রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

এক গ্রামে রসুন নামে এক কিশোরী মা-বাবার সঙ্গে থাকত। বাবা বণিক। দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়িয়ে বাণিজ্য করতেন আর দেশে ফিরে মেয়ের সব আহ্লাদ মেটাতেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০০
Share:

পিনাকী ভট্টাচার্য

Advertisement

এক গ্রামে রসুন নামে এক কিশোরী মা-বাবার সঙ্গে থাকত। বাবা বণিক। দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়িয়ে বাণিজ্য করতেন আর দেশে ফিরে মেয়ের সব আহ্লাদ মেটাতেন। সেই গ্রামেরই একটা ছেলের নাম তার পেঁয়াজ, সে মার সঙ্গে থাকত। এক দিন হঠাৎ রসুনের মা মারা গেলেন। পেঁয়াজ আর তার মা নিয়মিত রসুনের খবর নিত আর খাবার পাঠাত। রসুনের বাবা সব দেখেশুনে ঠিক করলেন, পেঁয়াজের মাকে বিয়ে করবেন। এক দিকে এক বিধবার আশ্রয়ও হল, আর পেঁয়াজ-রসুন একসঙ্গে থাকতে শুরু করল।

লোককথা তো হল। পেঁয়াজের সঙ্গে হেঁশেলের সম্পর্ক কিন্তু প্রায় সাড়ে চার হাজার বছরের। মিশরীয় সভ্যতায় পেঁয়াজকেও উপাসনা করা হত বলাই যায়, ফারাওদের সঙ্গে পেঁয়াজ কবর দেওয়া হত। কারণ পেঁয়াজকে অমরত্বের প্রতীক মনে করা হত। মিশরীয়রা পেঁয়াজে অসংখ্য পরতের মধ্যে চিরন্তন জীবন-চক্রের মিল খুঁজে পেয়েছিল। তাই পিরামিডের ভেতরের দেওয়ালে পেঁয়াজের ছবি আঁকা থাকত। মৃত ফারাওয়ের দেহের বিভিন্ন জায়গায় পেঁয়াজ বসিয়ে দেওয়া হত। কোথায় কোথায় জানেন? ঠিক যে যে অঙ্গে আমরা মাটি লেপি আদ্যশ্রাদ্ধে বসার আগে!

Advertisement

গ্রিকরা পেঁয়াজের গুণাগুণ নিয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিল। তবে তাদের পেঁয়াজ-প্রীতি বহুগুণ বেড়ে যেত অলিম্পিকের সময়। প্রতিযোগীরা সের সের পেঁয়াজ খেত, লিটার লিটার পেঁয়াজের রস গলাধঃকরণ করত, সারা শরীরে পেঁয়াজের রস মাখত। তাদের ধারণা ছিল যে পেঁয়াজ শরীরের গাঁট শক্তপোক্ত করে আর ব্যথা-বেদনা তাড়ায়। রোমানদের রোজের খাবারে পেঁয়াজের নাম থাকতই। শাসনের উদ্দেশ্যে যখন তারা গোটা রোমানিয়া আর জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়ল, সুস্থ থাকতে পেঁয়াজ সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। পম্পেই নগরে থাকতেন জ্যেষ্ঠ প্লিনি। তিনি রোমানদের এই বিশ্বাসের কথা লিখেছেন। আর পেঁয়াজের কত গুণ, তা নিয়ে তো প্রায় ক্যাটালগ-ই লিখেছেন। মধ্য যুগেই সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের গণ্ডিতে চিরকালের মতো ঢুকে পড়েছিল তিন সবজি। বিন্‌স, বাঁধাকপি, পেঁয়াজ।

আমাদের দেশে কিন্তু পেঁয়াজের জন্যে দরজা দরাজ করে খোলা ছিল না কোনও দিন। বেদ-উপনিষদ— কোথাও পেঁয়াজের উল্লেখ নেই, কারণ পেঁয়াজ ছিল ‘যবন আর ম্লেচ্ছদের খাবার’। সাত্ত্বিক জীবনে পেঁয়াজ-রসুনের জায়গা ছিল না, কারণ লোকে বিশ্বাস করত পেঁয়াজ আর রসুনে জৈবিক উত্তেজনা বাড়ে। ছাত্র আর বিধবাদের কাছে তো এক্কেবারে নিষিদ্ধ ছিল এই খাবার। ফা-হিয়েন তাঁর ভারত ভ্রমণের সময় সারা দেশে পেঁয়াজের ব্যবহার দেখতেই পাননি, আর হিউয়েন-সাং যদি বা দেখেছিলেন, সঙ্গে এও লক্ষ করেছিলেন, পেঁয়াজ খেলে শহরের পাঁচিলের বাইরে নির্বাসন দেওয়া হত। পেঁয়াজকে প্রথম কৌলীন্য দেন চরক। তাঁর আয়ুর্বেদ বইয়ে পেঁয়াজের গুণের কথা লেখেন।

ইবন বতুতার লেখায় আছে, তেরো শতকে দিল্লির সুলতানের দরবারে ভাজা পেঁয়াজের পুর দেওয়া শিঙাড়া খুব জনপ্রিয় ছিল। আর ‘আইন-ই-আকবরি’-তে লেখা সব পদেই পেঁয়াজের ছড়াছড়ি! এখান থেকেই ধাপে ধাপে পেঁয়াজ এ দেশের সাধারণ মানুষের হেঁশেলে ঢুকে পড়ল, ‘মিস্‌সি রুটি’ আর অন্যান্য মাংস-বর্জিত খাবারের মাধ্যমে। এখন তার দাপট এতটাই যে নবরাত্রি বা বিশেষ কিছু পরব বাদে, অবাঙালি নিরামিষ হেঁশেলে পর্যন্ত খাবারের স্বাদ খোলতাই করে বেড়ায়। বরং, আমাদের বিশুদ্ধ বাঙালি নিরামিষ হেঁশেলেই এখনও পেঁয়াজের চৌকাঠ পেরনো মানা!

pinakee.bhattacharya@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement