প্রথম কিক অফ

এই প্রথম কলকাতায় বসেছিল ফুটবল বিশ্বকাপের আসর। ফুটবলে প্রথম শট নেওয়া বাঙালি মানুষটি দেখলে গর্বিত হতেন।এই প্রথম কলকাতায় বসেছিল ফুটবল বিশ্বকাপের আসর। ফুটবলে প্রথম শট নেওয়া বাঙালি মানুষটি দেখলে গর্বিত হতেন।

Advertisement

ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share:

অগ্রণী: নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী

কলকাতা, ১৮৭৭। একটা গাড়ি যাচ্ছিল ফোর্ট উইলিয়ামের পাশ দিয়ে। গাড়িতে সর্বাধিকারী পরিবারের গৃহবধূ হেমলতা দেবী ও তার শিশুপুত্র। ফোর্ট উইলিয়ামের পাশে ‘ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব’-এর মাঠে সাহেব-সেনারা বল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে দেখে বছর আটের ছেলেটি গাড়ি থামাতে বলে, এগিয়ে যায় খেলা দেখতে। হঠাৎ বলটি একেবারে তার সামনেই। গোরা সৈন্যদের দেখেও ভয় না-পাওয়া ছেলেটি নিবিষ্ট হয়ে বলটা দেখছিল। ইংরেজদের এক জন বলে ওঠে, ‘কিক ইট!’ হাত থেকে নামিয়ে পায়ে মেরে বলটা ফেরত পাঠায় ছেলেটি। বাঙালির পায়ে সে-ই প্রথম ফুটবল শট। আট বছরের ছেলেটি নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী।

Advertisement

পর দিনই হেয়ার স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে হইহই করে ‘ম্যান্টন অ্যান্ড কোম্পানি’-র দোকান থেকে ফুটবল ভেবে রাগবি বল কিনে এনে দাপাদাপি শুরু। ছেলেদের পায়ে রাগবি বল, নিয়মকানুন না জেনে দৌড়াদৌড়ি দেখে পাশেই প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষক জি এ স্ট্যাক ফুটবলে হাতেখড়ি দেন তাদের। ক্যাপ্টেন হয়েছিলেন নগেন্দ্রপ্রসাদই।

ইংরেজ শাসনে বাঙালিকে বারবারই ভীতু, দুর্বল, অলস তকমা দেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে নগেন্দ্রপ্রসাদ ছিলেন এক বিদ্রোহ। কৈশোর পার করার আগেই বেশ ক’টি ক্লাব গড়ে তোলেন। ‘বয়েজ ক্লাব’ ভারতের প্রথম ফুটবল সংগঠন। তাঁর হাত ধরেই গড়ের মাঠে প্রথম বাঙালি ক্লাবের তাঁবু পড়ে— ওয়েলিংটন ক্লাব।

Advertisement

১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন শোভাবাজার ক্লাব। এই ক্লাবের মাধ্যমেই সারা বাংলা জুড়ে ফুটবলকে জনপ্রিয় করার পরিকল্পনা নেন। হাওড়াতে বামাচরণ কুণ্ডুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করেন। সেই অর্থে ভারতে প্রথম ফুটবল প্রতিযোগিতা ‘ট্রেডস কাপ’। ১৮৮৯ সালে শোভাবাজার অংশগ্রহণ করে। বাংলায় ফুটবল, তাও সাহেব খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে। নগেন্দ্র আর তাঁর দল তখন বাঙালির ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি। বাংলার লাটসাহেবও খেলা দেখতে এসেছিলেন। সাহস, আবেগ থাকলেও পেশাদারিত্বের অভাবে বিদেশের দলগুলোর কাছে হার মানতে হয় প্রথম বছরগুলোয়। কিন্তু ১৮৯২ সালে শক্তিশালী ক্লাব ‘ইস্ট সারে’ কে হারিয়ে দেয় শোভাবাজার। বাঙালি বুঝতে পারে, ইংরেজকে হারানো সম্ভব। অভিনন্দনে ভেসে যান নগেন্দ্র ও তাঁর দল। ১৯১১ সালে মোহনবাগানের শিল্ড জয়ের আগে কোনও বাঙালি ক্লাবের এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য।

সে সময় রাজতন্ত্র বজায় ছিল। বিভিন্ন প্রদেশের রাজারা ইংরেজদের সঙ্গে এই ফুটবল খেলাকে বিনোদন ভেবে নেন, বা ইংরেজদের সঙ্গে সমঝোতার এক ক্ষেত্র মনে করেন। তাই নগেন্দ্রপ্রসাদ সমাজের সর্বস্তর থেকে খেলোয়াড় তুলে আনার স্বপ্ন দেখলেও তা প্রকৃতপক্ষে ছিল ‘বাবু’দের কুক্ষিগত। তবুও সে কালে শোভাবাজার ক্লাব খেলতে নামলে বাঙালি আবেগে ভেসে যেত।

নগেন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, খালি পায়ে ফুটবল খেললেই হবে না, চাই পরিকাঠামো। ১৮৯২ সালে ‘ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব’, ‘ডালহৌসি’, ‘ন্যাভাল ভলান্টিয়ার্স’, তিন ক্লাবের সঙ্গে আলোচনায় নগেন্দ্রপ্রসাদ ঠিক করেন, সর্বভারতীয় শিল্ড আয়োজন করবেন। এই শিল্ড পরিচালনার জন্য গঠিত
হয় ‘ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন’। নগেন্দ্রপ্রসাদই সেখানে একমাত্র ভারতীয় প্রতিনিধি। বিদেশ থেকে শিল্ড এলে তা দেখার জন্য উপচে পড়ে বাঙালি। ১৮৯৩ সালের শিল্ডে শোভাবাজার ক্লাব একমাত্র ভারতীয় দল হিসেবে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।

নগেন্দ্রপ্রসাদের কাছে খেলা শুধু বিনোদন নয়, শরীর-মনের শক্তিবৃদ্ধির মাধ্যম ছিল। দুর্বল হলে ইংরেজদের সঙ্গে ফুটবলেও জেতা যাবে না, পাওয়া যাবে না স্বাধীনতাও— এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। বিবেকানন্দ স্বয়ং ময়দানে গিয়ে নগেন্দ্রপ্রসাদের খেলা, ইউরোপীয়দের চোখে চোখ রেখে বল সামলানো দেখতে যেতেন। শিকাগো-ফেরত বিবেকানন্দকে নিয়ে যখন কলকাতা আপ্লুত, শোভাবাজার রাজবাড়ির সংবর্ধনাসভায় তিনি নগেন্দ্রপ্রসাদকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘‘ওঁর মতো মানুষ, ওই রকম মরদ চাই।’’

ক্লাবে নিচু জাতের লোককে নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠলে নগেন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘আমি বুকের রক্ত দিয়ে ক্লাব তৈরি করেছি। বংশপরিচয় দিয়ে করিনি। জাতপাত নিয়ে খেলার আসর আমি সাজাব না, তৈরি করব খেলোয়াড় জাত।’’ ১৯৭৭ সালে নগেন্দ্রপ্রসাদের স্মরণে ভারতীয় ফুটবলের শতবর্ষ পালন করা হয়। ওইটুকুই। তার বেশি স্মরণ, সম্মান— পাননি তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন