ওপেন এয়ার জেল

লালগোলাতে এই মুক্তকারা আছে তিরিশ বছর আগে থেকেই। কোনও বন্দি এখানে চায়ের দোকান চালান, কেউ টিউশন করেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসারও করেন অনেকে। প্রচলিত জেলখানার সঙ্গে কোনও মিল নেই এর। এখানে না আছে বিরাট পাঁচিল, না আঁটোসাঁটো নিরাপত্তা। কোনও ওয়াচ-টাওয়ার নেই। তাই অনেক উঁচু থেকে কোনও সশস্ত্র প্রহরীর সতর্ক দৃষ্টি মাপে না কাউকে।

Advertisement

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share:

প্রচলিত জেলখানার সঙ্গে কোনও মিল নেই এর। এখানে না আছে বিরাট পাঁচিল, না আঁটোসাঁটো নিরাপত্তা। কোনও ওয়াচ-টাওয়ার নেই। তাই অনেক উঁচু থেকে কোনও সশস্ত্র প্রহরীর সতর্ক দৃষ্টি মাপে না কাউকে। অন্ধকার ছোট ছোট সেল-এর বদলে এখানে বড় মাপের ঘর। অনেক জানলা, আলো-ছড়ানো বারান্দা, আকাশ-খোলা উঠোন, ইচ্ছেমত চলাফেরার জায়গা। এ জেলের দরজা খোলা সারা দিন। ঢোকা-বেরনোয় বাধা নেই কোনও। কলকাতা থেকে ২৬০ কিলোমিটার দূরে মুর্শিদাবাদের লালগোলায় এই মুক্তকারা-য় থাকা বন্দিরাও অন্য রকম। তাঁদের কারও আছে চায়ের দোকান, কেউ বেচেন সবজি। টোটো কিনে পথে নেমেছেন কেউ, কেউ দিয়েছেন দর্জির দোকান। কেউ টিউশন করেন, কেউ মজুরের কাজ।

Advertisement

৩০ বছর আগে, ১৯৮৭-তে লালগোলা রাজপ্রাসাদের একাংশ সংস্কার করে তৈরি হয়েছিল এই ‘ওপেন এয়ার’ জেল। প্রাসাদের প্রধান অংশ এখনও দাঁড়িয়ে আছে কারা ভবনের পাশে, জরাগ্রস্ত। তার চূড়ায় যুদ্ধরত সিংহ ও ঘোড়ার মূর্তি— রাজবংশের প্রতীক। সামনে বিরাট ফোয়ারা, বোঝা যায় এক কালে জ্বলজ্বলে জলকেলির সাক্ষী। এখন শুকিয়ে পাথর হয়ে গেছে যেন। প্রাসাদের প্রধান ফটকের মুখোমুখি রাজেশ্বরী কালীমন্দির। ভিতরে প্রতিমা, যেন শৃঙ্খলিত তাঁর দু’হাত। মন্দিরের মূল গেটের উপরে বড় বড় করে লেখা ‘চৈতন্যময়ী (শৃঙ্খলিত) রাজেশ্বরী কালী, লালগোলা রাজ’। কেন শৃঙ্খলিত? স্থানীয় প্রবীণেরা কেউ বলেন রাজপরিবারের কোনও অজানা কাহিনি, কেউ পরাধীন দেশবাসীর প্রতীকী উপস্থাপনে জোর দিয়ে জুড়ে দেন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’-এর অনুষঙ্গ। মন্দিরের দেয়ালে ‘আনন্দমঠ’ হাতে বঙ্কিমের বিরাট মূর্তিতে রোজ ফুলমালাও দেওয়া হয়।

শৃঙ্খলিত কালীমূর্তির খুব কাছেই বাস করেন শিকলমুক্ত বন্দিরা। তাঁরা সাজাপ্রাপ্ত, কিন্তু কেউ যেন কয়েদি নন। রাত ৮টা থেকে সকাল ৬টা— এই ১০ ঘণ্টা বাদ দিলে তাঁরা মুক্ত, স্বাধীন, আমাদেরই মতো সাধারণ। জীবিকা-সন্ধানে যাঁদের ব্যস্ত থাকতে হয়। কেউ দিব্যি সংসার করেন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে।

Advertisement

এখানে ২০০ বন্দির থাকার ব্যবস্থা আছে। এখন বন্দি-সংখ্যা ১০২। আর আছে ২০টি ছিমছাম কটেজ। জেল-জীবনের শেষ পর্বে স্বভাব-ভাল বন্দিরা আবেদন এবং কর্তৃপক্ষের বিবেচনার নিরিখে পেতে পারেন ওই কটেজ। যেখানে তাঁরা বাস করতে পারেন সপরিবারে, বাড়ির মতো। তেমনই এক কটেজে স্বামী যখন খবরের কাগজে মগ্ন, স্ত্রী তাড়া দিচ্ছেন বাজারের— এ দৃশ্য বিরল নয় এই কারাগারে। আছে অতিথি নিবাসও। বন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে আসা স্বজন কেউ সাময়িক থাকতে পারেন সেখানে। এর জন্য দু’টি ঘর বরাদ্দ। তাই বুক করতে হয় আগেভাগে। যাঁদের বাড়ির লোকের আসার অসুবিধা অথচ বাড়ির জন্য মন কেমন করছে, তাঁরা নিজেরাই বাড়ি ঘুরে আসতে পারেন দিন পনেরোর ছুটিতে। ছ’মাস অন্তর ১৫ দিনের ছুটি (প্যারোল-এ) নিতে পারেন বন্দিরা।

যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত যে বন্দিরা এখানে থাকেন, তাঁরা প্রায় সকলেই সাধারণ জেলে কাটিয়ে এসেছেন কেউ ৮, কেউ ১০, কেউ ১৪, কেউ ১৬ বছর। কারাবাসের এই শেষ পর্ব যেন মুক্তির বাতাস ভরে দেয় তাঁদের বুকে। প্রতি দিন সকাল ছ’টায়, জেলের ভাষায়— ‘আনলক’ হন এঁরা। রাত আটটায় গুনতি করে ফের ‘লক’। সকাল ছ’টায় ছাড়া পেয়ে কেউ যদি আর না ফেরেন! প্রশ্ন করলাম দায়িত্বপ্রাপ্ত এক সিনিয়র কারাকর্মীকে। তিনি মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, ‘ধরে নিন এটা অসম্ভব। এখানে সেই সব বন্দিদেরই পাঠানো হয়, সাজাপ্রাপ্তির দিন থেকে যাঁদের ট্র্যাক রেকর্ড খুব ভাল। আর ওঁরা অনেক-অনেক দিন বিভিন্ন জেলে কাটিয়ে এসেছেন। ধরে নিতে পারেন সাজার শেষ পর্ব চলছে, এখন মুক্তির দিন গোনা। এই অবস্থায় কেউ ফের অপরাধ করে? তা হলে তো ফেঁসে যাবে! আবার কারাবাস।’

—তা হলে এঁরা সবাই খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাবেন?

—সেটাই স্বাভাবিক। তবে ব্যতিক্রমও আছে।

উনি আরও জানালেন, সাজাপ্রাপ্ত বন্দির (সশ্রমই হোক বা বিনা শ্রম) প্রথম কারাবাসের দিন থেকে তাঁর সমস্ত কর্মকাণ্ডের হিসেব রাখা হয় একটি নির্দিষ্ট নথিতে। ওকে বলে ‘হিস্ট্রি টিকেট’। এটাই বন্দির সমস্ত আচরণের রেকর্ড বুক। কম করে সাত বছর কারাজীবন যাপনের পর, বন্দির অতীত, বর্তমান, অপরাধের ধরন এবং জেলখানায় তার প্রতি-মুহূর্তের আচরণ বিচার-বিবেচনার পর, সুযোগ মেলে মুক্ত-কারায় বসবাসের।

সে দিন মুক্তকারার বিশাল সর্বজনীন কিচেন-এর পাশে দেখা মানুষটিকে প্রশ্ন করেছিলাম: এই কারাগার সম্পর্কে জানতে চাই, কার সঙ্গে কথা বলব? ‘হরেকৃষ্ণ’ বলে কথা শুরু করেছিলেন ফরসা, মুণ্ডিতমস্তক, তিলকধারী ভদ্রলোক। সাদা ধুতি আর ফতুয়া পরা মানুষটিকে ভেবেছিলাম পুরোহিতমশাই। ভুল ভাঙল কিছু ক্ষণের কথাবার্তাতেই। ১৬ বছর আগে পুরুলিয়ায় এক খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত তিনি। ১৪ বছর পুরুলিয়া জেলে কাটিয়ে, এখানে ঠাঁই পেয়েছেন বছর দুয়েক। তাঁর দিন শুরু হয় ‘প্রভাতি’ দিয়ে, তার পর তিন বার কৃষ্ণের সেবা। সারা দিন মুখে কৃষ্ণনাম। ওতেই নাকি তাঁর মুক্তির আনন্দ। বাইরে কোনও কাজ নয়, উনি মুক্তকারার অফিসেই কাজ করেন পিওনের। সেখানকার পারিশ্রমিকে চলে যায় তাঁর কৃষ্ণ-সংসার। স্কুল-শিক্ষিকা স্ত্রী, দাদা-বউদি-ভাইপো-ভাইঝিকে নিয়ে তাঁদের সংসার ছিঁড়েখুঁড়ে গিয়েছিল জমিদখলকে ঘিরে ওই খুনের মামলায়। ক্যানসারে আক্রান্ত স্ত্রীও চলে গেছেন বছর দুয়েক আগে। শ্যামসুন্দর আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছেন কৃষ্ণের।

‘চা খাবেন একটু? নতুন বানাচ্ছি।’— জেল ফটকের বাইরে তাঁর চায়ের দোকান থেকে হাঁকলেন আর এক জন। ১৭ বছর চলছে তাঁর জেলজীবনের। এখানে বছর দেড়েক। ঝকঝকে কাচের গ্লাসে চা ঢালতে ঢালতে ইশারায় বেঞ্চে বসতে বললেন। ‘তখন কি বুঝে করেছি বলুন? আজ বড় আফশোস হয়। তবে এখানে এসে বুঝলাম, এখনও বাঁচতে পারি, বাঁচার মতো। এই দোকান থেকে চলে যায়। সংসার তো করিনি। সব মানুষকেই এখন আপন মনে হয়।’ শরিকি বিবাদে একই পরিবারের তিন জনকে হত্যার ষ়ড়যন্ত্রে ছিলেন এই মানুষটি!

পাশেই চায়ের স্টল আর এক সহ-বন্দির। তাঁর শ্বশুরবাড়ি লালগোলাতেই। ‘মাঝে মাঝে যাই, দেখা করে আসি। ১৪ বছর বাড়ির বাইরে। ছেলেটা আগামী বছর মাধ্যমিক দেবে। আপনাদের আশীর্বাদ, ও পড়াশোনায় ভাল।’ তাঁর বাড়ির লোক এসেছিলেন কিছু দিন আগেই। ‘এখন তো মুক্তই, না কি বলুন! আর ক’টা দিন। এখানে এসে তবু বাঁচার স্বাদ পেলাম।’ তাঁকে প্রশ্ন করি, জেলের সহবাসীরা কেমন? তিনি বলেন, ‘হাতের পাঁচ আঙুল যেমন। সবাই তো ভাল হবে না। তবে এখানে বেশির ভাগই ভাল বলতে পারেন। অন্য জেলের মতো অত্যাচার, নেশা, মারপিট, যৌনাচার তেমন নেই। তবে নেশা যে কেউ করে না, এমনটাই বা জোর দিয়ে বলি কী করে?’ চমৎকার ওমলেট বানান তিনি। ভাজতে-ভাজতে বলেন, ‘নামটা দেবেন না, ছেলে-মেয়েদের স্কুলে সমস্যা হবে।’

এক দল তরুণ এসে ঢোকে তাঁর দোকানে। অর্ডার হয় ওমলেট, কেক, চা। ঘড়িতে তখন দেড়টা। এ বার দোকান বন্ধ করে মুক্তকারায় লাঞ্চে যাওয়ার সময় তাঁর। কিন্তু ওদের আবদার না-মিটিয়ে নড়তে পারেন না। দেরি হয় দুপুরের খাওয়ায়। বিকেলে জেলের বাগানে শ্রম দিতে হবে কিছু ক্ষণ, তার পর আবার চায়ের স্টল। সন্ধ্যায় গমগম করবে তাঁর দোকান।

টিউশন সেরে ফিরছেন মাস্টারমশাই। লালগোলায় অনেক ছাত্র এই আর্টস টিচারের। বীরভূম থেকে বহরমপুর, ১৩ বছর জেল-জীবন কাটিয়ে এখন তিনি বাসিন্দা এখানে। এই মাস্টারমশাই মনে করিয়ে দেবেন আর এক শিক্ষকের কথা। তাঁর কাছে অংক শিখে মাধ্যমিক উতরেছে লালগোলার প্রচুর ছাত্র। উত্তর ২৪ পরগনাবাসী সেই স্যর দু’দশক আগে অপরাধে জড়িয়ে পড়েন প্রাইভেট টিউশন করতে গিয়েই। এক ছাত্রীর প্রেমে পড়ে তার বাড়ির সকলকে খুন করেছিলেন তিনি, ছাত্রীর সহযোগিতায়। রাজসাক্ষী হয়েছিলেন ছাত্রী। স্যরের কারাবাসের শেষ পর্ব কেটেছিল এখানে, ছাত্র পড়িয়েই। লালগোলার ছাত্র-অভিভাবক সমাজ এখনও তাঁকে শ্রদ্ধা করেন। তিনি রিলিজ হয়েছেন কিছু কাল আগে। ফিরে গিয়েছেন নিজের বাড়িতে। লালগোলাবাসী জানেন তাঁর শারীরিক অসুস্থতার খবর। তাঁরা দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন এই প্রবীণ শিক্ষকের।

ছাত্রছাত্রী বা অভিভাবকদের মনে কোনও দ্বিধা কাজ করে না এক জন সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীকে শিক্ষক হিসেবে মেনে নিতে? আর্টস শিক্ষকের হয়ে জবাব দেন এক কারাকর্মী— ‘সত্যি বলতে কী, দ্বিধাটা ওঁরই ছিল, এখানকার মানুষ তা দূর করে দিয়েছেন। তা ছাড়া উনি পড়ানও দারুণ। সবাই তো ভাল রেজাল্ট করছে!’

সূর্য আস্তে আস্তে পশ্চিমে ঢলে পড়ছে, চার দিকের গাছগুলোয় ফিরে আসছে পাখিরা, তাদের নিজস্ব নীড়ে। গুনগুনিয়ে কৃষ্ণনাম কণ্ঠে জেলের ফটক পেরিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসছেন সেই ভদ্রলোক। তিনি চললেন কীর্তন শুনতে। ভাল দলের পালা আছে। ‘জয় রাধে’ বলে তাঁকে বিদায় জানালেন এক সহকর্মী।

ফিরবেন একটু বেশি রাতে। ‘অনেকটা দূর তো! জেল সুপার স্যর পারমিশন দিয়েছেন, রাত সাড়ে ন’টা পর্যন্ত।’ গোল্ডেন ফ্রেমের গোল চশমার ও-পারে তাঁর চোখে তখন আচ্ছন্ন হয়ে আছে যুগপৎ মুক্তি ও মায়া।

একটু আগেই এক আধিকারিক বলছিলেন, ‘এটা তো জেল নয়। প্রকৃত অর্থেই সংশোধনাগার। বন্দিদের সমাজের মূল স্রোতে ফেরানোই এর কাজ।’ কিছু অভিযোগ-অনুযোগ থাকলেও, সেই কাজে নিরলস দেশের প্রথম এই মুক্ত সংশোধনাগার। যাকে মডেল করে এগোচ্ছে আরও অনেক জেলা।

রাত নামছে মুক্তকারায়। এ বার কাউন্টিং। ‘লক’। রেজিস্টার ভরে উঠছে সই-স্বাক্ষরে। ডিনার শেষে ঘরের ভেতরে এ বার কেউ মেতে উঠবেন সহবাসীর সঙ্গে গল্প-গানে-আড্ডায়। কেউ একা, দিন গুনবেন চূড়ান্ত মুক্তির। বা, পর দিন সকালে ফের ‘আনলক’ হওয়ার।

bengdbcu@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement