লংকা
পিনাকী ভট্টাচার্য
কলম্বাস যখন পূর্বের বদলে পশ্চিমে ভেসে পড়েছিলেন, তখন ইউরোপে এক অদ্ভুত খাদ্য-সমস্যা চলছে। মাছ-মাংস-সবজি সবই ভরন্ত বাজারে, কিন্তু খাবার মুখে তোলা যায় না। কারণ, রান্নার মশলা সেখানে বাড়ন্ত। মশলা আসত ভারতবর্ষ আর কিছু পুবের দেশ থেকে। আনত আরব বণিকরা। কিন্তু তারা কখনওই রান্না সুস্বাদু করার মশলা বেশি করে আনত না। শুধু আজগুবি সব গপ্প ফেঁদে, মশলার দাম আগুন করে দিত। খাবার ঝাল আর মুখরোচক করতে তখনও গোলমরিচের জুড়ি ছিল না। তাই, আকাশছোঁয়া ছিল তার দাম, এতটাই, যে গোলমরিচকে ‘কালো সোনা’ বলা হত। একমাত্র সুখে ছিল ভেনিসের মানুষরা। কারণ, এই মশলা ভারতবর্ষ থেকে ভারত মহাসাগর পেরিয়ে আফ্রিকায় পৌঁছত, আর সেখান থেকে ভূমধ্যসাগর উজিয়ে ঢুকত ভেনিসের বাজারে। কিন্তু সুখ চিরকাল থাকে না। অটোমান শাসনকালে এই প্রচলিত রুট বন্ধ হয়ে গেল। ইতালীয়রা দারুণ আর্থিক সংকটে পড়ল। কারণ ভেনিসের বাজার থেকেই দেশের সিংহভাগ রাজস্ব আসত।
কলম্বাসও জাহাজে উঠেছিলেন ভারতবর্ষে গিয়ে গোলমরিচ আর অন্যান্য মশলা নিয়ে এসে, দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে। তার সঙ্গে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের রাস্তা তৈরিরও ইচ্ছে ছিল।
তিনি নতুন দেশে পৌঁছে দেখলেন, লোকে লংকা দিয়ে রান্না করে হুসহাস করে খাচ্ছে। দেখে তাঁর বিশ্বাস আরও পোক্ত হল, নিশ্চয়ই এটা ভারতবর্ষের কোনও দ্বীপ। এই নিয়ে তিনি যে চিঠি লেখেন, তাতে স্থানীয়দের ঝাল-ঝাল উপাদেয় খাওয়াদাওয়ার কথা আছে। প্রায় চার হাজার বছর ধরে সেখানকার লোক তারিয়ে তারিয়ে খেত ‘আজি’ বলে এক রকম লংকা। কলম্বাস সেই ‘আজি’কেই মরিচদানার জনক বলে ধরে নিলেন।
ইউরোপ বলতেই পারে, ‘আমাদের কাছে কলম্বাস লংকার আবিষ্কারক’, কিন্তু সারা দুনিয়াকে মোটেও তিনি প্রথম লংকা চেনাননি। আমেরিকার আদি অধিবাসীদের রান্নায়, কিংবা মায়া ও ইনকা সভ্যতায় নানা খাবারে তেড়ে লংকা ব্যবহার হত। সেখানকার ওষুধেও লংকা পড়ত। লংকাগাছ প্রথম হয়েছিল ব্রাজিল আর কলম্বিয়ার মাঝখানের পাহাড়ি অঞ্চলে। আর সেখান থেকে পাখিদের ঠোঁটে ঠোঁটে আর স্থানীয় মানুষদের হাত আর হাতায় করে ছড়িয়ে পড়েছিল একটা বড় অঞ্চলে। কলম্বাস ইউরোপে ফেরার কিছু দিন বাদে পরিষ্কার হয়ে যায় তিনি ভারতবর্ষে যাননি, কিন্তু এক নতুন দেশ আবিষ্কার করে এসেছেন। স্প্যানিশরা সেই দেশে নিজেদের মৌরসিপাট্টা গড়তে সেখানে পৌঁছল। আর দেখতে দেখতে নিজেদের সব খানাপিনায় আচ্ছা করে লংকা মাখাতে লাগল।
কলম্বাস আরও এক জায়গায় সাংঘাতিক ভুল করেছিলেন। দেশে ফিরে তাঁর আবিষ্কারের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে স্পেনের সান্তা মারিয়ার গির্জায় তীর্থ করতে গেলেন তিনি। সঙ্গে গেল লংকা। তাঁর আবিষ্কৃত গাছের ফল, যাকে তিনি তখনও গোলমরিচের রকমফের বলেই জানেন। সেটি তিনি উপহার দিলেন গির্জার সাধুদের। অচিরেই সেই সাধুদের মাধ্যমে লংকা ছড়িয়ে পড়ল সারা স্পেনে, তার পর ইউরোপের অন্যান্য দেশে। ভাস্কো দা গামা-র মারফত লংকা পৌঁছল ভারতে। অনুকূল প্রকৃতি পেয়ে নানা রকম লংকা ফলতে লাগল। রান্নাঘরে গোলমরিচের দাপট গেল, সিংহাসনে বসল লংকা। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পূর্ব ভারতে নোঙর ফেলল নানা কারণে, তার একটা ছিল, এখানকার লংকা রফতানি করা। তার পর অবশ্য নিজেরাই ঝাঁঝালো হয়ে দেশটার প্রাণ ওষ্ঠাগত করল। সে অন্য প্রসঙ্গ।
pinakee.bhattacharya@gmail.com
কুমিরের করোটি খঞ্জনার কান্না
স্বপ্নময় চক্রবর্তী
বন্ধুরা বেড়াতে যেতাম। এখনকার সাজুগুজু বেড়ানোর সঙ্গে তখনকার উলুগুলু বেড়ানোর কোনও তুলনাই চলে না। আমাদের পাঁচ-ছ’জনের একটা দল ছিল। তারা এখন কেউ সফল ডাক্তার, কেউ বিফল লেখক, কেউ ফলের আশা-না-করা ফল ব্যবসায়ী, কেউ বিদেশে। এক জন আর পৃথিবীতে নেই, ওর নাম বরেন ভট্টাচার্য। নকশাল করত। জেলে ঢোকে ১৯৭২-এ। বামফ্রন্ট সরকার ১৯৭৭-এ ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিলে বরেনও ছাড়া পায়, কিন্তু রাজনীতি ছাড়ে না। সিপিআই (এম এল)-এর লিবারেশন গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত থাকে, যাদের নেতা ছিলেন বিনোদ মিশ্র। ওর মা ছিলেন হাসপাতালের আয়া, ওর দাদা নিরুদ্দেশ, কেউ বলত সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয়ে। একটা বস্তিতে থাকত। যৎসামান্য একটা কাজ করত। বলত, বিপ্লবের পর নতুন সমাজ ওকে ওর উপযুক্ত কাজ বেছে দেবে।
আমরা কোথাও বেড়াতে গেলে বরেনকে সঙ্গে চাইতাম। বিপ্লবের ক্ষতি করেও ও আমাদের সঙ্গে যেত। এক বার বেতলার জঙ্গলে গিয়েছিলাম, ওখানে তখনও কিছু নকশাল এলাকা ছিল। কিন্তু তখনও ‘মাওবাদী’ শব্দটার এতটা নিন্দাবাচক ব্যবহার ছিল না।
বরেন বলেছিল— এমনও হতে পারে, এখানে জঙ্গলে হঠাৎ দাদার সঙ্গে দেখা। দাদার হাতে থানা লুট করা রাইফেল। আমায় চিনতে পেরে জড়িয়ে ধরল, তার পর রাইফেলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, এটা তোর জন্য কমরেড। কানাই একটা ব্যবসা করত। আমাদের সবার চেয়ে ওর রোজগারই বেশি। কানাই বলল, তা হলে তো আমার হয়ে গেল! আমিই তো এখানে বেস্ট শ্রেণিশত্রু। গ্রামের হাট থেকে দরাদরি করে একটা দেশি মুরগি কেনা হয়েছিল। বরেন রাত্রে ওই মুরগি স্পর্শ করেনি, কারণ দরাদরি করে আদিবাসীদের কাছ থেকে মুরগি কেনা হয়েছিল। মানে, গরিবকে ঠকানো হয়েছিল। এই দিকুগিরি করা মাংস রাজনৈতিক ভাবে সিদ্ধ ছিল না।
এক বার আমরা সুন্দরবনে বেড়াতে গিয়েছিলাম। গোসাবা আর পাখিরালার মাঝামাঝি একটা গ্রামে, এক চাষির ঘরে রাত্রে কাঁকড়া-ভাত খেয়ে, ওদের ঢেঁকিঘরে খড়ের উপর চটের বস্তা পাতা বিছানায় রাত কাটিয়েছিলাম। পর দিন ওই গৃহস্থ জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা একটা কুমিরের করোটি দেখায়। বলে, বিক্রি করতে চায়। কত দিতে হবে? ও বলে ‘সে আপনারা ঝা লাজ্য বোঝেন, তা-ই দেবেন।’ প্রতাপ নামে আমাদের এক বন্ধু সবে ডেন্টিস্ট হয়েছে। ও বলল, কুমিরের দাঁতগুলো এই স্কালে খুব সুন্দর সাজানো। খুব ইন্টারেস্টিং, আমি নেব। তিরিশ টাকা দিতে চাইল। তখন তিরিশ টাকা খুব কম নয়। পনেরো কেজি চাল কিংবা বিশ কেজি আলু হয়ে যায়। লোকটা দিয়ে দিল। বরেন ডাক্তারবাবুদের জিজ্ঞাসা করে জেনেছিল, ওরা অ্যানাটমি পড়ার সময় মানুষের খুলি কিনেছিল আশি টাকায়। বরেন বলল, তা হলে তো নিশ্চিত ভাবে ঠকানো হয়েছে। মানুষের খুলির তুলনায় কুমিরের খুলির দাম অন্তত দশ গুণ বেশি হওয়া উচিত। প্রতাপ বলল, ও তো কুড়িয়ে পেয়েছিল। তার পর তো ঘরেই পড়ে ছিল। যা পেল তা-ই ওর লাভ। বরেন রেগে গেল। বলল, আ ল্যান্ড ইজ হিজ হু টিল্স, অ্যান্ড আ কুমির ইজ হিজ হু পিল্স ইট। ‘পিল্স’ মানে? বরেন বলে, ডিকশনারিতে যা-কিছু থাকতে পারে। ধরে নে, এর মানে ‘পাওয়া’। যে পেয়েছে, ওটা তার। ওদের মতো মূলবাসীদের জঙ্গলের উপর অধিকার আছে। জঙ্গলের সব কিছু ওদের। ওকে আরও পঞ্চাশ টাকা মিনিমাম দিয়ে দে। প্রতাপ বলল, আমার কাছে আর টাকা নেই। ও তিরিশ টাকায় খুশি, এর পর আর কথা হতে পারে না। বরেন বলে, ঠিকানা নিয়ে চল, বাকি টাকা মানি-অর্ডার করে পাঠিয়ে দিবি। আধা-ফিউডালিস্টিক আধা-বুর্জোয়া কায়দায় কুমিরের দাঁত দিয়ে চেম্বার সাজাবি, অথচ কুমিরশ্রমিক ন্যায্য মজুরি পাবে না, সেটা হতে পারে না।
বরেন বিয়েও করেছিল। মেয়েটি অত আধা-ফিউডাল, পুরো ফিউডাল বোঝে না। তবে বরেন বলেছিল, গলায় সুর আছে মেয়েটার— উই শ্যাল ওভারকাম আর ইন্টারন্যাশনাল তুলে নিয়েছে। বরেন তখন একটা ইংরাজি খবরকাগজে কৃষিপণ্য বিট করত। পাকা চাকরি ছিল না। পার্টিটাও করত। আমাদের মতো অরাজনৈতিক বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল, তবে প্রতাপের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত না। কারণ, প্রতাপ কুমিরের মাথার ব্যাপারটা মাথায় রাখেনি। টাকা পাঠায়নি। প্রতাপ অবশ্য কিছু দিন পরই ইমিগ্রেশন নিয়ে কানাডা চলে যায়।
বরেনের প্যানক্রিয়াসে ক্যানসার ধরা পড়ে ২০০৬ সালে। শেষ বিছানায়, ডাক্তাররা ইঞ্জেকশন ফুঁড়লে বলত— যতই সূচ ফোটান, ব্লেড দিয়ে গা চিরে দিন, সুপ্রিয়দা কোথায় আছে আমি বলব না। ডেলিরিয়ামে একটা নার্সকে রোজা লুক্সেমবুর্গ ভাবত। নিজের স্ত্রীকেও গোর্কি’র মাদারের চরিত্র নিলোভনা ভেবেছে। কখনও বলেছে, এখনও রেডি হতে পারিনি চে, আমার অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে। প্রতাপ ওর অসুখের কথা জেনে চিকিৎসার জন্য কিছু ডলার পাঠিয়েছিল। আমরা ধর্মসংকটে পড়েছিলাম— ওই টাকা ওর চিকিৎসার জন্য খরচ করব কি না, সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। দরকার হয়নি। ও মারা যায়।
বিদ্যুৎচুল্লির জ্বলন্ত হাঁ-মুখে আমার দেখা রাজনৈতিক সততার শেষ রোমান্টিক সত্তাটি ঢুকে যাবার সময় বেসুরে ইন্টারন্যাশনাল গাইছিল ক’জন— জাগো অনশন বন্দি... জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত। তখন সেই ভুল নিলোভনা, বরেনের স্ত্রী, ছিন্ন খঞ্জনার মতো গানের পিছনে কেঁদে চলেছিল। শুধু ক্রন্দন, কোনও রাজনৈতিক শব্দ ছিল না তাতে।
swapnoc@rediffmail.com