পিনাকী ভট্টাচার্য
মানুষ খাবার তৈরি করতে শুরু করে প্রথম দিকেই দই বানিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু বানাল কী ভাবে? এক দল বলে, মানুষ যখন খাবার সংরক্ষণ করতে শুরু করল, তারা উদ্বৃত্ত দুধ রেখেছিল শিকার করা কোনও পশুর অন্ত্রে। কিছু সময়ের মধ্যে দেখা গেল, অন্ত্রে থেকে যাওয়া কিছু এনজাইমের প্রকোপে দুধ কেটে গেল, স্বাদও বদলে গেল তার। একটা টক ভাব এল। সেই সময়ের মানুষজনের বেশ পছন্দ হল এই স্বাদ। খেয়ে দেখা গেল, শরীর তো খারাপ হয়ই না, বরং এই নতুন খাবার খেয়ে স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছে।
আর এক মত হল, সেই আদ্যিকালে পশু শিকার করে তাকে কাটতে গিয়ে মানুষ দেখতে পেল পশুদের খাওয়া দুধ পেটে গিয়ে আর দুধ থাকে না, কিছু বদল আসে তাতে। সেটা চেখে দেখল খারাপ নয়, টক টক খেতে। তখন থেকে শিকার করে পশুর পেটে থাকা দুধটা আলাদা করে নিয়ে খেত তারা। এ ভাবেই দইয়ের সঙ্গে মানুষের পরিচয়।
দই মধ্য এশিয়া থেকে পশ্চিম এশিয়া হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। কাস্পিয়ান সাগরের উপকূলবর্তী এলাকা থেকে আর্যদের হাত ধরে দই এ দেশে পৌঁছল, আর আর্যদের প্রিয় খাবার বলে ভারতে কৌলীন্য পেয়ে গেল চটপট।
পারস্য দেশের লোককথা বলে, নিয়মিত দই খেতেন বলেই আব্রাহামের ঝকঝকে স্বাস্থ্য ছিল। দই ছিল তুর্কিদের ভারী প্রিয় খাবার, বিশেষ করে সেখানকার যাযাবর গোষ্ঠী শরীর ভাল রাখতে দইকে ভীষণ বিশ্বাস করত। হাজার বছর আগের তুর্কি সাহিত্যে, মামুদ আল-কাশগারি থেকে ইউসুফ হাজিব— সবার লেখাতেই দইয়ের কথা ঘুরেফিরে আসে। ওই একই সময় এশিয়ার অন্য প্রান্তে দই চেঙ্গিজ খানের প্রিয় খাবার ছিল। মোঙ্গলদের সমাজে ঘোড়ার দুধ থেকে তৈরি দই ‘কুমিস্’ খুব জনপ্রিয় ছিল, আর মোঙ্গল সেনাবাহিনীর কাছে সেটা খাওয়া ছিল প্রায় আবশ্যিক। মোঙ্গল যুদ্ধবাজরা রণক্ষেত্রে আলাদা করে ঘোড়ার পাল নিয়ে যেত, যাতে কুমিস্-এর সরবরাহে ভাটা না পড়ে।
ইউরোপে দই কিন্তু দীর্ঘ দিন আলো-আঁধারিতে থেকেছে। রোমের দার্শনিক প্রথম প্লিনি দুধকে ঘন করে তাকে টক বানিয়ে খাওয়াকে পূর্ব গোলার্ধের কিছু দেশের বর্বরতা বলে উল্লেখ করেছেন। এ দিকে সেই সময়েই পাশের দেশ গ্রিসে, লোকে ‘অক্সিগালা’ নামের এক রকম দইয়ের পদ খাচ্ছে তরিবত করে। গ্যালেন, যিনি প্রায় প্লিনিরই সমসাময়িক, অক্সিগালার সঙ্গে মধু মিশিয়ে খাওয়ার কথা তাঁর বইতে লিখেছেন। এ ভাবে আজও গ্রিকরা দই খায়।
মধ্যযুগে দইয়ের ইউরোপীয় হেঁশেলে ঢোকার গপ্পটা বেশ গোলমেলে। কারণ তাতে পেটের গন্ডগোলের এক বড় ভূমিকা আছে। ১৫৪২ সালে ফ্রান্সের সম্রাট প্রথম ফ্রান্সিস ডায়েরিয়াতে সাংঘাতিক কাবু হয়ে পড়েন। দেশের সব বদ্যি হার মানে। বিশ্বের খাদ্য-রাজধানী ফ্রান্সে সে এক ভীষণ অবস্থা। রাজার যেখানে এ রকম অসুখ, প্রজারা কী করে ভালমন্দ খাবার খাবে! সারা ইউরোপ যখন ফ্রান্সের সম্রাটের নামে সিন্নি চড়াচ্ছে, সেই সময় রক্ষাকর্তা হিসেবে উপস্থিত হলেন এক ডাক্তার। তাঁকে পাঠিয়েছেন প্রথম ফ্রান্সিসের প্রাণের বন্ধু, অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান সুলেমান দ্য ম্যাগ্নিফিসেন্ট। ডাক্তারের হাতে দই। সেই খেয়ে এক্কেবারে ম্যাজিক— রাজার পেটের গোলমাল গেল বিলকুল সেরে। পুলকিত সম্রাট ফরমান দিলেন দেশবাসীকে বেশি বেশি করে দই খাওয়ার। আস্তে আস্তে শুধু পথ্য হিসেবেই নয়, খাবার হিসেবেও সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ল সুস্বাদু সুস্বাস্থ্যকর দই।
pinakee.bhattacharya@gmail.com
সোনার শিলনোড়া আর পইতার গুল্প
১৯৭৫-এর মাঝামাঝি। জরুরি অবস্থার ভরা জোয়ার চলছে। আশৈশব সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে পড়া এশিয়ার বৃহত্তম রেল ইঞ্জিন কারখানায় কেরানির চাকরি পেলাম। লোভনীয় বইকী! রেলমন্ত্রী আসছেন কারখানা পরিদর্শনে, দেখার খুব ইচ্ছে। ভৌমিকদা বললেন, ‘যেও না, নতুন চাকরি তোমার। আমি দেখে এসে বলব।’ ঢাকঢোল বাজিয়ে মন্ত্রী বিদায় নিলেন, আর মাছির মতো উড়ে এলেন ভৌমিকদা: ‘আরে আমাদের মতোই হাত-পা’ওলা মানুষ, দেখার কিছু নেই।’
সেই দেখার শুরু। নাটকে আগ্রহ ছিল। পরিচয় হল চ্যাটার্জিদার সঙ্গে। কাজের চেয়ে কথায় দড় মানুষ। আমতায় ওঁর চার তলা বাড়ি, তার উচ্চতা বোঝাতে বলতেন, ‘ঘাড় উঁচু করে তাকালে নতুন বউয়ের ঘোমটা খসে যায়।’ চ্যাটার্জিদার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন দাসবাবু। তাঁর রচিত দু’একটা নাটকের বই বেশ জনপ্রিয় ছিল। গুল্পে (মানে গুল+গল্পে) অনন্য। এক দিন রিহার্সালে জলদি পৌঁছে গেছি, দাসবাবু ছাড়া কেউ নেই। কথায় কথায় স্তানিস্লাভস্কির বন্দনা করে বললেন, ‘জানো ভাই, এই যে তরুণ অপেরার ‘মহেঞ্জোদারো’ হিট যাত্রাপালা, এটা আমারই রচনা।’ টলে গেলাম। আসল পালাকার শম্ভু বাগকে কোনও দিন দেখিনি, তবে দাসবাবুর ছাড়া এক মুখ বিড়ির ধোঁয়ায় তাঁর করুণ মুখটা স্পষ্ট ফুটে উঠল।
এঁদের সবাইকে পকেটে পুরে রাখতেন আচার্যিদা। প্রথমে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি, পরে মার্ক্সবাদী, অন্তিমে নকশাল মতাদর্শে সাময়িক আস্থা স্থাপন। সাই়ড বিজনেস বউয়ের নামে জীবনবিমার এজেন্সি। আচার্যিদার টার্গেট ছিল নকশাল আদর্শে বিশ্বাসী অবিবাহিত তরুণ ছেলেরা। প্রথমে ওঁদের বিপ্লবে অনুপ্রাণিত করতেন। পরে সময় বুঝে বলতেন, ‘সশস্ত্র সংগ্রামে মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু পরিবারকে জলে না ভাসিয়ে, একটা মোটা টাকার জীবনবিমা করালে দু’কূলই বজায় থাকে, তাই না বাবা?’
ভুবনদা আর শীতলদা, দুজনেই পিওন। দুই পরিবারের গৃহিণীর মধ্যে ছিল প্রচণ্ড রেষারেষি। ভাগ্যক্রমে শেষ বয়সে অফিসের পরীক্ষায় পাশ করে ভুবনদা কেরানি হয়ে গেলেন। শীতলদার স্ত্রী রাগে অপমানে পাগলপ্রায়। শীতের এক দুপুরে পাড়ার বউদের সঙ্গে হাতে উলকাঁটা নিয়ে শীতলদার বউ রোদ পোয়াচ্ছেন। সামনের রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় চেন স্মোকার ভুবনদা কাশি চাপতে পারলেন না। শুনে শীতলদার বউ ঝনঝন করে উঠলেন, ‘কেরানি হয়েছে তো, অফিসে কাশার সময় পায় না। পাড়ার লোককে শোনাচ্ছে!’
ভুবনদা কেরানি হয়েছেন। মাইনে বেড়েছে, স্টেটাসও। ভোটের ডিউটিতে অফিস থেকে অনেকের নাম পাঠানো হয়ে গেছে। ভুবনদা তখন পিওন ছিলেন, তাই ওঁর নাম পাঠানো হয়নি। এক রোববার স্থানীয় সিনেমা হল-এ আমাদের ট্রেনিংয়ের তোড়জোড় চলছে। বিডিও, এসডিও আছেন, হই-হট্টগোলে হরি ঘোষের গোয়ালের দশা। হঠাৎ ছন্দপতন। স্টেজের ওপর দাঁড়িয়ে ভুবনদা চিৎকার করে সরকারি অফিসারদের প্রশ্ন করছেন, ‘ট্রেনিংয়ে আমার নাম নেই কেন? আমি তো ক্লার্ক হয়ে গেছি!’ সবাই চুপ।
ছবি: মণীশ মৈত্র
বিডিও সাহেব তো হাতে চাঁদ পেলেন। সবাই যখন নাম কাটাতে মিথ্যে ছুতোয় ব্যস্ত, তখন এ রকম ভোটপ্রেমিক পাওয়া তো ভাগ্যের! পুরস্কার স্বরূপ সবার প্রথমে ভোটের টাকা দেওয়া হল ভুবনদাকেই। শীতলদা সেই শোকে তিন দিন মেডিকেল লিভ নিলেন।
১৯৫০-এ রেল ইঞ্জিন কারখানা তৈরির সময় ও-পার বাংলার বহু মানুষ জীবিকার টানে আমাদের অফিসে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁরা কথায় কথায় বলতেন, ‘হ্যারে চাকরি কয়? দ্যাশে আমাগো তিনখান অট্টালিকা, পঁচিশডা নারিকেল, দশডা সুপারি গাছ আর ছয়খান পুষ্করিণী আছে।’ এ-পার বাংলার লোক আমি, অপার বিস্ময়ে সেই নাথদা, বিশ্বাসকাকুদের মুখের দিকে দেখতাম। বিশ্বাসকাকু যোগ করতেন, ‘আর কয় বৎসর, তার পর রিটায়ার কইর্যা এই চাকুরির মুখে লাথ্থি মাইর্যা দ্যাশে চইল্যা যামু।’ বাবা অকালে মারা যাওয়ায় আমি চাকরিটা পেয়েছিলাম। বিশ্বাসকাকুদের ‘দ্যাশের গল্প’ শুনে বাবাকে ক্ষমা করতে পারলাম না। কিন্তু সে কষ্ট বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। নাথদা, বিশ্বাসকাকু রিটায়ার করেছেন যথাসময়ে। কিন্তু সেই স্বঘোষিত স্বপ্নের দেশে ওঁদের ফেরা হয়নি। রেলনগরীর আশেপাশে ভাড়া বাড়িতে শেষ দিনগুলো কাটিয়ে গেছেন।
ছিলেন ডেসপ্যাচ সেকশনে পিওন, পরে রেকর্ড সর্টার, শেষে ওই সেকশনেরই বড়বাবু। মুখার্জিদার জীবনটা যে কোনও গল্পকারের বিষয় হতে পারত। দেশভাগের পর উত্তরবঙ্গে এসে বসতি গড়েন। দুই বাংলার ভাষার এক অদ্ভুত মিশেলে কথা বলতেন। সারা দিন মুখে জ্বলন্ত বিড়ি, পারিষদদের মধ্যে বসে অনর্গল গুল মেরে চলেছেন। এক দিন টিফিনে পাকড়াও করলাম: শুনেছি আপনি বড়লোকের ছেলে, আপনাদের সোনাদানার গল্প উত্তরবঙ্গের লোকের মুখে মুখে ফেরে। তা আমাদের, মানে নতুন ছেলেদের একটু শোনান! একটা সিগারেট এগিয়ে দিলাম। খুব খুশি হয়ে শুরু করলেন মুখার্জিদা: ‘এ সব নিশ্চয় তোমাদের রমাপতি কইসে! একঐ গল্প বারংবার কইতে ভাল্লাগে না। তবু তোমরা নূতন, মুখার্জিদার ব্যাক হিস্ট্রি তোমাদের জানোনের প্রয়োজন আছে বইকী।’ বললাম, আপনাদের সোনাদানার গল্পটা বলুন। লজ্জা-লজ্জা মুখে বললেন: ‘হ্যাই দ্যাশে আমার ঠাকুরদার একখান গোল্ড মাইন আছিল। এক গরুর গাড়ি সোনা লইয়া আমার বাবা নর্থ বেঙ্গলে আসেন।’ কেঁপে চেয়ারের হাতল আঁকড়ে বললাম, এক গাড়ি? ‘তবে দান-খয়রাতির পর অহন বাড়ির ছাদে দুইখান শিলনোড়া আর খান কয়েক পইতা অবশিষ্ট আছে।’ সোনার শিলনোড়া, পইতা...? মলিন পাঞ্জাবির ফাঁকে নিজের তেলচিটে পইতেটাকে আড়াল করে বললেন, ‘কি, বিশ্বাস হইল না তো?’ সিগারেট শেষ, বেরিয়ে গেলেন।
সব শেষে সাধনবাবুর কথা। বাংলা ভাষায় অগাধ জ্ঞানের অধিকারী সাধনবাবুকে ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী এক জন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘থ্রু প্রপার চ্যানেল’-এর বাংলা অনুবাদ কী হবে। সুরসিক সাধনবাবুর চটজলদি জবাব ছিল— ‘নির্দিষ্ট খাল দ্বারা প্রবাহিত’!
প্রিয়বন্ধু চট্টোপাধ্যায়, আসানসোল
itz.chatterjee@gmail.com
যেখানেই কাজ করুন, ব্যাংক, রেস্তরাঁ, আইটি, অন্য কোথাও— আপনার অফিসের পরিবেশ পিএনপিসি
হুল্লোড় কোঁদল বস কলিগ ছাদ ক্যান্টিন— সব কিছু নিয়ে ৭০০ শব্দ লিখে পাঠান।
ঠিকানা: অফিসফিস, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১