আমরা তখন মেডিকালে থার্ড ইয়ারে উঠেছি। প্রথম দিন। গল ব্লাডারে পাথর নিয়ে মাঝবয়সি রোগিণী নিজের বেডে বসে আছেন। আমরা চারপাশে দাঁড়িয়ে হিস্ট্রি নিচ্ছি রোগ আর রোগিণীর। হঠাৎ ‘গেল গেল’ সমবেত হাহাকার, আর তার পরেই ঝপাস। আমাদের বন্ধু পল্টু, গল ব্লাডারের পাথরের ভারেই বোধহয়, মুচ্ছো গেছে। হাসপাতালের ওয়ার্ডে প্রথম দিন, এত রোগী, ওষুধের বিকট গন্ধ, ইঞ্জেকশন— এত কিছু একসঙ্গে বেচারি নিতে পারেনি। আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই চ্যাপ্টার তো আমাদের এখনও পড়ানোই হয়নি। কাকে ডাকব, সিনিয়রদের, না কি সিস্টারকে— সাত-পাঁচ ভাবছি। কিছু স্মার্ট ছাত্র সঙ্গের বইপত্র ঘাঁটছে, পল্টুকে নিয়ে কিছু লেখা আছে কি না খুঁজছে। তখন তো মোবাইল আর গুগ্ল ছিল না।
এ সব ডামাডোলের মধ্যেই আমাদের রোগিণী তড়াক করে এক লাফে বেড থেকে নেমে পড়লেন। সুঠাম পেটানো গ্রাম্য শরীরে ৪৫ কেজির পল্টুকে অবলীলায় পাঁজাকোলা করে তুলে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিলেন। চোখে-মুখে জল ছিটিয়ে দিয়ে মাথায় হাওয়া করতে থাকলেন। খানিক বাদে পল্টু চোখ খুলে তাকাল। অবশ্য ফিল্মি কায়দায় ‘আমি কোথায়’ বলার সুযোগ পেল না, তার আগেই রোগিণী গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞাসা করলেন— ‘কেমন আছেন এখন ডাক্তারবাবু?’
এ তো সেই— বাড়িতে পুলিশ পড়েছে, ডাকাতে খবর দাও-এর মতো দেখছি! এর পর রোগিণী আমাদের মৃদু বকাঝকা করলেন, আমরা কেন এত নার্ভাস। উদ্বিগ্ন হলেন, এত কম বুদ্ধি নিয়ে আমরা কী করে ডাক্তার হব। পরামর্শ দিলেন, ভাল করে লেখাপড়়া করার। সমবেত থার্ড ইয়ার স্টুডেন্টদের সামনে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। বিষয়: এমন পরিস্থিতিতে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সব ক্লাসেই দু-এক জন নোটপ্রেমিক থাকে। তারা মাথা নিচু করে শনশন স্পিডে নোট নিতে শুরু করল। তার পর থেকেই কারও গল ব্লাডারে পাথর হয়েছে শুনলে পল্টু কেমন উদাস হয়ে যেত।
পেশেন্টের রোগের হিস্ট্রি নিতে পল্টু ভয়ানক মেথডিকাল ছিল। কিছু কিছু রোগে রোগীর ফ্যামিলি হিস্ট্রি খুব জরুরি। বাড়িতে কারও আছে কি না, যেমন— টিবি, ডায়াবিটিস। এক বার এক জন এসেছে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে। নিষ্ঠাবান পল্টু কোনও ঘাটতি রাখতে চায়নি কেস-হিস্ট্রিতে। —আপনার বাড়িতে কেউ কোনও দিন গাছ থেকে পড়েছে?
ক’দিন পরে আউটডোরে এক জন এসেছে পায়ে ব্যথা নিয়ে। ডাক্তার যথারীতি আমাদের পল্টু। (পল্টু এখন ভীষণ নামকরা ডাক্তার, তাই ডাকনামটাই এখানে দিলাম।) বিস্তর পা টেপাটিপি করেও বুঝল না, ব্যথা ঠিক কোথায়। টোটালি কনফিউজড, জিজ্ঞাসা করল— টিপছি, আপনার লাগছে না?
উত্তর এল— লাগছে।
তা বলছেন না কেন?
উত্তরদাতা এ বার দার্শনিক। লাগছে, কিন্তু সহ্য করছি।
এমন মানসিক ঔদার্য অবশ্য সবার থাকে না। সে বার এক জন ইমার্জেন্সিতে এসেছেন পায়ে কাটাকুটি নিয়ে। সেলাই করবে পল্টু। সব ব্যবস্থা করে আমাকে ডাকল। রোগীর সামনেই একটু লজ্জিত হাসি হেসে বলল— ভাই, তুই একটু থাক আমার সঙ্গে, খুব টেনশন হচ্ছে।
বললাম, কেন?
এটা আমার জীবনের প্রথম সেলাই কিনা, তাই।
দুঃখের বিষয়, ওটা হাসপাতাল ছিল, চার্চ নয়। আর রোগী ভয়ানক সাংসারিক সাধারণ মানুষই ছিলেন, চার্চের ফাদার না। সুতরাং, পল্টুর কনফেশন যোগ্য মর্যাদা পেল না। সুচ-সুতো পল্টুর হাতেই রইল। ভদ্রলোক পল্টু, সরকারি হাসপাতাল, মানুষের উপর বিশ্বাস— সব কিছুকে তুলোধোনা করে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে পালালেন।
সেলাই-জীবনের এমন মর্মান্তিক শুরুর প্রভাব হল সুদূরপ্রসারী। পাশ করার পরের কথা। একটি বারো-তেরো বছরের ফুটফুটে মেয়ে বাবার সঙ্গে এসেছিল। কপালে কী ভাবে যেন কেটে গিয়েছিল। বিশ্রী ভাবে কেটেছিল ঠিকই, কিন্তু পল্টুর সেলাই আরও বিশ্রী হয়েছিল। মেয়ের কপাল জুড়ে এমন শিল্পের বহর দেখে ভদ্রলোক একটু মনঃক্ষুণ্ণই হলেন। অনুযোগের সুরে বললেন, মেয়ের কপালটা যা করে দিলেন ডাক্তারবাবু, বিয়ে দেব কী করে? পল্টুর গলা বুজে এল। চোখ ছলছল করে উঠল। ধরা গলায় বলল— সামান্য একটা দাগ, তার জন্য এত বড় কথা! মেয়ে কি এতই ফেলনা? আপনার মেয়েকে আমাকে দিন। বাড়ি নিয়ে যাব, ডাল-ভাত খাইয়ে বড় করব, আমিই এর বিয়ে দেব। আজ থেকে ও আমার মেয়ে। ২৩ বছর বয়সি পল্টুর উচ্চাকাঙ্ক্ষায় আমরা চমৎকৃত।
দশ মিনিট পরে দেখি, বাবা-মেয়ে-পল্টু তিন জনেই হাউহাউ করে কাঁদছে। মেয়েটি অবশ্য অচিরেই থেমে গেল, অনাগত বিয়ের কথা ভেবে, না পল্টুর নোংরা অ্যাপ্রনের উৎকট গন্ধে, জানি না। তবে বাবা আর পল্টুর সেই উদো-বুধোর কান্না থামাতে আমাদের বিস্তর বেগ পেতে হয়েছিল।
saikatortho@gmail.com