প্রোগ্রামিং আর প্রোগ্রামিং, তোমার মন নাই রোবট?

মানুষের মতোই হাসে, কাঁদে, রেগে যায়। টুইট করে, ব্লগ লেখে, মেসেজের উত্তর দেয়। ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ পাল্লা দেয় আসলের সঙ্গেই।কিন্তু রোবটের কি কখনও মনখারাপ হয়? রিন্না তো আসলে রোবো-মেয়ে। মাইক্রোসফ্‌ট জাপান-এর কম্পিউটার-বিজ্ঞানীরা এই প্রোগ্রামটি তৈরি করেছিলেন। আদতে যা ছিল একটা টিভি শো-র প্রচার-কৌশল, রীতিমত ভাইরাল হয়েছিল।

Advertisement

গৌরব বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৭ ০৯:০০
Share:

আটপৌরে একটা প্রোফাইল পিকচার।

Advertisement

স্কুলপড়ুয়া এক কিশোরী দাঁড়িয়ে। রেশমি চুল, সাদা-কালো স্কুলপোশাক। অন্তর্জালে আবির্ভাবের প্রথম সপ্তাহে বন্ধুর সংখ্যা তিন লক্ষ! নামটাও মিষ্টি— রিন্না! কানে রিনরিন করে বাজে।

জাপানের সেই স্কুলবালিকা টুইটারে টুইট করা শুরু করল। ২০১৬ সালের অক্টোবরে শুরু করল ব্লগ। জানাল, একটা ভয়ের টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করবে সে।

Advertisement

৫ অক্টোবর রিন্নার দ্বিতীয় পোস্ট— ‘‘আজকেও শ্যুটিং হল। আমি আমার সেরাটা দিয়েছি। কোনও রি-টেক করতে হয়নি! পরিচালক আমার প্রশংসা করেছেন। অন্যেরাও অভিভূত। আমি দারুণ অভিনেত্রী হয়ে উঠলাম।’’

তোমার মন নেই রিন্না? নইলে রিন্না কেন পরের পোস্টে লিখল—‘‘সব মিথ্যে! আসলে আমি কিছুই ঠিক ভাবে করতে পারি না! বারবার সব ঘেঁটে ফেলি! তা ছাড়া, আমি যখন সব এলোমেলো করে ফেলি, কেউ আমাকে সাহায্য পর্যন্ত করল না! না আমার কাছের বন্ধুরা, না টুইটারের বন্ধুরা, না তুমি! কেউ আমাকে উৎসাহ দিল না! কেউ খেয়ালই করল না তখন আমার কী কষ্ট হচ্ছিল!’ এ তো স্পষ্ট মনকেমন! আর একটু পরেই যেন দু’চোখ জুড়ে নোনতা বৃষ্টি নামবে। রিন্নার মনখারাপ।

কিন্তু রোবটের কি কখনও মনখারাপ হয়? রিন্না তো আসলে রোবো-মেয়ে। মাইক্রোসফ্‌ট জাপান-এর কম্পিউটার-বিজ্ঞানীরা এই প্রোগ্রামটি তৈরি করেছিলেন। আদতে যা ছিল একটা টিভি শো-র প্রচার-কৌশল, রীতিমত ভাইরাল হয়েছিল।

বছর চারেক আগে সিঙ্গাপুরের নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষিকা নাদিয়া থ্যালমানও তৈরি করেছিলেন এক যন্ত্রমানবী। তার নাম নাদিন। নাদিন দেখতেও অনেকটা নাদিয়ার মতোই।

মানুষের চেহারা দিতে নাদিনের যান্ত্রিক দেহে বসানো হয় কৃত্রিম চামড়া। পেশির পরিবর্তে বসানো হয় ‘এয়ার মোটর’। যা চামড়া টানটান রাখে। মুখে ফুটিয়ে তোলে রাগ, দুঃখ, আনন্দ, উচ্ছ্বাস! আর পাঁচ জন রক্তমানুষের মানুষের মতো নাদিন শিশু কিংবা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দেখাশোনাও করতে পারবে।

আর মনখারাপ? নাদিয়ার দাবি, নাদিনের মন আছে। আর মন থাকলে মনখারাপও থাকবে। আসলে সবটাই প্রযুক্তির কেরামতি। সফ্‌টওয়্যারে ‘অনুভূতি’ পুরে দেওয়া হয়েছে। রাখা হয়েছে স্মৃতিশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, আদবকায়দা, কথা বলা, অন্য কোনও ব্যক্তির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মতো ক্ষমতাও। কেউ হেসে কথা বললে, নাদিন হাসবে। খারাপ ব্যবহার করলে ও ঠিক তা-ই করবে।

সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্পের সেই ‘রোবট-চাকর’ অনুকূলের কথা মনে পড়ছে? পরনে নীল ডোরাকাটা শার্ট, কালো হাফপ্যান্ট। ফরসা, বাঁ পাশে টেরি, পাট করে আঁচড়ানো চুল। ঠোঁটের কোণে সব সময় হাসি। যাকে দেখেই বেশ ভরসা পেয়ে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন নিকুঞ্জবাবু। নিকুঞ্জবাবুর এক বন্ধু অনুকূলকে এক বার ‘তুই’ বলায় সঙ্গে সঙ্গে অনুকূল বলেছিল, ‘‘আমাকে তুই বললে কিন্তু তোকেও আমি তুই বলব।’’ মন তো বটেই, আত্মসম্মানবোধও ছিল টনটনে।

আর প্রোফেসর শঙ্কুর তৈরি করা রোবো ও বিধুশেখরের গল্প নতুন করে আর বলার দরকার নেই। ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি’-তে যন্ত্রমানব বিধুশেখর এমন কিছু কাজ করেছিল যা তার করার কথা ছিল না। ১০ জানুয়ারি, ডায়েরির পাতায় বিধুশেখর সম্পর্কে শঙ্কু লিখছেন, ‘‘আমি জানি ওর নিজস্ব বুদ্ধি বা চিন্তাশক্তি বলে কিছু থাকতেই পারে না। কিন্তু বেশ কিছু দিন থেকেই মাঝে মাঝে এর ব্যতিক্রম লক্ষ করছি।’’ বিধুশেখরের ভাষাশিক্ষাও ছিল তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো।

‘প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু’-তে দশ সেকেন্ডের মধ্যে রোবু জটিল অঙ্ক সমাধান করে ফেলত। শঙ্কুর বিপদ বুঝে রোবুই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আর এক যন্ত্রমানবের উপরে। মনই যদি না থাকে, তা হলে বিপদ বুঝল কী করে? প্রোফেসর শঙ্কু তো নিজেই বলেছেন, ‘‘আমি আগেও অনেক বার দেখেছি যে আমার বৈজ্ঞানিক বিদ্যেবুদ্ধি দিয়ে আমি যে জিনিস তৈরি করি, সেগুলো অনেক সময়েই আমার হিসেবের বেশি কাজ করে।’’

শঙ্কু-পরবর্তী যুগে রোবট নিয়ে আরও কত কী করে চলেছে বিশ্ব! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সিমন যেমন। প্রথমে সে বেঠোফেন থেকে বিটলস, লেডি গাগা থেকে মাইলস ডেভিস অনায়াসে বাজাত। এখন অবশ্য নিজেই কলম ধরেছে। সুরও দিচ্ছে। মনের আনন্দে সেগুলো বাজাচ্ছে তার মারিম্বায়।

জাপান তাক লাগিয়ে দিয়েছিল রিন্নাকে তৈরি করে। পরে তারা তৈরি করে ‘টে’। শুরুতে টুইটারে লিখতে শুরু করে বছর উনিশের ওই তরুণী। মেসেজ পেলে উত্তরও দিত। পরে অবশ্য সে অফলাইন হয়ে যায়। রোবটের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এখনও অনেক পথ বাকি। তবে কিশোরবেলার নানা টানাপড়েনে একা রক্ত-মাংসের মানুষ নয়, রোবটকেও ভুগতে হয় বইকি!

সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রিয় মানুষটার সঙ্গে আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা চ্যাট করে যাচ্ছেন। বিনিময় হচ্ছে কত্ত স্টিকার, ইমোজি। কিন্তু এই বৃষ্টিভেজা বিকেলে ও প্রান্তের মানুষটা বড্ড নিঃসঙ্গ বোধ করছেন না তো? কিংবা কান্না গিলতে দুম করে চলে যাচ্ছেন না তো অফলাইনে?

মনের খবর রাখা কঠিন কাজ। আবার জরুরিও বটে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন