মানুষের আদিম ভবিষ্যৎ

একেবারে শুরুতে পরদা জুড়ে পাশাপাশি কাঁপা-কাঁপা লাল ও নীল দুটো গ্রাফ পৃথিবীর জনসংখ্যার সঙ্গে তেল উৎপাদন বৃদ্ধির অনুপাত বোঝাতে বোঝাতে মিলিয়ে যায়। মানুষের ‘সভ্য’ থাকার দায়টাও কি সেই সঙ্গেই ফুরিয়ে আসে? পরিচালক আমাদের নিয়ে যান ভবিষ্যতের একটা পৃথিবীতে। সেখানে ফসল আর প্রায় ফলেই না (বা বেশির ভাগ লোকই ফসল ফলাতে ভুলে গেছে)!

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৬ ০০:০৩
Share:

একেবারে শুরুতে পরদা জুড়ে পাশাপাশি কাঁপা-কাঁপা লাল ও নীল দুটো গ্রাফ পৃথিবীর জনসংখ্যার সঙ্গে তেল উৎপাদন বৃদ্ধির অনুপাত বোঝাতে বোঝাতে মিলিয়ে যায়। মানুষের ‘সভ্য’ থাকার দায়টাও কি সেই সঙ্গেই ফুরিয়ে আসে? পরিচালক আমাদের নিয়ে যান ভবিষ্যতের একটা পৃথিবীতে। সেখানে ফসল আর প্রায় ফলেই না (বা বেশির ভাগ লোকই ফসল ফলাতে ভুলে গেছে)! অনাহারটাই অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবারের দাম জীবনের চেয়েও বেশি।

Advertisement

এক দিন, অনামা নায়কের কেঠো কুঁড়েঘরের আঙিনায় হঠাৎ দুই অনাহূত নারী। পুরনো দোনলা বন্দুকটা বাগিয়ে সে তাদের মুখোমুখি হয়। ক্যাথরিন ও মিল্জা। মিল্জা ক্যাথরিনের মেয়ে। এরা খাবার ও আশ্রয় চায়। তার দাম হিসেবে ক্যাথরিন প্রথমে গয়নাগাটি, তার পর শস্যের বীজ, শেষ অবধি মিল্জার শরীর অবধি টোপ দেয়। নিঃসঙ্গ লোকটার উপোসি বাসনা আনচান করে ওঠে। সে বন্দুকটা উঁচিয়েই রাখে, কিন্তু ওদের ঘরে ঢুকতে দেয়।

চরিত্রগুলোর অতীত নিয়ে পরিচালক প্রায় কিছুই বলেন না। নায়কের অতীতের চিহ্ন বলতে একটা হারমোনিকা, যেটাতে সে মাঝে মাঝে বেসুরো ফুঁ দেয়। আবার সেটাকে জঙ্গলে ছুড়ে ফেলেও দেয়। আর একটা মেয়ের জীর্ণ হয়ে আসা রঙিন ছবি— যেটা সামনে রেখে সে হস্তমৈথুন করে, আবার ছবিটাকে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফায়ারপ্লেসের আগুনে গুঁজেও দেয়। ক্যাথরিন ও মিল্জারও ফ্ল্যাশব্যাকের কোনও বালাই নেই। ভবিষ্যতের পৃথিবীর এই তিনটি চরিত্রকে বর্তমানের গণ্ডিতেই আটকে রাখা হয়, যে ‘বর্তমান’টা আবার মানুষের আদিম অতীতের খুব কাছাকাছি। সেখানে রোজকার বেঁচে থাকার উপকরণগুলো খুবই সামান্য। নিজের জমিতে যেটুকু সবজি ফলাচ্ছে, বনজঙ্গল থেকে যা মাশরুম-টাশরুম তুলে আনছে, তাই দিয়েই পেট ভরাতে হয়। কোনও দিন পাখি বা খরগোশ শিকার করলে মহাভোজ! মিল্জাকে একটাই স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রতি মাসে কেচে ধুয়ে শুকিয়ে রাখতে হয়।

Advertisement

এই উপকরণগুলো নিজের দখলে আনা বা রাখার জন্য তিন জনের মধ্যেই শুরু হয় ক্ষমতার যুদ্ধ। অদ্ভুত সে পরিস্থিতিতে ক্যাথরিন লোকটাকে খুন করতে চায়। ও দিকে মিল্জা প্রথম বার সঙ্গমের পর থেকেই লোকটার সুবিধের দিকে যতটা সম্ভব খেয়াল রাখে। লোকটা কিন্তু সম্পর্কের ব্যাপারে এখনও দ্বিধায়। সে দুজনকেই সন্দেহ করে। মিল্জা যখন ছুরিটা দিয়ে সোহাগ করে তার দাড়ি কামিয়ে দেয়, লোকটা তখনও বন্দুকের নলটা মেয়েটির পেটের কাছে ঠেকিয়েই রাখে, ‘আদিম ভবিষ্যৎ’ এর পৃথিবীতে বাঁচতে গেলে ভালবাসাকেও বিশ্বাস করা চলবে না!

প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের, আবার মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের একটা আশ্চর্য টানাপড়েন বোনা হয় ছবিতে। চার পাশের অরণ্য কী নিবিড়, নিষ্পাপ, সবুজ! আর মানুষের বেঁচে থাকার অঙ্কটা ঘেন্না আর সন্দেহে চোবানো কি চাপ চাপ কালো! ফসলের বীজ বুনতে বুনতেও এক জন অন্যকে খুন করার কথা ভাবে— নিজেও খুন হয়ে যাওয়ার ভয় পায়। তার পরেও লোকটা নিজে সাংঘাতিক আহত হয়েও মিল্জাকে ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচায়। আবার লোকটার শরীরে যখন মৃত্যুর হিম ছেয়ে আসছে, তখন মিল্জার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাথরিনও তার নগ্ন দেহের তাপ দিয়ে তার জীবন ফেরায়।

কিন্তু এই প্রাগৈতিহাসিক জীবনের যুদ্ধে শেষ অবধি কে টিকে থাকে? সেই থ্রিলারের উত্তরটা ঊহ্য থাক, আমরা বরং মুগ্ধ থাকি পরিচালকের স্টাইল-এ, যেখানে চরিত্রগুলোর ন্যাড়া বেঁচে থাকাটার মতোই, সংলাপও ন্যূনতম। কোনও বাজনা নেই। সাউন্ডট্র্যাক ভরে আছে হাওয়া, বৃষ্টি, গাছের পাতা, নিশ্বাসের শব্দে। চরিত্রগুলোর মুখেও শঙ্কা আর সংশয় ছাড়া কোনও অভিব্যক্তি নেই। গোটা ছবিতে কেউ এক বারও হাসে না। শেষ দৃশ্যে মিল্জার একটুখানি ফুঁপিয়ে ওঠা ছাড়া কেউ কাঁদেও না। মানবিকতার লক্ষণের অদৃশ্য গ্রাফগুলোও কি কাঁপতে কাঁপতে মিলিয়ে যায়?

sanajkol@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement