আজ থেকে একশো বছর আগের কথা। ১৩২৫ এর ৮ পৌষ। ভোরবেলার শান্তিনিকেতন আশ্রম।
কিছু ক্ষণ আগেও মাঠের ওপরে বিছিয়ে ছিল হালকা ছাই-সাদা কুয়াশার আস্তরণ। টুপটুপ করে হিম ঝরছিল শাল, ছাতিম আর আম, জাম কাঁঠালের পাতা থেকে। আশ্রমের ভেতরে লাল মাটির পথের ধারে ইতস্তত ছড়িয়ে খড়ের ছাউনিওয়ালা কুটির। পৌষের ভোরে রবিঠাকুরের আশ্রমটি যেন তাঁর ভাইপো অবন ঠাকুরের জলরঙের ছবি, ওয়াশ পদ্ধতিতে আঁকা।
যতই জাঁকিয়ে শীত পড়ুক বীরভূমে, ৭ পৌষের ভোরে কাঁথাকম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুম দেওয়ার জো নেই আশ্রমের আবাসিকদের। কারণ আশ্রম- ইতিহাসে ওই দিনটির মাহাত্ম্য। ৭ পৌষ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হওয়ার দিনটি স্মরণে রেখেই রবীন্দ্রনাথ ৭ পৌষ ১৩০৮ ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেন। কয়েক বছর যাবৎ ৮ পৌষ তারিখে তাই আশ্রম-ইস্কুলের বার্ষিক সভা বসে।
১৩২৫ সালে পৌষ মাসের অষ্টম প্রভাতে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের বয়স তখন মাত্র সতেরো। সেই জন্মদিন উপলক্ষেই যেন আশ্রমে প্রকৃতির প্রসন্ন আশীর্বাণী বর্ষিত হচ্ছে— শাল আর ছাতিমপাতার ফাঁক দিয়ে এসে পড়া রোদ্দুরে হীরের কুচির মতো ঝকঝক করছে শিশিরকণা, সেই কিরণ এসে পড়ছে আশ্রমের মূল প্রবেশপথের পাশে উপাসনা মন্দিরের চূড়ায়। এই বিশেষ দিনের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ। তাঁর বয়স তখন সাতান্ন অতিক্রান্ত। সেই সময়ের নিরিখে, বাঙালী তো বটেই, গড়পড়তা ভারতীয় পুরুষ বার্ধক্যের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। অথচ রবিঠাকুরের শরীরে যৌবনের দীপ্তি তখনও ম্লান হয়নি। ঘন চুলে, দাড়িতে কিঞ্চিৎ পাক ধরেছে বটে, কিন্তু তার ফলেই তাঁকে মনে হয় ঋষিতুল্য। প্রাচীন ভারতের তপোবনের গুরু-শিষ্যের নিকট সম্বন্ধ এবং প্রকৃতির সান্নিধ্যে আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এমন মানুষই ঔপনিবেশিক শিক্ষার বিপরীতে এক ব্যতিক্রমী পাঠশালার কথা ভাবতে পারেন।
কিন্তু সে তাঁর মধ্যযৌবনের ভাবনা, যে সময়ে স্বদেশি সমাজের চিন্তায় মগ্ন ছিলেন তিনি। তার পর, দেশকে, বিশ্বকে কত ভিন্ন মাত্রায়, কত রূপে দেখেছেন তিনি! তার প্রতিফলন কী থাকবে না তাঁর শিক্ষাচিন্তায়, সমাজ ভাবনায়?
রবীন্দ্রনাথের জীবনীকার প্রশান্ত পাল জানাচ্ছেন, ‘শিশু বিভাগের ঘরগুলির পিছনে মাঠে বিশ্বভারতীর ভিত্তি স্থাপিত হইল। অনেক বৈদিক আচারাদি অনুষ্ঠিত হইল। ভিত্তির জন্য যে গর্তটি কাটা হইয়াছিল, মন্ত্রপাঠাদির পর কবি তাহার ভিতর আতপ তণ্ডুল, জল, কুশ ফুল প্রভৃতি করিলেন। বিভিন্ন দেশের পুরুষ ও মহিলা যাঁহারা উপস্থিত ছিলেন, সকলেই বিশ্বমানবের প্রতিনিধি স্বরূপ গর্তে মৃত্তিকা দিলেন।’ বিশ্বভারতীর ভিত্তি কথাটি ব্যবহার করা উচিত কি না তা নিয়ে গোল উঠেছে বিদ্বজ্জন মহলে। কারণ সাধারণ ভাবে বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা বলে মানা হয় এর ঠিক তিন বছর পরের, অর্থাৎ ১৩২৮ এর ৮ পৌষের (২৩ ডিসেম্বর ১৯২১) সভাটিকে। হয়তো বা তার মহাসমারোহের জন্যই। সে দিন উপস্থিত ছিলেন বিখ্যাত পণ্ডিত ও প্রাচ্যবিদ সিলভাঁ লেভি যিনি রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে প্যারিস থেকে এসেছিলেন বিশ্বভারতীর প্রথম বিদেশি অধ্যাপকের পদ অলঙ্কৃত করতে। ছিলেন দার্শনিক ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, যাঁকে সভাপতিত্বে বরণ করেন রবীন্দ্রনাথ। এ ছাড়াও ছিলেন কলকাতা থেকে আমন্ত্রিত বিশিষ্ট অতিথিরা। সেই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের ভাষণটি— লেখার আকারে যা ‘বিশ্বভারতী’ গ্রন্থের তৃতীয় প্রবন্ধ— লক্ষ করার মতো। প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “আজ বিশ্বভারতী-পরিষদের প্রথম অধিবেশন। কিছুদিন থেকে বিশ্বভারতীর এই বিদ্যালয়ের কাজ আরম্ভ হয়েছে। আজ সর্বসাধারণের হাতে তাকে সমর্পণ করে দেব।”
মানে, বিশ্বভারতী যে জন্মগ্রহণ করেছে তা নিয়ে প্রতিষ্ঠাতার কোনও দ্বিধা নেই। তিনি বলছেন, ‘‘এই বিশ্বভারতীকে আমরা কিছুদিন লালনপালন করলুম, একে বিশ্বের হাতে সমর্পণ করবার সময় এসেছে।”
কী অর্থে লালনপালন? তার ব্যাখ্যা রয়েছে দ্বিতীয় প্রবন্ধটিতে। সেটি ১৮ আষাঢ় ১৩২৬ তারিখের। সেখানে তিনি পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন, অ্যান্ড্রুজ-এর সঙ্গে নাম করছেন সঙ্গীতশিল্পী ভীমরাও শাস্ত্রী, নকুলেশ্বর গোস্বামী এবং নন্দলাল বসু, সুরেন্দ্রনাথ করের। ১৯১৯ সালে হয়তো বা সুনির্দিষ্ট নিয়মে না হলেও শুরু হয়ে গেছে বিশ্বভারতীর কাজ। এই প্রবন্ধে তিনি বিশ্বভারতীকে একটি শিশুর সঙ্গে তুলনা করছেন: “বিশ্বভারতী একটি মস্ত ভাব, কিন্তু সে অতি ছোটো দেহ নিয়ে আমাদের আশ্রমে উপস্থিত হয়েছে। ”
কী সেই মস্ত ভাব? তা জানার জন্য ফিরে যেতে হবে ১৩২৫ এর ৮ পৌষে। সে দিন উপস্থিত, কবি-পুত্র রথীন্দ্রনাথের ডায়েরি থেকে জানা যায় যে সেই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ একটি ছোট বক্তৃতা দেন আদর্শ বিদ্যাকেন্দ্র বিষয়ে। সেটি পুস্তিকাকারে ছাপানোও হয়েছিল অতিথি-অভ্যাগতদের কাছ থেকে অনুদান স্বরূপ অর্থ সংগ্রহের জন্য। ‘শান্তিনিকেতন’ পত্রিকার বৈশাখ ১৩২৬ সংখ্যায় ‘বিশ্বভারতী’ প্রবন্ধটি সেই পুস্তিকার ধরনে লেখা বলে বিশ্বাস রবি-জীবনীকারের। ‘বিশ্বভারতী’ সঙ্কলনের এটি প্রথম প্রবন্ধ। তিনটি বক্তব্য বা যুক্তি সাজিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর আদর্শ বিদ্যালয়ের রূপকল্পে। প্রথমত, ভারতবর্ষের প্রাচীন কালে মনের একটি ঐক্য ছিল, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে যে সম্পর্ক তারই মতো; বর্তমানে ঔপনিবেশিকতার আঘাতে তা ছিন্নবিচ্ছিন্ন; ভারতের পুনরুজ্জীবন তখনই সম্ভব যখন হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, মুসলমান, খ্রিস্টান প্রভৃতি চিন্তা ও দর্শন বিষয়ে গবেষণা হতে পারবে। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ বিদ্যার উদ্ভাবন ও উৎপাদন, অর্থাৎ মৌলিক গবেষণা। বিদ্যার বিতরণ অর্থাৎ শিক্ষাদান তার গৌণ কাজ— তা স্বাভাবিক ভাবেই সম্পন্ন হবে বিদ্যার উৎসের কাছে থাকলে। তৃতীয়ত, বিদ্যালয় তার অর্থশাস্ত্র, কৃষিতত্ত্ব, স্বাস্থ্যবিদ্যা, সমস্ত ব্যবহারিক বিজ্ঞানকে আশেপাশের ‘পল্লীর মধ্যে প্রয়োগ’ করবে। সাদা কথায় বিশ্ববিদ্যালয় আর তার পারিপার্শ্বিকের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ যোগ থাকবে যার ফলে অধিবাসীদের জীবিকার সংস্থান হবে, জীবনযাত্রার মান বাড়বে। প্রবন্ধের শেষ বাক্যে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “এই রূপ আদর্শ বিদ্যালয়কে আমি ‘বিশ্বভারতী’ নাম দিবার প্রস্তাব করিয়াছি।”
সামগ্রিক বিচারে ‘বিশ্বভারতী’ শব্দটির ব্যবহার উচ্চতর বিদ্যা ও জ্ঞান চর্চা ও তার প্রয়োগ বিষয়ক রবীন্দ্র-ভাবনার প্রথম প্রকাশ, এবং আশ্রমের এলাকায় রিচুয়ালের মাধ্যমে তার একটি প্রতীকী রূপ দেওয়ারও প্রথম প্রয়াস। বিদ্বজ্জনেরা বলেন, এটি শুধু কবির সঙ্কল্প মাত্র। তখনও পর্যন্ত এর কোনও বাস্তবায়ন হয়নি। অর্থাৎ তার প্রাতিষ্ঠানিক কোনও ভিত্তি নেই। কিন্তু বিশ্বভারতী তো শুধু মাত্র শিক্ষাবিদ কোনও চিন্তক বা আমলার প্রচেষ্টা নয়, তার প্রতিষ্ঠাতা কবি যে সত্যদ্রষ্টা, বিশ্বমনা!
এই মননের মধ্যে রয়েছে বৃহত্তর অর্থে এক রাজনৈতিক বোধ, যা তাঁর দর্শনের থেকে ভিন্ন নয়। দার্শনিকের দৃষ্টিতে জগৎকে শুধু জানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে তিনি নারাজ। তিনি মানবসমাজের কল্যাণের জন্য পরিবর্তনে আস্থাশীল। সেই জন্য আজ থেকে একশো বছর আগে ‘বিশ্বভারতী’র আইডিয়াই এক নতুন জগতের ভিত্তি।