সে অধ্যাপক। সে অ্যাকটিভিস্ট। সে ছোট শহরের, মাঝারি কলেজের দর্শন বিভাগের রকস্টার। ক্লাসঘরের গোমড়া, গুমোট অন্দরে সে নাকি ভায়াগ্রা-সম উত্তেজনা নিয়ে আসতে পারে। কলেজের অধ্যাপিকা থেকে ছাত্রী— সব্বাই পটাপট তার প্রেমে পড়ে যায়। আর সে, এব্ লুকাস, এক ক্লিনিকাল, দার্শনিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে সেই সব আদিখ্যেতা উপভোগ করে। অন্তত করত। কিন্তু জিল বলে ওই ছাত্রীটি যখন তার জীবনের খুব কাছ ঘেঁষে এল, এব্ তখন একটা অদ্ভুত খিটকেল সংকটের মরুভূমিতে প্রাণপণে ওয়েসিস খুঁজে চলেছে। আর জিল তার গোপাল-গোপাল সুবোধ বালক-সুলভ প্রায় গৃহপালিত ‘স্টেডি’ বয়ফ্রেন্ড রয়-কে ছেড়ে সেই মরূদ্যান হতে চাইছে।
বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক এব্-এর সমস্যাটাও রীতিমত তাত্ত্বিক-গোছের। কিছু দিন হল সে তার বেঁচে থাকা, তার অস্তিত্বের কোনও মানে খুঁজে পাচ্ছে না। তার সৃষ্টিসত্তাও এই জাঁতাকলে ঘাড় আটকে ঝুলে আছে। এই ঝঞ্ঝাটে সে সঙ্গম অবধি জমিয়ে করতে পারছে না। লেখালিখি তো দূর অস্ত্। লিবিডোর এই দুচ্ছাই অবস্থায় সে জিলের সঙ্গে সম্পর্কটা যতই একটু গপ্পগুজব, একসঙ্গে দু-চারটে সিনেমা দেখা, পিয়ানো শোনায় আটকে রাখতে চাইছে, জিল ততই সেটাকে বিছানা অবধি নিয়ে যেতে মরিয়া। এব্ জিলকে বোঝায়, রয়ের মতো একটা মিষ্টি প্রেমিককে ছেড়ে, তার মতো একটা আধবুড়ো, অক্ষম আঁতেলের কাছে আসাটা ভুল। কিন্তু জিলের পণ, সে-ই এব্-এর চেতনার খরা কাটিয়ে, তাকে সৃষ্টিসুখের উল্লাসে ভরিয়ে তুলবে। আর তখনই এক রাত্তিরে এক রেস্তরাঁর পেছনের টেবিলের কিছু সংলাপ তাদের কানে আসে। বিবাহ-বিচ্ছেদের এক মামলায় জনৈক জজসাহেবের একচোখোমির জন্য এক দুঃখিনী নারী কিছুতেই তার সন্তানদের অধিকার পাচ্ছে না।
এব্ দেখল, হতাশায় থেবড়ে যাওয়া তার জীবনকে অর্থবহ করার এটাই পরম লগন। সে ঠিক করে ফেলে, একপেশে রায় দেওয়া ওই ‘নীতিহীন’ বিচারপতিকে খুন করে সে ‘সামাজিক ন্যায়’ করবে। তা হলে ওই মহিলা ঠিকঠাক বিচার পাবে, পৃথিবীর উপকার হবে। আর এটা ভেবে ফেলার পরই এব্ দেখল তার মনটা বেশ খুশি-খুশি আর লিবিডো চাঙ্গা হয়ে উঠছে। ছবিটাও এখান থেকেই একটা ছদ্ম-থ্রিলারের ধরন নেয়। এব্ তার বুদ্ধি-মেধা-শিক্ষা দিয়ে যে নিপুণ, ‘নিখুঁত খুন’-এর ছক সাজায়, তার ‘নান্দনিক সৃষ্টিশীলতা’ দেখে সে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যায়। এবং খুনটা করে ফেলার পর তার ‘অস্তিত্বের সংকট’ পুরোটাই ঘুচে যায়। লেখাপড়ায় ফুর্তি, খাদ্য-পানীয়তে রুচি, যৌন-বাসনা— সব আগের মতো হয়ে যায়। যে এব্ জিলকে চুমু অবধি খেতে দিচ্ছিল না, সে-ই জিলের সঙ্গে বিছানায় প্রেমের জোয়ারে ভাসে!
এখানেই কহানি মে আবার একটা মোচড়। নিখুঁত শিল্পকর্মের মতো যে খুনটা একটু আগেও নিশ্ছিদ্র মনে হচ্ছিল, জিলের মতো একটা পুচকে মেয়েই তার ফুটো-ফাটা ফাঁক-ফোকর খুঁজে এব্-কে বেআব্রু করে ফেলে। ও দিকে পুলিশও তত দিনে অন্য এক জনকে অভিযুক্ত খাড়া করে মামলা সাজাতে নেমে পড়েছে। এব্ আবার একটা নৈতিকতার প্রশ্নের মুখোমুখি। এক জন নির্দোষ মানুষকে বাঁচাতে, জিলের চাহিদা-মাফিক এব্ কি পুলিশের কাছে ধরা দেবে? না, তার সদ্য-খুঁজে-পাওয়া জীবন আর অস্তিবাদী সুখটুখ-সুদ্ধ ইউরোপে পালাবে? পরিচালক তাঁর স্বভাবসিদ্ধ তিতকুটে, তেরচা, কালো-কমেডির ঢঙেই এখানে যুক্তি-ন্যায়-নীতি, এ সব দার্শনিক কূট প্রশ্নগুলো নাড়াচাড়া করেছেন। থ্রিলার এখানে তাঁর ছল। তাঁর আসল অস্ত্র সংলাপ এবং অনেক সময় মোনোলগ। চরিত্ররা এক জন, আর এক জনের সঙ্গে, আবার নিজেরা নিজেদের সঙ্গে তর্ক করতে করতেই দর্শকের সঙ্গেও তর্ক জুড়ে দেয়। একদম ক্লাইম্যাক্সে খানিকটা ‘ন্যায়বিচার’ বা পোয়েটিক জাস্টিস-এর তাড়নাতেই এক টুকরো ধস্তাধস্তি, অ্যাকশন আসে। তবে ছবির থ্রিলার-বেশকে খাতির করেই সেটুকু নয় ঊহ্যই রইল!
sanajkol@gmail.com
ভারতের সংবিধান থেকে শতাব্দী-প্রাচীন ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হল। বদলে ঢুকল ‘জোরতন্ত্র’ শব্দটি। ফলে, বহু দাবিদাওয়ার শেষে দেশে ‘জোর যার মুলুক তার’ নীতিটি প্রতিষ্ঠা পেল। যাদের কবজির জোর আছে, এখন থেকে তারাই দেশের নানা অঞ্চলের শাসনভার ছিনিয়ে নেবে। লোকসভায় সংবিধান সংশোধনের বিলটি পাশ হওয়া মাত্র সদস্যরা একে অপরের মাথায় তবলা বাজিয়ে নিজেদের আনন্দ প্রকাশ করেন। এই বিলে, নাগরিকদের ভোটদানের অধিকারটিও বাতিল করে দেওয়া হল। পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী, দাঙ্গাবাজ, মারকুটেরাই একমাত্র ভোট দিতে পারবেন। নির্দেশে বলা হল, বুথে বোমাবাজি, গোলাগুলি, ভয় দেখানো বা শাসানোকে আর খাতায়-কলমেও অপরাধ বলে ধরা হবে না। বরং যে দল বুথে এই বিষয়ে বেশি পারদর্শিতা দেখাবে, নির্বাচন কমিশনার তাদের পক্ষ নিয়েই কাজ করবেন। এই ঘোষণার পর পাড়ায় পাড়ায় গুন্ডারা তাদের গোপন আস্তানা থেকে পেটো বোমা বার করে এনে রাস্তায় সবার সামনে ফাটাতে থাকে। বোমার একটি টুকরো উড়ে এসে এক কিশোরের চোখে ঢুকে যায় ও সে রক্তাক্ত অবস্থায় আর্তনাদ করতে থাকে। কিন্তু তত ক্ষণে মস্তানরা পিস্তল ও ভোজালি উঁচিয়ে উল্লাসমিছিল বের করেছে, ফলে ছেলেটির দিকে কেউ এগিয়ে আসতে সাহস পায়নি। মিডিয়া মিছিল কভার করতে এলে মদ্যপরা ক্যামেরার সামনে বিকট অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে থাকে। নেতারা সাক্ষাৎকারে জনতার উদ্দেশে বলেন, নিজেদের ধনসম্পদ ব্যাংকের বদলে পার্টি ফান্ডে জমা রাখতে। কারণ, এখন থেকে তা ‘দেখভাল’ করবেন তাঁরা। দেশে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। বিল স্থগিত রাখার আর্জি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন কিছু বিশিষ্টজন। শেষ রাত্রে পাওয়া খবরে, প্রধানমন্ত্রীর ঘুম ভাঙানোর অপরাধে তাঁদের রড দিয়ে পিটিয়ে বের করে গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা: টাইম মেশিন,
রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।
অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in