পেটে যার টান পড়েছে, ঘরে যার চাল বাড়ন্ত, ‘অনশন’ শব্দটি শুনলে ভেতরে ভেতরে সে হাসবেই। হাসবে সে-ও, যে তার উলটো দিকে রয়েছে। কিন্তু সিঙ্গুর শেষমেশ উলটে দিল উলটো দিকের হাসি। সাতাত্তরটা দিন-রাত এক বেলা ভাত, আর এক বেলা জল-মুড়িতেই চালিয়ে নিল। হ্যাঁ, পপুলার লিডারদের মতো সাত-সতেরো দিনের শৌখিনতা নয়, পাক্কা সাত-এগারোং সাতাত্তর দিন— টানা এগারো উইকের স্ট্রং অবস্থান। বড় রাস্তার ধারে, ঠিক সেইখানে, যেখানে দাঁড়িয়ে, বসে ও আধশোয়া হয়ে, এক দিন সিঙ্গুর ইস্যুকে আগুনে-আন্দোলনের চেহারা দিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী— সেই ধরনাতলার নির্জনকেই ফের এপিসেন্টার করে কাঁপুনি ধরাল সিঙ্গুর। এ বার নেতৃত্বে— সিঙ্গুরের না-খেটে না-খেতে পাওয়া সাধারণ মানুষ।
যে জমি গিয়েছে, তা একফসলি না তিনফসলি, এই বিতর্কে বিধানসভা গরম হয়েছে, ইভিএম দপদপ করে উঠেছে, কিন্তু সিঙ্গুরের বীজধান তার ভিটে-মাটি পায়নি। কাজেই খেটে-খাওয়ার আর প্রশ্নই থাকছিল না সিঙ্গুরের একাংশের কাছে। ভুজুং-ভাজুং দিয়ে যাদের বেশ কিছু দিন ‘ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক’ এই নয়া শ্রেণিবিভাজনের চাপান-উতোরে বেঁধে রাখা গিয়েছিল, কোনও এক সুপ্রভাতে তাঁদের আর বুঝতে বাকি রইল না, আসলে তাঁদের ইচ্ছে-অনিচ্ছেয় কিচ্ছু যায়-আসে না। আসলে তাঁরা সবাই একই গোত্রের। সাফারার। ট্র্যাপ্ড। সৌভাগ্য, সেই ফাঁদ কেটে বেরোতে সিঙ্গুর আর দেরি করেনি।
মাঝে সাতাত্তরটা দিন, আর তার পর আজ সত্যিই একটা ভোর। একটা স্বপ্ন। একটা ভোরের স্বপ্ন, যা সত্যি হচ্ছে সিঙ্গুরে। আবার ফিরে আসছে টাটা গোষ্ঠী। গড়ে উঠবে কারখানা। চাড্ডি তেরপল খাটানো, ছেঁড়া কাপড় ঝোলানো এই অনাড়ম্বর মঞ্চ থেকেই সাইরাস মিস্ত্রিকে পাশে নিয়ে সে কথা ঘোষণা করলেন খোদ রতন টাটা। হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে এক দিন গিয়েছিলেন সানন্দ-এ। আজ সানন্দে ফিরে এসেছেন। তাঁর চোখে-মুখে উত্তেজনা চেপে রাখার পেশাদার ছায়া। খাসেরভেড়ি, বাজেমেলিয়া, গোপালনগরের বাতাসে আবার ভাসছে কর্মসংস্থানের ধোঁয়া-ওঠা গন্ধ।
কৃষি কাদের ভিত্তি, শিল্প কাদের ভবিষ্যৎ— একদা এ সব গুলিয়ে-টুলিয়ে দিয়েছিল সিপিএম। ‘গৌরব-সৌরভ’-এর অন্ত্যমিল দিয়ে তৃণমূল সরকারও যে জমি ফেরানোর উপাখ্যানকে টিপিকাল রূপকথার মলাটে বেঁধে ফেলেছে, তা বুঝতে সমস্যা হয়নি সিঙ্গুরের কৃষকদের। আগে যা ছিল, ছিল; কিন্তু আজ তাঁদের জমিতে আর যাই হোক, সোনার ফসল ফলানো সম্ভব নয়। অগত্যা তাঁদের আলপথ ছেড়ে রাজপথে নামা। রাজনীতির ফেস্টুন টেনে ফেলে নিজেদের দাবিতে অটল, বিক্ষোভে অবিচল, প্রতিবাদে অনড় থেকে সেই সাধারণ মানুষই শেষমেশ এই অসাধ্য সাধন করলেন। আন্দোলন লোকালে চড়তে হয়নি, লোকাল আন্দোলনেই তাঁরা বাজিমাত করেছেন।
সিঙ্গুরের এই নব-নবান্নের দিনে মিনি-নবান্ন সঙ্গে নিয়ে হাজির ছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও। তাঁর বক্তৃতায় সিঙ্গুরের আমজনতাকে তিনি সাধুবাদ জানান। শিল্পমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন, জমি অধিগ্রহণ, ল্যাংন্ডব্যাংক ইত্যাদির পাটিগণিত আরও সরল করে কষতে, সিঙ্গুরকে নিদর্শন হিসাবে মাথায় রাখার জন্য।
মঞ্চ থেকে নেমে এসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন মুখ্যমন্ত্রী। এক বৈদ্যুতিন মাধ্যমের বেয়াড়া সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল: এই তো সে দিন বললেন, সিঙ্গুরে কারখানা হলে, তা হবে একটা বৃহৎ আন্দোলনের প্রতি অবমাননা। তা হলে আজকে...? মুখ্যমন্ত্রী মুচকি হেসে বলেন, সেটা ছিল ১৬ তারিখ। ষোলোয় যা সত্য, তা ছাব্বিশে সত্য না-ও হতে পারে। পরিবর্তন-ই তো শেষ কথা! সেই ২০০৬ থেকে ২০১৬— এটা একটা বিশাল আন্দোলনের বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়া। আমিই তা শুরু করেছিলাম, আমিই তা শেষ করলাম।
আলিমুদ্দিন অবশ্য ব্যঙ্গ ছুড়ে বলেছে, পরিবর্তনের শেষ ঘনিয়ে এসেছে, তাই কথা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিপিএম নেতা জানালেন, সিঙ্গুরের খবরে বুদ্ধবাবু নাকি ছবি বিশ্বাসের মতো বিড়বিড় করে উঠেছেন, ‘পারবে, ফিরিয়ে দিতে পারবে আমার দশটা বছর?’
susnatoc@gmail.com