সম্পর্কে ঠাম্মা হলেও, দুর্গা ডাকত ‘পিতি’। ‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে ইন্দির ঠাকরুণ আর দুর্গা।
বেলা এগারোটা। পুজো সেরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি। কাল এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রোদ্দুরখানি আজ বড় কোমল মনে হচ্ছে। হঠাৎ আর একটা ঠিক এমনই রোদ্দুর-ভরা বেলা এগারোটার ছবি মনে পড়ল। এখন সত্তর, তখন ছিল সাত। নোয়াখালি জেলার চৌমুহনী-তে নিজেদের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। ইন্দু বৈষ্ণবী সবে উঠোনে দাঁড়িয়ে বলল, কই গো মায়েরা! ঠিক তক্ষুনি শুরু হল পাথরের চাঁইয়ের মতো শিল পড়া— বিনা মেঘে বজ্রপাত— ভরা রোদ্দুরে। বৈষ্ণবী দৌড়ে বারান্দায় উঠে এল। হঠাৎ দেখি ঠাকুমা, ওঁর পক্ষে যতটা সম্ভব জোরে দৌড়চ্ছেন উঠোনের দরজার দিকে। ঠাকুমার কোমর থেকে শিরদাঁড়া এমন ভাবে বেঁকে গিয়েছে, উনি যখন হাঁটেন, পিঠটা মাটির সঙ্গে প্রায় সমান্তরাল থাকে। উনি উঠোনে নামতেই সবাই চেঁচিয়ে উঠল, কইরতে আছেন কী? কইরতে আছেন কী? তিনি বললেন, গরুগুলান খুঁটিতে বাঁধা আছে মাঠে। নিশিদা, রনাদা, সাধু চিৎকার করে বলে উঠল, আমনেরে যাইতে হইব না, আমনে ঘরে যান, আমরা যাইতে আছি। বলে ওরা দৌড়ল মাঠের দিকে। কিন্তু ঠাকুমাকে ফেরানো গেল না। এত ক্ষণে শিলার টুকরো অনেকটা ছোট হয়ে এসেছে, আমিও দৌড়লাম ঠাকুমার পিছন পিছন। বৈষ্ণবী বলল, ওইডার কিসু হইব না। রোগা-পটকা মানুষ, শিলার ফাঁক দিয়া দিয়া চইলা যাইব।
ঠাকুমা পাড়ার খবর নিতে বের হন, বাবা ন’টায় বেরুবার পর। প্রথমে সদানন্দ জ্যাঠার বাড়ি গিয়ে বললেন, ও বড়বউ, সদার জ্বর ছাড়ছে? জেঠিমা বললেন, কাল থেইকা আর জ্বর আসে নাই। ‘তা হলে আইজ উয়ারে ভাত দ্যাও, শিঙ্গি মাছের ঝোল দিয়া।’ সদা জ্যাঠা বললেন, মা চাল থেইকা পেত্থম কচি লাউডগা পাড়ছি, আমনের লাইগা পাঠাইয়া দিমু। এ বারে ঠাকুমা গেলেন ননীকাকার বাড়ি। কাকার বড় মেয়ে সুখীদি ছেলে-কোলে বাপের বাড়ি এসেছে। ঠাকুমা সোনার আধখানা চাঁদ দিয়ে পুতির মুখ দেখলেন। সুখীদি প্রণাম করতেই ঠাম্মি বললেন, কী রে, তর সোয়ামির দেখা নাই ক্যান? কোথায় লুকাইয়া রাখসে? সুখীদি লজ্জা পেয়ে বলল, দিঘিতে স্নান করতে গেছে। ঠাম্মি বললেন, ‘অ রসময়, এই বারে তর মায়েরে যাইয়া লইয়া আয়, মাইয়াবাড়ি বেশি দিন ভাল দেখায় না।’
ঘোর ভাঙল। আমার কাজের ঠিকে মাসি বলছে, মাসিমা, খেয়ে নিন, একটা তো প্রায় বাজে। লবণ হ্রদের দুপুর খাঁ-খাঁ করছে। স্বামী হঠাৎ চলে গেলেন বছরখানেক আগে। শরীরটা কোনও রকমে টেনে বাথরুমে গেলেন, দাঁড়াতে পারলেন না, ফিরে এসে শুয়ে পড়লেন। একটু পরেই বুকের ওঠানামা বন্ধ হয়ে গেল। কয়েকটা মিনিট সময় দিলেন, কিছু করা গেল না। একমাত্র ছেলে সান ফ্রান্সিসকো-তে আছে। কাজের মাসি ফের তাড়া দিল, ‘আপনার খাওয়ার বাসন ধুয়ে আমি বাড়ি যাব।’ একা একা খেতে বসে আর একটা দুপুরের কথা মনে পড়ল— বাবা ঘরের মাঝখানে বড় পিঁড়িতে, আমরা দু’পাশে লাইন করে ছোট ছোট পিঁড়িতে। ঠাকুমা সারা দিনে এই এক বার আমিষ রান্নাঘরে আসেন পিছনের দরজা দিয়ে। বাবার পাশে দাঁড়ান। বলতে থাকেন, নিশি অতসীরে লাল শাক আর কাসুন আর একটু দ্যাও। বেণুরে আর একটু লাউ-শুক্তা দিও। এডা আইজকাল মাছ খাইতে চায় না। মনুরে বোয়াল মাছ দিও না, ওয়ার সর্দি হইছে। কানুরে পেটির মাছ দিও। নানু খাইতে আহে নাই এহনও? এই যে, এত ক্ষণ কোথা ছিলা? জুনুর সাথে বইসা যাও— তোমার দুষ্টুমি এট্টু কমাও। কাইল জুনুরে মারছ কী ল্লাইগ্যা? বাবার থালার চারপাশে বাটি-বাটি সাজানো আছে। ঠাম্মি সাধুকে বললেন, নিরামিষ ঘরে জামবাটিতে খোকার দুধ ঢাইকা রাখছি, আইনা দ্যাও। এ বার বাবা বললেন, মা, বেলা হইছে, তুমি এই বারে খাইতে যাও, এরা তো আছে, দেইখা-শুইনা দিবে’খন। চুড়ির টুংটাং শোনা গেল, ঠাকুমা নেমে এলেন উঠোনে। রান্নাঘরে সিঁড়ির পাশে বসা কুকুরটাকে দেখে বললেন, ও নিশি, ভুলুরে খাইতে দ্যাও না, তোমাগো এই ব্যাভারটা ভাল দেখি না, ওয়ারে একবারে বাইড়া দিলেই তো হইয়া যায়। ভুলু ঠাম্মির পিছন নিল। ঠাম্মা বললেন, আমার খাবার তো তর মুখে রোচবে না, যা গিয়া নিজের জাগায়, ওরা দিবে’খন। এর পর নিরামিষ রান্নাঘরে এসে, মা পুজোতে যে ভোগ দিয়েছিলেন, সেই প্রসাদের ঢাকা খুললেন। পাথরের থালায় মধ্যিখানে গোল করে অন্ন, আর পাশে নানা রকম ভাজা, শাক, নানা ব্যঞ্জন। ঠাম্মা পাথরবাটিটা ঠাকুরদার ফোটোর সামনে রাখলেন। এক গ্লাস জলও দিলেন সঙ্গে। চুপ করে বসে রইলেন। এখন ঠাম্মি আর আমাদের ঠাম্মি নেই, ডুব দিয়েছেন গভীরে। সেখানে ঠাকুরদা আর ঠাকুমা মুখোমুখি বসে। দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে।
ঠাকুমার দুপুরে শোওয়ার সময় হয় না। বারান্দায় পানের বাটার পাশে বসে সরু-সরু করে সুপারি কাটেন। দোকানের কর্মচারীরা একে একে খেতে আসে। ঠাম্মা বলতে থাকেন, বাবারা, খাইটা-খুইটা আসো, পেট ভইরা খাইয়ো। ও নিশি, আইজ শনিবার নবদ্বীপ আর জগবন্ধু মাছ খাইব না, নিরামিষ ঘর থেইকা ধোকার ডালনাটা আইনা দিও। খেয়ে উঠে ওরা ঠাম্মির বাটা থেকে পান নিয়ে ঠাম্মির কুশল জিজ্ঞেস করে চলে যায়। ঠাম্মিও ওদের বাড়িঘরের খবর নেন।
রান্নাঘরের দরজা বন্ধ হতে-হতে চারটে-সাড়ে চারটে। ঠাম্মি উঠে উঠোনে রোদে দেওয়া আমসত্ত্ব, আচার নিজের খাটের নীচে রাখেন। সেখানটা দেখলে মনে হবে একটা ছোটখাটো ভাঁড়ার ঘর। সারি সারি বৈয়মে নানা টক মিষ্টি আচার, আর নারকেল, তিল, মুগ, ক্ষীরের সন্দেশ, নাড়ু, মোয়া। দাঁড়িয়ে আলমারির তাক ছুঁতে পারেন না, তাই ঠাম্মি এগুলো খাটের নীচে রাখেন। কেউ এলে পিরিচে করে বেড়ে খেতে দেন।
জ্যৈষ্ঠের একটা সকালে ঠাম্মি ভোর পাঁচটায় উঠলেন না, মা দু-তিন বার ঘুরে গেলেন, তার পর ছ’টার সময় গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে গেলেন— সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন। বাড়ির যে যেখানে ছিল দৌড়ে এল, তার পর পুরো গ্রাম তাঁর ঘরে জড়ো হল। বাবা ঠাম্মির পাশে চুপ করে বসে আছেন, যেন কী হয়েছে বুঝতে পারছেন না। সদা জ্যাঠা যখন বললেন, কাকি আমাগো ছাইড়া সগ্গে গেছেন, শুনে প্রথমে বাবা প্রবল ভাবে কাঁপতে লাগলেন, তার পর তাঁর প্রশস্ত বুকে ঠাকুমার ছোট্ট শরীরটা জড়িয়ে নিয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলেন শিশুর মতো। ভুলু বারান্দার নীচে বসে মুখটা উঁচু করে নাক আর কান খাড়া করে কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। আমি ভুলুর পাশে বসলাম, ভুলু আমার ছোট্ট কোলে ওর মাথাটা রাখল, যেন মাথাটা ধরে রাখার শক্তি ও হারিয়ে ফেলেছে।
বাবা কলকাতায় পড়াশোনা করে বি.এ পাশ করার পর ওখানে থেকেই চাকরি করতে চেয়েছিলেন। ঠাকুমা ধনুকভাঙা পণ করলেন— গাঁ ছাড়ুম না। গাঁয়ে এসে বাবা ব্যবসা শুরু করলেন। মা লক্ষ্মীর দয়া হতেই প্রথমে পাড়া থেকে বাজারে যাওয়ার দুটো বাঁশ পাতা সাঁকোটার জায়গায় কাঠের পাটাতন পেতে পেতে দু’পাশে রেলিং দেওয়া পুল বানালেন। গরুর গাড়ি গড়গড়িয়ে যেতে লাগল। গ্রামের মানুষ দু’হাত তুলে বাবাকে আশীর্বাদ করল। বাবা আস্তে আস্তে জমিজিরেত করলেন, তার পর একটা বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল ঠাকুমার নামে ‘মাতঙ্গিনী বালিকা বিদ্যালয়’ নাম দেবেন। কিন্তু ঠাকুমা বললেন, না, ঠাকুরদার নামে হোক। যে দিন উদ্বোধন হল, ঠাম্মি অত তাড়াতাড়ি শুতে গেলেন না। বারান্দায় পাতা বেঞ্চিতে হেলান দিয়ে মাথা-হাতে পা মুড়ে বসে ছিলেন। হঠাৎ ঘরের দরজায় এসে দেখি, বাবা ঠাম্মির পাশে বসে আছেন আর ঠাম্মি বাবার মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। বারান্দায় কেন জানি আসতে পারলাম না। জানি, মা-ও ইচ্ছে করে ঠাকুরঘর থেকে বের হচ্ছেন না। নিশিদারা সবাই রান্নাঘরে বসে আছে, এখন কেউ উঠোনে নামবে না। উঠোনের মাঝখানে লাগানো কদমগাছটা ফুলে ফুলে ভরে আছে।
বাবার বালিকামন্দিরের কোঠা বছর-বছর বাড়তে লাগল। আর এ দিক দিয়া তুমি ঠাম্মি, তোমাদের দুজনার সংসারটারে বাড়াইতে বাড়াইতে একেবারে গ্রামজোড়া কইরা ফেল্লা। আমাগো কত জ্যাঠা, কত কাকা, পিসি! ভাইফুঁটার দিন বাবারে কতগুলান বুইনের বাড়ি ফুঁটা লইতে যাইতে হইত। ঠাম্মিগো, আর আমাদের দিগে চাইয়া দেহ, আমার সংসারডা ছোডো হইতে হইতে একখান ঘরে আইয়া ঠেকছে। এই সাঁঝের বেলায় বারান্দায় আইয়া বইসা আছি মানুষজন দেখবার লাইগা— ঘরগুলান খাঁ-খাঁ কইরতাছে আমার প্রাণডার লাহান। কীসের লাইগা এমন হইল ঠাম্মি?
মনে পড়ে, ধলা জেঠি এক বার আমার লাইগা একটা পুতলা লইয়া আমাগো বাড়ি আইল। কী সুন্দর পুতলা! গাঁয়ের মাইয়ারা ভাইঙ্গা পড়ল আমাগো বাড়ি। কেউ হাত ধইরা টানে, কেউ পা। সকলডির কোলে কোলে পুতলা, আমি আর পাই না। শ্যাষে রাগ কইরা কইলাম, তোমরা এহনে বাড়ি যাও, এইডা আমার পুতলা। পুতলা লইয়া আমি খেলুম। তুমি ঠাম্মি গোয়ালে যাইতেছিলা সবক’টা গরু আইছে নাকি দেখবার লাইগা, আমার কথা শুইনা কইলা— কী কইলি! কী কইলি! ধলা তরে একলা খেলবার লাইগা পুতলা দিছে? তুই রানির লাহান একলা একলা পুতলা লইয়া খেলাইবি? আর উয়ারা দাঁড়াইয়া চাইয়া চাইয়া দেখবে? এমুন আমার-আমার কইরতাছস, তর কপালে দুঃখ আছে।
ঠাম্মি গো, তাইর লাইগা কী এমুন একলার জীবন কাটাইতে হইতাছে। ঠাম্মি, এই লবণহ্রদে আরও কত কত জন আমার লাহান একলা পইড়া আছে— শরীরডারে লইয়া— আর গন্ডায় গন্ডায় ওষুধ গিলতাছে। তুমার জেবনডা ছিল নদীর মতো।। আর আমার জীবনচর্চা বদ্ধ, জমা জল— যেন একটা ডোবা গো ঠাম্মি।