ফিরে এলেন বিবিদিষানন্দ

সাত বছর আগে কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে প়়ড়েছিলেন তিনি। ফিরলেন আজকের তারিখেই। ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৭। এত দিনে তাঁর চেনা নামটাও বদলে গিয়েছে। এখন তিনি স্বামী বিবেকানন্দ। শুভাশিস ঘটকস কাল সাড়ে ৭টায় লোকাল ট্রেন শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছল। স্টেশন তখন প্রায় ২০ হাজার লোকের ভিড়ে ঠাসা। ভিড় জানে, ওই ট্রেনেই সঙ্গীদের নিয়ে স্পেশাল কম্পার্টমেন্টে রয়েছেন তিনি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share:

স কাল সাড়ে ৭টায় লোকাল ট্রেন শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছল। স্টেশন তখন প্রায় ২০ হাজার লোকের ভিড়ে ঠাসা। ভিড় জানে, ওই ট্রেনেই সঙ্গীদের নিয়ে স্পেশাল কম্পার্টমেন্টে রয়েছেন তিনি।

Advertisement

তিনি, গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী বিবিদিষানন্দ। এই শহর তাঁকে শেষ দেখেছে সাত বছর আগে, ১৮৯০ সালে। তখন তিনি ও তাঁর সতীর্থ কয়েক জন তরুণ বরাহনগরের এক পোড়ো বাড়িতে থাকেন, সেই বাড়ির এক ঘরে প্রয়াত গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের ছবির সামনে পুজোপাঠ ও শাস্ত্র আলোচনা করেন, মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে শোন। গুরুর মৃত্যুর পর বিরজা হোম করে সন্ন্যাস নিয়েছেন তাঁরা, মাঝে মাঝেই বারাণসী, গাজীপুর, হিমালয়ে একাকী তীর্থদর্শনে বেরিয়ে যান। এক সতীর্থ অখণ্ডানন্দ তো তিব্বতেও চলে গিয়েছিলেন।

বিবিদিষানন্দ অবশ্য তিব্বত যাননি। হরিদ্বার, হৃষীকেশ, আলমোড়া হয়ে সটান চলে গিয়েছিলেন রাজস্থান। সেখানে খেতড়ির রাজা তাঁকে বিবেকানন্দ উপাধি দেন, শিকাগো ধর্মমহাসভায় যাওয়ার জন্য ‘ওরিয়েন্ট’ জাহাজে ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কেটে দেন। আমেরিকা, লন্ডন ঘুরে বিশ্বজয়ী সেই সন্ন্যাসী এই ট্রেনে চেপেই পা রাখবেন তাঁর চেনা শহরের চেনা স্টেশনে। সাত বছর আগে অচেনা তরুণ বিবিদিষানন্দের প্রস্থান কলকাতার মনে দাগ কাটেনি। সেই শহর আজ নতুন বেশে বিবেকানন্দকে দেখতে উদ্বেল।

Advertisement

দিনটা শুক্রবার। ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৭। ঠিক ১২০ বছর আগের ঘটনা। কয়লার ধোঁয়া উড়িয়ে ট্রেনটা আসছে বজবজ থেকে। চটকলের শিল্পশহর, তেলবাহী জাহাজের বন্দর বজবজে ট্রেন যোগাযোগও তৈরি হয়েছে ঠিক সাত বছর আগে। বিবিদিষানন্দ যখন কলকাতা ছাড়ছেন, সেই ১৮৯০ সালে।

সাত বছরে পরিবর্তন অনেক। তৎকালীন মাদ্রাজ, অধুনা চেন্নাই থেকে ‘এস এস মোম্বাসা’ জাহাজে এ বার বিদেশি শিষ্যদের নিয়ে ফিরছেন বিবেকানন্দ। সঙ্গে তাঁর বক্তৃতার অনুলেখক গুডউইন, ক্যাপ্টেন সেভিয়ার ও তাঁর স্ত্রী, আরও অনেকে। বিলেত থেকে ফেরার পথে প্রথমে কলম্বো, সেখান থেকে কান্ডি, জাফনায় এসেছিলেন তাঁরা। তার পর রামনাদের ভারত ভূখণ্ডে। সেখান থেকে মাদুরাই, তিরুচিরাপল্লি হয়ে ট্রেনে মাদ্রাজ।

জায়গায় জায়গায় তাঁকে দেখতে ভিড়, তিরুচিরাপল্লিতে রাত চারটেতে তাঁর ট্রেন থামার কথা। তখনও ফুল, মালা নিয়ে স্টেশনে কয়েক হাজার মানুষ। মাদ্রাজের আগে এক ছোট্ট স্টেশন, সেখানে ট্রেন থামার কথা নয়। কিন্তু বিবেকানন্দ আসছেন জেনে লাইনের ওপর শুয়ে পড়েছে কয়েকশো মানুষ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্লান্ত শরীরে জায়গায় জায়গায় বক্তৃতা দিতে হয়েছে। বিশ্রাম নিতে নিতে চেনা শহরে ফিরবেন বলে ট্রেনে আর উঠলেন না। ১৫ ফেব্রুয়ারি সওয়ার হলেন কলকাতাগামী মোম্বাসা জাহাজে।

ফেরার পথে হুগলি নদীর চড়ায় অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হল। ১৮ তারিখ সন্ধ্যায় বজবজে নোঙর ফেলল জাহাজ, কিন্তু তখনকার আইনে সূর্যাস্তের পর জাহাজ থেকে নামা নিষেধ। বিবেকানন্দ ও তাঁর সঙ্গীরা তাই নামলেন ১৯ তারিখ সকালে, সেখান থেকে বজবজ স্টেশন। মাদ্রাজে তাঁকে দেখতে ভিড় করেছেল হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু বজবজ স্টেশন আজ নির্জন, নীরব।

আসলে, অভ্যর্থনা কমিটি তখন শিয়ালদহে। রাজধানী কলকাতার বাইরে বজবজের কথা কেউ ভাবেনি। বাঙালির পরিকল্পনায় এ ভাবেই সে দিন ফাঁক থেকে গিয়েছিল।

ভোরবেলা স্টেশনে পৌঁছেও অপেক্ষা করতে হল বেশ কিছু ক্ষণ। নেটিভ সন্ন্যাসীর জন্য নেই কোনও স্পেশাল ট্রেন। স্টেশন মাস্টার অবশ্য তাঁর ঘরের একটি চেয়ারে সন্ন্যাসীকে বসতে দিলেন, সেই চেয়ার এখন ফেয়ারলি প্লেসের রেল মিউজিয়ামে।

ভোরের লোকাল ট্রেন সাড়ে সাতটায় শিয়ালদহে থেমেছে, স্টেশন তত ক্ষণে মুখরিত ‘জয় পরমহংস রামকৃষ্ণ কি জয়,’ ‘জয় স্বামী বিবেকানন্দ কি জয়’ আওয়াজে। কসমোপলিটান রাজধানী সে দিন হিন্দি ভাষাতেই জয়ধ্বনি তুলেছিল। ভিড় ঠেলে অভ্যর্থনা কমিটির সেক্রেটারি, ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকার সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেন কোনও ক্রমে এগিয়ে গেলেন, বিবেকানন্দকে বসিয়ে দিলেন স্টেশনের বাইরে অপেক্ষারত ল্যান্ডো গাড়িতে।

বিবেকানন্দ সেভিয়ার দম্পতিকে নিয়ে সেই গাড়িতে বসতেই এক দল ছাত্র এগিয়ে এসে ঘোড়া দুটোকে লাগাম থেকে খুলে নিজেরাই গাড়ি টানতে শুরু করল। সামনে ব্যান্ড পার্টি, মাঝে গাড়ি আর পিছনে খোল-করতাল সহ কীর্তনের দল। সেলেব্রিটি বরণের এই রকম ইভেন্ট আগে কখনও দেখেনি কলকাতা।

রাস্তার দু’ধারে ফুল নিয়ে কাতারে কাতারে মানুষ। সার্কুলার রোডে ‘জয় স্বামীজি’ লেখা তোরণ, ওপরে নহবতখানা। হ্যারিসন রোডের মোড়ে আর একটা, রিপন (সুরেন্দ্রনাথ) কলেজের গেটে লেখা ‘স্বাগত’।

কলকাতা এ দিন একটা ব্যবস্থা করেছিল। রাস্তায় কোনও সভা নয়, শুধু শোভাযাত্রা। ঠিক হয়েছিল, তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে সভা হবে ৯ দিন পরে, ২৮ ফেব্রুয়ারি। শোভাবাজার রাজবাড়িতে। বিস্ত়ৃত প্রাঙ্গণ, অনেকেই সন্ন্যাসীর বক্তৃতা শুনতে পারবে।

বিবেকানন্দের গাড়ি দুপুরবেলায় পৌঁছল বাগবাজারে পশুপতিনাথ বসুর বাড়িতে। এ দিন এখানেই তাঁদের দুপুরের খাওয়ার বন্দোবস্ত। অতঃপর বরাহনগরে গোপাললাল শীলের বাগানবাড়ি। বিদেশি শিষ্যদের সেখানে রেখে তিনি চললেন আলমবাজার।

সাত বছর আগে, যে দিন বিবিদিষানন্দ বেরিয়েছিলেন, মঠ ছিল বরাহনগরের এক পোড়ো বাড়িতে। পরে ১৮৯২ সালে তরুণ সন্ন্যাসীরা চলে আসেন আলমবাজারের এই বাড়িতে। বিবেকানন্দ তখন খেতড়িতে। খবরটা পান চিঠিতে। এই ১৯ ফেব্রুয়ারি আলমবাজার মঠে তাঁর প্রথম পদার্পণ।

প্রবেশদ্বারে কলাগাছ, আম্রপল্লবসহ জলভরা কলসি সাজিয়ে রেখেছেন সতীর্থ অখণ্ডানন্দ ও রামকৃষ্ণানন্দ। অন্যরা কলকাতা গেলেও এই দুই গুরুভাই সারা দিন থেকে গিয়েছেন মঠে, তৈরি হয়েছে ছোটখাটো এক তোরণও।

কলকাতায় ফিরে বিবেকানন্দ দিনের বেলায় বিদেশি শিষ্যদের কাছে, গোপাল লাল শীলের বাগানবাড়িতে থাকেন। রাতে আলমবাজার। কখনও শাস্ত্রচর্চা, কখনও বা জানলায় হ্যামক টাঙিয়ে বই পড়েন। মাঝে মাঝে গুনগুন করেন গীতগোবিন্দের গান।

ফেরার তিন-চার দিন পর বাগবাজারে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রণ। সেখানেই চাঁদা নিতে হাজির গোরক্ষিণী সভার এক প্রচারক। ঘটনাটা আজও বিখ্যাত। বিবেকানন্দ জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মধ্যভারতে দুর্ভিক্ষে প্রায় আট লাখ লোক মারা গিয়েছে। আপনারা তাঁদের জন্য কিছু করছেন না?’ ভদ্রলোকের উত্তর, ‘না, ওটা ওঁদের কর্মফল।’ বিবেকানন্দের সটান জবাব, ‘তা হলে গরুরাও নিজেদের কর্মফলে কসাইখানায় যাচ্ছে। আমাদের কিছু করার নেই।’ নাছোড়বান্দা ভদ্রলোক বললেন, ‘কিন্তু শাস্ত্র বলে, গরু আমাদের মা।’ বিবেকানন্দের উত্তর, ‘দেখেই বুঝেছি। তা না হলে এমন কৃতী সন্তান আর কে প্রসব করবেন?’

২৮ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৪টায় শোভাবাজার রাজবাড়ির সভা। দালান উপচে পড়ছে মানুষের ভিড়ে। সেখানেই বললেন, ‘আজ সন্ন্যাসী ভাবে আসিনি, ধর্মপ্রচারক হিসেবেও নয়। এসেছি সেই কলকাতাবাসী বালক রূপে।…’

একটার পর একটা বক্তৃতা। শোভাবাজার, স্টার থিয়েটার। ৭ মার্চ শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথি, এত বছর বাদে এলেন দক্ষিণেশ্বর। তবু তাঁকে দেখতে ভিড়ে ভিড়াক্কার। শরীর দিচ্ছে না, কিন্তু মাথায় অনেক পরিকল্পনা। তৈরি করতে হবে শ্রীরামকৃষ্ণের নামে মঠ ও মিশন। জন্মতিথির পর দিনই শরীর সারাতে দার্জিলিঙের উদ্দেশে রওনা হলেন তিনি। সাত বছর পর কলকাতায় এসে বিবেকানন্দ থাকলেন মাত্র ১৬ দিন। ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ।

শরীরের কথা কবে আর খেয়াল রাখলেন তিনি? শোভাবাজারে সভার তিন দিন আগেও মার্কিন শিষ্যা ওলি বুলকে লিখছেন, ‘এত ক্লান্ত, জানি না আর ছ’মাসও নিজেকে টানতে পারব কি না। তবে, কলকাতা আর মাদ্রাজে দুটো সেবাকেন্দ্র তৈরি করতে হবে। মাদ্রাজের লোকেরা বেশ আন্তরিক। কলকাতার বড়লোকেরা স্রেফ দেশপ্রেমের কারণে এ বিষয়ে উৎসাহী, উৎসাহ কাজে পরিণত হবে বলে মনে হয় না।’ বিবেকানন্দ জানতেন, শুধু দেশপ্রেমের বুকনিতে চিঁড়ে ভেজে না।

এই কথাগুলি মনে রাখাতেই ১২০ বছর আগের সেই দিনটার সার্থকতা। আজও বজবজের ‘গুডস ক্যারেজ ইউনিট’-এ পুরনো রেল স্টেশনের অতিথিশালা সাজানো হবে ফুল আর মালায়, বজবজ-শিয়ালদহ লোকালের একটা কামরা ফুল দিয়ে সাজিয়ে সেখানে রাখা হবে ফাইবার গ্লাসে তৈরি বিবেকানন্দের মূর্তি। সেই ট্রেন শিয়ালদহে পৌঁছবে, তার পর আলমবাজার মঠ অবধি পদযাত্রা। দিগ্বিজয়ীর প্রত্যাবর্তন শহর আর কী ভাবেই বা মনে রাখত?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন