্ঞানীরা রেখেছেন। ফুটপাতে ভিক্ষাজীবীর রান্নায় উঁকি দিয়ে দেখি, পরিশ্রমী মা ফেলে দেওয়া আনাজপাতি, মাছের কাঁটা ভরা গাদা, মুরগির হাড় কেমন অল্প তেলে, ফোড়নে, হলুদ, লাল রঙে সাঁতলে তুলছেন। পরিবারের একমাত্র রোজগেরে কর্তা মারা গেলেও অল্পশিক্ষিত, অপেশাদার মা সামান্য অথচ নিবিড় যত্নের আয়োজনে ঊনকোটি সামলে, এতটুকু অপচয় না করে প্রতিষ্ঠিত করেন ছেলেমেয়েদের। এ সব দেখেশুনে মনে হত, মেয়েদের আর প্রমাণ করার কিছু নেই।

কিন্তু এখন আবার মনে হয়, এই প্রবহমান হিংসাস্রোতের উল্টো দিকে প্রাণপণে সাঁতার কাটছে যারা, এখনও তাদের শায়েস্তা করার উপায় সেই এক ও অদ্বিতীয় শারীরিক আক্রমণ। পুরুষতান্ত্রিক মনের কাছে মাংসপিণ্ড মাত্র, যৌনপ্রাণই তার প্রধান পরিচয়। তার এই নারী-মনুষ্যত্বের অবমাননায় ক্রিকেট-খেলা মেয়েদের বিশ্বজয় যেন আত্মপ্রত্যয়কে আকাশস্পর্ধী করে তোলে। বাড়ি থেকে দু’পা এগিয়ে যে এটিএম কাউন্টার থেকে টাকা তুলি, তার ঠিক গায়েই রিচা ঘোষের বাড়ি। দেখি আর ভাবি, এই ছোট্ট একটি মেয়ে কেমন আমাদের মাটির দু’ইঞ্চি উপর দিয়ে হাঁটতে শিখিয়ে দিল।

মেয়েরা পারেন না কী? চুগ উপত্যকার মনপা উপজাতির মেয়েরা তিনশো বছরের এক পরিত্যক্ত বাড়িতে খুলে ফেললেন তাঁদের দেশীয় খাবারের এক রেস্তরাঁ। চুগ ভাষা থেকেই ওই উপত্যকার নাম। তিনটি গ্রামের ছ’শো মানুষ বেশ বিপদেই পড়েছিলেন। দীর্ঘপ্রচলিত যে দানাশস্য তাঁরা উৎপাদন করছিলেন, ধীরে ধীরে বাজারে তার বিক্রি কমছিল। হারিয়ে যাচ্ছিল নিজস্ব ব্যঞ্জনের কলাকৌশল, যা খানিক জটিলও বটে। আট মহিলার এই দল কীটনাশকহীন আনাজ বা শস্য উৎপাদনে প্রাচীন ঐতিহ্য বজায় রাখেন। রান্নাঘরে তা দিয়েই নিজস্ব রীতিপদ্ধতির মাধ্যমে তৈরি হল শৈলীময় মনপা খাদ্য। পরিবেশন করার মধ্যেও থাকল যৌথ রান্নাঘরের অতীত ভাবনা। বেড়াতে গেলে, এক সঙ্গে খেতে খেতে গল্পগাছায় পরিচিত হতে পারেন এক অজানা ভারতবর্ষের সঙ্গে। চুগ ভাষা থেকে এরা ‘চুগপা’ বা ‘দুহুমবি’। তাই এই আট মেয়ের দলের নাম ‘ডটার অব দুহুমবি’। এঁরা হারিয়ে যাওয়া সময়কে নতুন সাজে উপহার দিয়ে জীবনধারণের সহায় করেছেন বলে, এ বছরটা তাঁদের জন্যেও মনে থেকে যাক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন