রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৬ ০০:০৩
Share:

প্রকৃতির প্রতিশোধের ফিরতি প্রতিশোধ নিল মানুষ। গত কয়েক দশকে আস্তে আস্তে চরমে পৌঁছে গিয়েছিল গরম। সকাল সাতটাতেই ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাড়তে বাড়তে দুপুরে ৫০ ডিগ্রি ছুঁইছুঁই। অতএব প্রাণ বাঁচাতে এত দিনের জীবনযাত্রার উলটপুরাণ তৈরি করতে হল। সরকারি ভাবে এই নতুন জীবন-যাপনের এক মাস পূর্ণ হল আজ। এখন সকাল থেকেই তোড়জোড় শুরু হয় দশটা-এগারোটার মধ্যে খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার। কারণ সন্ধে পাঁচটা-ছ’টার মধ্যে উঠে পড়তে হবে। তার পর বাজার করে আনলে তবে না খেয়েদেয়ে বেরনো যাবে! দেশ জুড়ে এখন অফিস চলছে রাত দশটা থেকে ভোর পাঁচটা। চাষির চাষবাস রাতে। সে জন্য গবেষণাগারে কৃত্রিম সূর্য তৈরি করে ভারতের ওপর টাঙানো হয়েছে। সন্ধে হলে সেটি জ্বলে। এই ভাল সূর্যের আলো আছে, তেজ নেই। এ দিকে সত্যিকারের সূর্যের প্রখর রোদে ছোটাছুটি থেকে বিরাম পেয়ে মানুষ খুব খুশি। ডিহাইড্রেশন আর সানস্ট্রোকে আর মরতে হচ্ছে না। ঘাম না হওয়ায় ক্লান্তিও কম। এতে উৎপাদনক্ষমতা বেড়েছে। গত এক মাস সারা রাত জেগে রয়েছে সবাই। কমেছে অপরাধপ্রবণতা। সকলে বলছেন প্রখর তাপের ভ্রুকুটি মানুষের ক্ষেত্রে শাপে বর হয়েছে। তবে মুশকিলে পড়েছে অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদজগৎ। বিশেষ করে পেঁচা-বাদুড়-ভূত ইত্যাদি নিশাচরেরা ভীষণ অসুবিধেয় পড়েছে। পাখিরা কখন উড়তে বেরবে, কখন বাসায় ফিরবে, কখন ডাকাডাকি করে সবাইকে ঘুম থেকে তুলবে, বার বার গুলিয়ে ফেলছে। ইঁদুর ও কুকুররা লাগাতার অদ্ভুত আচরণ করছে, যেমন তারা গ্রহণ লাগলে করে। গাছেরাও এত দিন সূর্য ডুবলে ঘুমোত। গত এক মাসে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, রাতে তাদের কাছাকাছি গেলে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড’এর অস্তিত্ব টের পাওয়া যেত, তার মাত্রা ধীরে ধীরে কমছে। অর্থাৎ তারা অন্যদের চাইতে অনেক তাড়াতাড়ি মানুষের নতুন ব্যবস্থায় নিজেদের সইয়ে নিচ্ছে।

Advertisement

তপনকুমার দাস, নাশড়াপাড়া, নদিয়া

Advertisement

লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

কমরেড, উই শ্যাল ওভারকাম...

সত্তরের দশকের শুরুতে আমি স্কুলছাত্রী, থাকতাম মালদা’র জেলারের কোয়ার্টার্সে। জেলখানার ওপরেই ছিল সেই কোয়ার্টার্স। আমার বাবা, প্রবোধ চন্দ্র তালুকদার তখন সেই জেলের ‘জেলর সাহেব’। বাবা আর মা, দুজনেই ছিলেন সংস্কৃতিমনস্ক। জেলবন্দিদের সঙ্গে আমাদের সবারই একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

সেই ঘনঘোর নকশাল আমলে সারা মালদহ তটস্থ থাকত এক জন সৎ, দক্ষ, দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুলিশ অফিসারের ভয়ে। অশ্বিনী পাঠক সাধারণের কাছে ‘অশ্বিনী দারোগা’ নামেই পরিচিত ছিলেন। ওঁর প্রশ্নাতীত সততার একটা গল্প লোকের মুখে মুখে ফিরত। ১৯৫৩ সালে ওঁর তত্ত্বাবধানে গৌড়ের কিছু জায়গায় মাটি খোঁড়াখুঁড়ি হয়। এক জায়গায় শ্রমিকরা মাটির তলা থেকে চল্লিশ ঘড়া সোনার মোহর উদ্ধার করে। সমস্ত মোহরই দারোগাবাবু সরকারের ঘরে জমা দিয়েছিলেন, একটাও এ দিক-ও দিক হয়নি। তৎকালীন রাজ্যপাল পদ্মজা নাইডু নিজে মালদহে এসে দারোগাবাবুকে সম্মানে ভূষিত করেছিলেন।

নকশালরা তখন পুলিশ, দারোগা থেকে প্রশাসনের অনেকেরই মুন্ডু চাইছে, ‘অপারেশন’ চালাচ্ছে। অশ্বিনী পাঠক তাদের কাছে প্রথম টার্গেট। জেলর হওয়ার সুবাদে বাবার সঙ্গে ওঁর খুবই হৃদ্যতা ছিল। বাবা প্রায়ই ওঁকে বলতেন, ‘দারোগাবাবু, একটু সাবধানে থাকবেন।’ উনিও হেসে জবাব দিতেন, ‘জেলরবাবু, আপনিও সাবধানে থাকবেন।’ এরই মধ্যে এক সন্ধেয় ঘটে গেল ঘটনাটা। দারোগাবাবু ডিউটি সেরে বাড়ি ফিরছিলেন, রাস্তার মাঝখানে আট-ন’জন যুবক ওঁকে ঘিরে ধরে, এলোপাথাড়ি ছুরি চালাতে থাকে। মুখে স্লোগান ‘নকশালবাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের...’ রক্তাক্ত দেহটাকে রাস্তায় ফেলে ওরা পালিয়ে যায়। কেউ ধরা পড়েনি। এস পি’র জিপ এসে দারোগাবাবুকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। তত ক্ষণে সব শেষ। সঙ্গে সঙ্গে কার্ফু। দারোগাবাবুর মৃত্যুসংবাদ আসার পর গোটা মালদহ স্তব্ধ হয়ে গেল।

পর দিন মর্গ থেকে বডি বের করে, জেল-এর পাশেই পুলিশ লাইনে আনা হল, তখন বিকেল চারটে। বাবার সঙ্গে গেলাম। চাদরে ঢাকা, ‘পাঠককাকু’র সমস্ত শরীরের রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে গিয়েছে তখন। মুখটাও। ভয়ে, আতঙ্কে, কষ্টে বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। সারা মালদহ ভেঙে পড়েছিল ওঁকে দেখতে। গান স্যালুট, গান ফায়ার আর করুণা স্যরের তত্ত্বাবধানে বিউগলের করুণ সুরে সাজানো ছিল ওঁর শেষযাত্রার পথ।

নকশাল যুবকের কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জেলে। তার পর?

সত্তরের দশকের এই দৃশ্য আজও বহু মানুষের স্মৃতিতে।

জেলর হওয়ার সুবাদে বাবার ডিউটি ছিল চব্বিশ ঘণ্টা। সারা বছরই শেষরাত থাকতে থাকতে বাবাকে অফিস যেতে হত। পাঠককাকুর মৃত্যুর পর মা’কে একটা অসম্ভব ভয় ঘিরে থাকত। রোজ শেষরাত্রে টর্চ জ্বালিয়ে, আমাকে সঙ্গে নিয়ে মা দোতলা থেকে নেমে সিঁড়ি, সিঁড়ির তলা, আশেপাশে বাগানে কেউ লুকিয়ে আছে কি না দেখে, তবেই আমাকে পাঠাতেন বাবাকে নিয়ে আসার জন্য। বাবা এলে মা তাড়াতাড়ি জেলখানার দরজা খুলিয়ে বাবাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিতেন।

জেলের ভেতর তখন অনেক নকশাল ছেলে। আমার অনেক বন্ধুর দাদারাও ছিল। মালার দাদা রুণুদা, নৃপেন... যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ছাত্র তিমির। তিমির পুলিশের ভয়ে কালিয়াচকের একটা চায়ের দোকানে কাজ নিয়েছিল, ধরা পড়ল। জেলে আসার পর বাবার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেল ওর। জেলর আর জেলবন্দি, দুজনের মধ্যে তুমুল আলোচনা চলত রাজনীতি থেকে সাহিত্য, সব নিয়ে। বাবার অফিসেই ও বেশির ভাগ সময় কাটাত। বাবা এক দিন হাসতে হাসতে মাকে বলছিলেন, ‘তিমির বলছে, সব মায়েদেরই গোর্কির মা হওয়া উচিত।’

তিমিররা আসার পর জেলের আবহাওয়া একদম বদলে গেল। রোজকার ‘গুনতি’র পর, সন্ধেয় সব ঘরের দরজায় তালা পড়ে গেলে শুরু হত ‘কমরেড, উই শ্যাল ওভারকাম সামডে’। সমস্বরে গাওয়া সেই গান, জেলখানার নিস্তব্ধতাকে খানখান করে, ছড়িয়ে যেত বাইরে। দোতলা থেকে শুনে আমারও কেমন একটা ঘোর লাগত।

জেলবন্দি নকশালদের মা-বাবা, আত্মীয়রা ছেলেদের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। এই জেলে কখনও, কোনও দিনও, কোনও রকম গন্ডগোল হয়নি। হঠাৎ এক দিন শুনলাম, উপরমহলের নির্দেশে পর দিনই এখানকার নকশাল বন্দিদের বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলে চালান করা হবে। বাবার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি জানলা দিয়ে বসে বসে দেখতাম জেলের ভিতরটা, সবার সঙ্গে গল্প করতাম। ওরা চলে যাওয়ার পর জেলখানাটা একদম চুপ হয়ে গেল। সন্ধে হলেই আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করতাম, কোথাও কি কেউ ‘কমরেড!’ বলে হেঁকে উঠল? ছটফট করতাম ‘আমরা করব জয়’ শোনার জন্য।

সেই অভিশপ্ত রাতটা এল তার পর। বাবা উদ্‌ভ্রান্তের মতো পায়চারি করতে করতে, ফ্যাসফেসে গলায় বলছেন, ‘সব শেষ হয়ে গেল। বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলে তিমির, নৃপেনদের সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলেছে।’ মা ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। আমরা চুপ। গলার কাছটায় দলা পাকানো কষ্ট। দিনের পর দিন বাবা কিছু খেতে পারতেন না। অফিসের সময়টুকু কোনও মতে শান্ত, সারা রাত অস্থির পায়চারি করতে করতে অস্ফুটে বলতেন, ‘মেরে ফেলল? ওই বাচ্চা ছেলেগুলোকে মেরে ফেলল?’ বাবার কাছে কেউ ‘কয়েদি’ ছিল না।

কয়েক দিন বাদে স্কুলে গেলাম, নৃপেনের বোনের সঙ্গে দেখা। ‘দাদার বডি আনতে বহরমপুর গেছিলাম রে। দেখি, বডিগুলোকে ইঁদুরে খাবলে-খাবলে খাচ্ছে। দাদার পেটের ভেতর ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি করছে। মা দেখে অজ্ঞান হয়ে গেল, বাবা চুপ। আর কোনও দিন ভাইফোঁটা দিতে পারব না রে...’ ডুকরে উঠল ও।

দীপা তলাপাত্র, গোপীমোহন দত্ত লেন, কলকাতা

dipatalapatra.sampurna@gmail.com

সৎতরের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 70’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement