Sourced by the ABP
সালটা ১৭৬৯। আদি কলকাতার বাজারের মধ্যে নথিভুক্ত হয়েছে লালবাজারের নাম। পলাশির যুদ্ধের পর কেটে গেছে এক যুগ। ডিহি কলকাতায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ব্রিটিশ সৈনিক। তৈরি হয়েছে সেনা ছাউনি। এমন সময় এক শীতের সকালে হইহই পড়ে গেল। কলকাতা থেকে সামান্য দূরেই। বজবজের কাছে আকরায় নাকি ঘোড়দৌড়ের আয়োজন। শীতের দুপুর। কয়েকটি ঘোড়া পাশাপাশি দৌড়বে। সন-তারিখ কলকাতার ইতিহাসে লেখা নেই। তখন না ছিল বাজি, না ছিল বেটিং। এই দৌড় তখন শুধু খেলা। প্রতিযোগিতার আনন্দ। কে জানত, এ ভাবেই দৌড়তে দৌড়তে এক দিন ঘোড়াগুলো পৌঁছে যাবে রেসের মাঠে!
এ কাহিনির মতোই আরও একটি কাহিনি প্রচলিত আছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জমিয়ে বসেছে কলকাতায়। শোনা যায়, নবাব সিরাজউদ্দৌলা সে সময় কলকাতা যাওয়ার পথে মাঝখানে এক জায়গায় তাঁবু ফেলে সৈন্যবাহিনী নিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেন। সেই ফাঁকা জায়গাটিতেই ওয়ারেন হেস্টিংস তৈরি করেছিলেন ‘হেস্টিংস হাউস’। কাছেই বিশাল ফাঁকা মাঠ। ইংরেজের আমোদপ্রমোদের জন্য সে মাঠেই নাকি চালু হয় ঘোড়দৌড়। ব্রিটিশ আমলের সেই মাঠ এখন বিলুপ্ত। জায়গাটার নাম বারাসত কাছারি ময়দান। কেউ কেউ বলেন, সাহেবি আমলের ঘোড়দৌড়ের ঘটনাটি এই মাঠেই ঘটেছিল।
১৭৬৯ সালে চালু হওয়া ঘোড়দৌড় হঠাৎ বন্ধ করে দিয়েছিলেন লর্ড ওয়েলেসলি। সেটা ১৭৯৮। কিন্তু আড়ালে আবডালে, লুকিয়েচুরিয়ে বেঁচে রইল ঘোড়দৌড়। কেমন করে যেন হঠাৎ প্রতিষ্ঠিত হল ‘বেঙ্গল জকি ক্লাব’। এ বার ঘোড়া দৌড়বে ময়দানে। জকি ক্লাবের লোকজন যোগাযোগ করলেন ইংল্যান্ডের জকি ক্লাবের সঙ্গে। এঁদের উদ্যোগে আবার নতুন করে তৈরি হল ‘কলকাতা রেসকোর্স’। ১৮১২ সালে।
রাজা-রানি, প্রেমকাহিনি
রেসের মাঠ, জকি, ঘোড়া, আইনসিদ্ধ বেটিং জানার আগে এক বার জেনে নেওয়া ভাল, ‘কলকাতা রেসকোর্স’-এ কেমন করে তৈরি হল ‘রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব’। ভারত স্বাধীন হওয়ার একশো বছর আগে, অর্থাৎ ১৮৪৭ সালে পাঁচ জন সদস্য নিয়ে তৈরি হয় ‘ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব’। এর পর জানুয়ারি ১৯১২। শীতের সকাল। ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ রানি মেরিকে নিয়ে পা রাখলেন কলকাতা টার্ফ ক্লাবে। খবরে প্রকাশ, ছ’টি ঘোড়ায় টানা গাড়িতে দেহরক্ষী নিয়ে মাঠে প্রবেশ করেছিলেন রাজা-রানি। লর্ড হার্ডিঞ্জ ও লেডি হার্ডিঞ্জ অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন রাজাকে। শোনা যায়, ১৮টি ঘোড়া দৌড়েছিল সে দিন। বিজয়ীর হাতে ‘কিং’স কাপ’ তুলে দেন তুলে দেন রাজা নিজে। পরদিন কলকাতার সমস্ত দৈনিকে ফলাও করে ছাপা হয়েছিল সে খবর। এর আগে ১৯০৫ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ প্রথম বার এই ক্লাবে এসেছিলেন। এই ক্লাবে আগে থেকেই ভারতীয় রাজা-মহারাজাদের আনাগোনা ছিল। বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ ও তাঁর ছেলে উদয়চাঁদ ছিলেন এই ক্লাবের সদস্য। কিন্তু ১৯১২ সালে কলকাতা টার্ফ ক্লাবে রাজার উপস্থিতিতে হর্স রেস আরম্ভ হতেই ক্লাবের নামের আগে যোগ হল ‘রয়্যাল’ শব্দটি। নতুন নাম হল রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব।
রেসের মাঠে শুধু ঘোড়াই দৌড়য়নি, এ মাঠে লেখা আছে প্রেমকাহিনিও। জয়পুরের মহারাজ দ্বিতীয় সোয়াই মান সিংহ পোলো খেলবেন বলে এসেছিলেন কলকাতা রেসকোর্সে। সেই খেলা দেখতে এসেছিলেন কোচবিহারের মহারাজ এবং বরোদার মহারানির মেয়ে পরমাসুন্দরী গায়ত্রী দেবী। তাঁর আভিজাত্য ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন মান সিংহ। সেখান থেকেই নাকি প্রেম, এবং সেই বছরই বিয়ে। এ কাহিনি সত্যি হলে বলতে হয়, ঘোড়দৌড়ের মাঠ শুধু বাজি আর জয়-পরাজয়ের নয়। রোম্যান্সেরও বটে।
১৯৬১-তে রানি দ্বিতীয় এলিজ়াবেথ কলকাতায় এসেছিলেন ডিউক অব এডিনবরা প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে। রানির সম্মানে চালু হয় ‘কুইন’স কাপ’। ইতিহাস বলে, সেই দিনের রেসে ছুটেছিল কুড়িটি ঘোড়া। চ্যাম্পিয়ন হয় ন’নম্বর ঘোড়া ‘সুইনবার্ন’। সে দিনের বিজয়ীর পুরস্কার ছিল নগদ টাকা। রানি নিজে সোনালি রঙের কাপ তুলে দেন বিজয়ীর হাতে।
রেসের মাঠ শুধু গল্পের নয়। কলকাতার রেসের মাঠের সুনির্দিষ্ট আইন-কানুন করেছিলেন লর্ড উলরিক ব্রাউন। পেশায় আইসিএস অফিসার। এই রেসের আরও উন্নতি ঘটান স্যর উইলিয়াম ম্যাকফারসেন।
দৌড়, ঘোড়া ও আরোহী
দক্ষিণ কলকাতার বিলাসবহুল এলাকায় থাকে পলদা। পাড়ার লোকে বলে ওর নাম ছিল পল্টু। কিন্তু জামাকাপড়ের আধুনিক কায়দাকানুন, স্মার্টনেস আর রেসের মাঠ ওকে বানিয়েছিল ‘পল’। দামি গাড়ি। হাতে নিত্যনতুন সিগারেট। গায়ে বিদেশি পারফিউমের ভুরভুরে গন্ধ। পলদা আমাদের শোনাত রেসের মাঠের গল্প। পলদার ডায়ালগ ছিল: রেসের মাঠে যাওয়ার আগে, ঘোড়ার বাজি ধরার আগে রেসের মাঠটাকে ভাল করে জানা দরকার। আস্তাবল থেকে ঘোড়াগুলো বেরিয়ে প্রথমে আসে ‘স্যাডলিং প্যাডক’-এ। এটা ঘোড়ার গ্রিনরুম। জিন লাগানো ও অন্যান্য সাজসজ্জা হয়। তার পর ঘোড়া আসে ‘পান্টার’দের সামনে। মানে বাজি ধরার জায়গায়। স্টুয়ার্ট (অনেকটা রেফারির মতো), সহিস, জকি— এই তিন জনের হাতেই তখন খেলা। পঞ্চাশ টাকার টিকিট কেটে রেসের মাঠে ঢোকা, বাজির টিকিট দশ টাকার। যত খুশি কাটা যায়। মোবাইল নিয়ে ঢোকা বারণ। নিয়ে ঢুকলে আলাদা চার্জ। রেসের মাঠে ঢুকলেই পাওয়া যায় ‘রেস কার্ড’। তাতে সে দিনের রেসের বিষয়ে অনেক তথ্য থাকে। মাঠে নানা রকম গ্যালারি। রিজ়ার্ভ স্ট্যান্ড, মেম্বার স্ট্যান্ড, গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড, মনসুন স্ট্যান্ড। রেস বুঝে ঘোড়া দৌড়য় ১১০০, ১২০০, ১৪০০, ১৮০০ বা ২৮০০ মিটার। উইন্টার ডার্বি আর মনসুন ডার্বির দৌড়ের ট্র্যাক আলাদা। বালি আর চামড়ার গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হয় মনসুন ট্র্যাক, যাতে জল না জমে। রেসের ঠিক আগেই প্রতিটি ঘোড়ার পিঠে লাগানো হয় নম্বর দেওয়া কাপড়। দূর থেকে যাতে ভাল করে দেখা যায় যে কে জিতল। মাঠের জায়ান্ট স্ক্রিনেও দৌড় দেখা যায়। দৌড়ে যাতে ঘোড়া জোরে ছুটতে পারে, সে জন্য জকিদের শরীর হয় পেনসিলের মতো আর নমনীয়। ওজন হয় প্রায় ৫০ কেজি। কলকাতায় রেসকোর্সে সব জকি পুরুষ। বিদেশে মহিলা জকি আছে। কলকাতার বাইরেও রয়েছেন মেয়ে জকি। এমনই এক জকি রূপা সিংহ। তিনি প্রচুর রেস জিতেছেন, সঙ্গে সাতটি চ্যাম্পিয়নশিপ। ১৯৭৮ সালে ভারতে এসেছিলেন মহিলা জকি সিলভা স্টোরাই। তাকেই অনুসরণ করেই আজ রূপা জকি হিসেবে নিজের নাম উজ্জ্বল করেছেন। পাওয়া যায় অজয় রায়, পিন্টু দাসের মতো বাঙালি জকির নামও।
কোন জকি কোন ঘোড়া চালাবে সেটা ঠিক করেন ঘোড়ার ট্রেনাররা। কেউ আগে থেকে জানেন না কে কার পিঠে উঠবেন। স্টার্টিং পয়েন্ট আমাদের ছোটবেলার স্পোর্টসের দৌড়ের মতো অনেকটা। তবে এখানে প্রতিটি ঘোড়ার জন্য রয়েছে নম্বর লাগানো এক-একটি খাঁচার মতো স্টল। স্টার্টার প্রস্তুত। সঙ্কেত পেলেই ঘোড়া ছুটবে। যাঁরা বাজি ধরেছেন, রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছেন। পরের দৃশ্য, ঝড়ের গতিতে দানবিক শক্তিতে ছুটছে এক দল ঘোড়া। ফিনিশিং পয়েন্ট যত এগিয়ে আসছে, চিৎকার তত বাড়ছে। এক সময় থেমে যায় গর্জন। ঘোড়াগুলো হাঁপাচ্ছে। যাঁরা বাজি ধরেছিলেন, তাঁদের কারও আর ঘোড়ার দিকে মন নেই। তাঁরা তখন হিসাবের ঘরে মগ্ন।
কলকাতার রেসকোর্সে দৌড়নোর জন্য পাঁচ-ছ’শো ঘোড়া আছে। প্রাচীন ভারতে ঘোড়া আসত পারস্য দেশ থেকে। আরব দেশ থেকেও ঘোড়া আমদানির কথা শোনা যায়। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞের মতে, পর্তুগাল থেকেও ঘোড়া আসত এ দেশে। আর্জেন্টিনা থেকেও এসেছে ঘোড়া। এখন যেমন এক-একটা ঘোড়ার দাম দশ লক্ষ টাকা থেকে শুরু করে এক কোটি টাকা পর্যন্ত। সে কালে দাম ছিল দশ টাকা থেকে দেড়শো টাকার মধ্যে। ঘোড়া সব সময়ই দামি। যে রাজার অশ্বশালায় যত বেশি ঘোড়া, সে রাজা তত বেশি শক্তিশালী। তখনকার ঘোড়াদের পরিচর্যা করার জন্য থাকত শুধু সহিস। এখন ঘোড়ারা অনেক বেশি যত্নে থাকে। প্রতিদিন তারা নিয়ম করে সাঁতার কাটে। পায়ের পেশি শক্তিশালী করার জন্য ব্যায়াম করে। সাত-আট কেজি দানাপানি খায়। তাতে থাকে ক্যালশিয়াম, ওটস বা ভুসি। পঞ্চাশ লিটারের মতো জলও খেতে হয়। কোনও কোনও ঘোড়া বাতানুকূল আস্তাবল ছাড়া থাকতেই পারে না। রেসের মাঠের দুরন্ত জয়ী ঘোড়ার সঙ্গে অন্য ঘোড়ার সঙ্গম ঘটিয়ে তৈরি করা হয় আরও শক্তিশালী ঘোড়া। সেই যুবক ঘোড়াগুলোকে দু’-তিন বছর বয়স হলেই পাঠিয়ে দেওয়া হয় আস্তাবলে। শুরু হয় ট্রেনিং। দৌড়বে বড়জোর ছ’-সাত বছর। আর দৌড়তে দৌড়তে ক্লান্ত হয়ে অবসর নিলে, ঘোড়াগুলি নিয়ে নেয় আর্মি ও পুলিশ ট্রেনিং স্কুল, ঘোড়সওয়ার পুলিশ আর পোলো খেলোয়াড়রা। অবসরের গল্প সব সময়ই মনখারাপের। জকি আর মালিক ছাড়া কেউ কি আর তাদের মনে রাখে? কে জানে!
রেসের রকমফের
ঘোড়দৌড় আর বাজি— এই দুই কথার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে জ্যাকপট। যিনি বাজি ধরবেন, তিনি পাঁচটি নির্বাচিত জ্যাকপট রেসের প্রথমটি শুরু হওয়ার আগেই, ওই পাঁচটি রেসের সম্ভাব্য বিজয়ী ঘোড়ার উপর বাজি ধরবেন। যদি চারটি রেসে নির্বাচিত ঘোড়া জয়ী হয়, তা হলেই জ্যাকপট লেগে গেল। পাঁচ নম্বর রেস নাকি না জিতলেও চলবে। রেসের মাঠে এমন দু’টি টার্ম ‘কুইনেলা’ আর ‘টানালা’। ‘কুইনেলা’তে এক নম্বর এবং দু’নম্বর সম্ভাব্য স্থানাধিকারী ঘোড়ার নামে বাজির টিকিট কিনতে হয়। আর ‘টানালা’তে এক, দুই এবং তিন নম্বর সম্ভাব্য স্থানাধিকারী ঘোড়ার নামে টিকিট কিনতে হয়। এ ছাড়াও রয়েছে দু’টি মজার বাজি ধরার টিকিট। সেগুলি হল ‘সেকেন্ড হর্স পুল’ আর ‘থার্ড হর্স পুল’, সংক্ষেপে ‘এসএইচপি’ আর ‘টিএইচপি’। এতে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানাধিকারী ঘোড়ার নামে বাজি ধরতে হয়। সবচেয়ে সহজ টিকিট ‘উইন’, মানে কোন ঘোড়া রেসে বাজি জিতবে। আর ‘ফোরকাস্ট’ হল রেসে কোন ঘোড়া প্রথম এবং দ্বিতীয় স্থানে থাকবে, তা নির্বাচন করতে হবে। জীবনে প্রথম বার যাঁরা রেসের মাঠে বাজি ধরতে যাচ্ছেন, তাঁদের সুবিধার জন্য রয়েছে ‘বুকমেকার টোটালাইজ়েটর’, সংক্ষেপে ‘টোটে’। এই পদ্ধতি, যিনি বাজি ধরতে যাচ্ছেন তাঁকে বেটিংয়ের ঘোড়া নির্বাচন করতে সাহায্য করে। যাতে রেসের শেষে তিনি অন্তত বাজির কিছু রিটার্ন পান। কলকাতায় নানা ধরনের রেস হয়। ‘কুইন’স কাপ’ খেলা হয় সাধারণত ফেব্রুয়ারির প্রথম শনিবার। মার্চে ‘গভর্নর’স কাপ’। এ ছাড়াও ‘থাউজ়েন্ড গিনিস’, ‘টু থাউজ়েন্ড গিনিস’, ‘ফিলিজ়’ (ফিমেল হর্স) ও ‘কোল্ট’ (মেল হর্স) দৌড়ও হয়। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ‘উইন্টার ডার্বি’ আর ‘মনসুন ডার্বি’।
ভাগ্যের দৌড়ে জয়ী
রেস খেলে সর্বস্বান্ত হয় এমন ঘটনাই বেশি, কারণ ভাগ্যবানরা চিরকালই সংখ্যালঘু। তেমনই এক জন ভাগ্যবানের নাম জেসি গ্যালস্টন। ইরান থেকে কলকাতায় এসেছিল বছর দশেকের এই আর্মেনীয় কিশোর। ফোর্ট উইলিয়ামের আর্মি অফিসারেরা তাঁকে ময়দানে ঘোড়ায় চড়া শিখিয়েছিল। ধীরে ধীরে সে হয়ে ওঠে রেসের মাঠের সেরা জকি। তার পর এক দিন কিনে ফেলেন বেশ কিছু ঘোড়া। তাঁর ঘোড়াগুলি কাঁপিয়ে দিল রেসের মাঠ। এই যে আমরা এখন কলকাতায় নিজ়াম প্যালেস দেখি, সেটা নাকি ঘোড়দৌড়ের টাকায় বড়লোক হয়ে জেসি বানিয়েছিলেন। পরে তা হায়দরাবাদের নিজ়াম মির ওসমান আলি খানের কাছে হস্তান্তরিত হয়। অনেকে বলেন, রেসের মাঠের টাকায় জেসি হয়ে উঠেছিলেন রিয়েল এস্টেট ডেভলপার। শোনা যায়, আদি কলকাতায় তাঁর নাকি প্রায় তিনশোর মতো ভূসম্পত্তি ছিল। অত খবর জানা নেই। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নির্মাণের তহবিলেও তিনি নাকি বিপুল টাকা দেন। কুইন’স ম্যানসনের নামও আগে ছিল গ্যালস্টন ম্যানসন।
বিশ্ববিখ্যাত দৌড়বাজ ঘোড়া
ফুটবলার-ক্রিকেটারদের যেমন সর্বকালের সর্বসেরা হয়, ঘোড়াদেরও তেমন ঘটে। এমন একটি ঘোড়া ‘ফার ল্যাপ’। ঘোড়াটি ছিল অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় আইকন। জন্ম নিউ জ়িল্যান্ডে। কেউ তাঁকে বলত ‘ওয়ান্ডার হর্স, কেউ আদর করে বলত ‘রেড টেরর’, কেউ নাম দিয়েছিল ‘বিগ রেড’। একের পর এক রেস জেতার পরে হঠাৎ এক দিন অসুস্থ হয়ে রহস্যজনক ভাবে মারা যায় ঘোড়াটি। ফরেনসিক তদন্তে দেখা যায়, মৃত্যুর আগে তাকে দেওয়া হয়েছিল বিষ। কে বা কারা তা করেছিল, তার সন্ধান মেলেনি। এমনই আরও কয়েকটি পৃথিবীবিখ্যাত ঘোড়া জন হেনরি, সেক্রেটারিয়েট, ওয়র অ্যাডমিরাল। অশ্ব-বিশেষজ্ঞদের অনেকেই ‘ম্যান অব ওয়র’ ঘোড়াটিকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দৌড়ের ঘোড়া বলে মনে করেন। কেনটাকি হর্স পার্কে রয়েছে তার স্ট্যাচু। তাকে নিয়ে লেখা হয়েছে বই। আর এক আশ্চর্য ঘোড়া ‘সিবিস্কিট’। এই ঘোড়াটির জীবনী নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক বই। নির্মিত হয়েছে একটি চলচ্চিত্র। আমেরিকার ‘স্যান্টা অ্যানিটা’ পার্কে রয়েছে সে ঘোড়ার স্ট্যাচু। পৃথিবীবিখ্যাত পারসিক কবির নামে নাম রাখা হয়েছিল একটি ঘোড়ার। সে ডার্বি কাঁপিয়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জন্মানো ব্রিটেনের এই ঘোড়ার নাম রাখা হয়েছিল ওমর খৈয়াম। ইউরোপে যুদ্ধের আগুন ছড়াতেই এক বছর বয়সি ঘোড়াটিকে নিরাপদে রাখার জন্য নিলামে তোলা হয়। দেড় হাজার ডলার দিয়ে ঘোড়াটিকে কিনে নেন আমেরিকার এক হর্স ট্রেনার। সবাইকে অবাক করে দিয়ে কেনটাকি ডার্বিতে ওমর খৈয়াম প্রথম বিদেশি ঘোড়া হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হয়।
শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্রে ঘোড়া
১৪৯৯ সাল। ফরাসি সৈন্যরা আক্রমণ করল ইটালির মিলান। সৈন্যদের চোখে পড়ল একটি আশ্চর্য সুন্দর, মাটির অশ্বমূর্তি। তিরন্দাজ সৈনিকরা এই ঘোড়াটিকে তাদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ব্যবহার করল। ধ্বংস হয়ে গেল সেই ঘোড়ার মডেল। ঘোড়ার এই ভাস্কর্যের পরিকল্পনা হয় ১৪৮২ সালে। সে সময় মিলানের ডিউক পরিকল্পনা করেছিলেন, এটি হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অশ্বারোহী মূর্তি। দায়িত্ব পেয়েছিলেন শিল্পী লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চি। কিন্তু তিনি একটা বড় মাটির মডেল তৈরি করেছিলেন। ব্রোঞ্জ ঢালাইয়ের আগেই যুদ্ধ লেগে গিয়েছিল। তৎকালীন সেই ডিউকের বাবার নাম অনুসারে ঘোড়াটিকে অনেক বলত ‘স্ফোরজা’, কেউ নাম দিয়েছিল ‘গ্রান কাভালো’। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে এই অসম্পূর্ণ ভাস্কর্যের নাম ‘লিয়োনার্দোর ঘোড়া’।
ঘোড়া, রেসের মাঠ এবং বাজি বিরাট প্রভাব ফেলেছিল বাংলা সিনেমা এবং সাহিত্যে। শঙ্করের উপন্যাস ‘সীমাবদ্ধ’ থেকে ছবি তৈরি করলেন সত্যজিৎ রায়। অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর এসেছেন জামাইবাবুর বাড়ি কলকাতায়। জামাইবাবু রেসের মাঠে যান। সিনেমায় শর্মিলাও রেসের মাঠে গেলেন। বাজি ধরলেন ঘোড়ার নাম দেখে। বাংলার মাটি জল হাওয়া সব কিছুতেই কবিতা। সেখানে ঘোড়া থাকবে না, তা কী হয়! রবিঠাকুর ঘোড়া নিয়ে কী বলছেন দেখা যাক... “তাকে তৈরি করলেন ব্রহ্মা... এ ডিম পাড়ে না তবু বাজারে তার ডিম নিয়ে একটা গুজব আছে, তাই এ’কে দ্বিজ বলা চলে।… বাসার জন্যে তিনি অন্য জন্তুর কাউকে দিলেন বন, কাউকে দিলেন গুহা, কিন্তু এর দৌড় দেখ্তে ভালোবাসেন বলে এ’কে দিলেন খোলা মাঠ…। ফাঁস লাগিয়ে ধরলে একদিন ঘোড়াটাকে। তার পিঠে দিলে জিন, মুখে দিলে কাঁটা-লাগাম। ঘাড়ে তার লাগায় চাবুক আর কাঁধে মারে জুতোর শেল।… মাঠে ছেড়ে রাখ্লে হাতছাড়া হবে, তাই ঘোড়াটার চারিদিকে পাঁচিল তুলে দিলে।… কিন্তু ঘোড়ার ছিল খোলা মাঠ, সে এসে ঠেকল আস্তাবলে।... আস্তাবলবাসী এই প্রাণীটির নামই ঘোড়া কিংবা অশ্ব।” ঘোড়া নিয়ে পৃথিবীতে লেখা হয়েছে বহু উপন্যাস, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য নিকোলাস ইভান্সের ‘দ্য হর্স হুইস্পারার’, ওয়াল্টার ফারলের ‘দ্য ব্ল্যাক স্ট্যালিয়ন’, অ্যানা সেওয়েলের ‘ব্ল্যাক বিউটি’।
কবি পাবলো নেরুদার আলো অন্ধকার আর মুক্তির সেই আশ্চর্য কবিতা ‘হর্সেস’— যেখানে কবি জানলা দিয়ে ঘোড়াগুলোকে দেখতেন। অবশ্য এই সব গল্পের আড়ালে দূর থেকে রেসের মাঠ দেখা বাঙালির হয়তো মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের সেই ঘোড়াগুলিকে... “মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে,/ প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন— এখনও ঘাসের লোভে চরে...”
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে