মেমরিজ ইন মার্চ

এমন কিছু লাইন লিখে আপনি নিশ্চিত, কালিদাসের পর মেঘের সঙ্গে এতটা অন্তরঙ্গতা দেখায়নি কোনও কবি। তবে এই মার্চেই আষাঢ়ে কবিতা লিখতে হচ্ছে, কারণ ছোট পত্রিকার সম্পাদকরা ভারী ব্যস্তবাগীশ আর নাকউঁচু।

Advertisement

দেবরাজ রায় চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০০
Share:

ওরে বেয়াড়া মেঘ, তোর জন্য পেগ

Advertisement

সাজিয়ে, বসেছিলাম গতকাল।

ক্যালেন্ডারে দেখি আষাঢ়,

Advertisement

তবু তোর হয়নি সময় আসার?

ইতি— এই শহরের কিছু রাখাল।।

এমন কিছু লাইন লিখে আপনি নিশ্চিত, কালিদাসের পর মেঘের সঙ্গে এতটা অন্তরঙ্গতা দেখায়নি কোনও কবি। তবে এই মার্চেই আষাঢ়ে কবিতা লিখতে হচ্ছে, কারণ ছোট পত্রিকার সম্পাদকরা ভারী ব্যস্তবাগীশ আর নাকউঁচু। আষাঢ়ের কবিতা তাঁরা নির্বাচন করেন মার্চেই! সে হোকগে, বাইরের আবহাওয়াটা সেই সব সুন্দরী নারীর মতো, যারা সব সময় আসে না আর এলেও বেশি ক্ষণ থাকে না। একটা ওয়ান্ডারফুল ওয়েদার, আজ চাদর তো কাল ফ্যান। বাতাসে বসন্ত, আশেপাশে উল্লাসের উপকরণও যেন অনন্ত, তার উপর সক্কাল সক্কাল একখানা গোলা কবিতা নামানোর পর স্বাভাবিক ভাবেই মেজাজ শরিফ, এক কাপ মকাইবাড়ি আর গোল্ডফ্লেক কিং সাইজসহ আপনি পা দোলাতে দোলাতে ভাবছেন বাংলা কবিতার মোড় ঘুরে যাবে আপনার হাতেই, এমন সময় নিতান্ত নিরীহ একটা এসএমএস আপনার মুডের সত্যনাশ করে দিল।

স্টেট ব্যাংক মেসেজটা পাঠিয়েছে। আজ পয়লা মার্চ, যথারীতি ফেব্রুয়ারি মাসের মাইনেটা আপনার অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে গেছে। কিন্তু তার অঙ্কটা দেখে রীতিমত আতঙ্কিত হলেন আপনি। ফ্ল্যাটের ইএমআই, রেকারিং ডিপোজিট, সব সামলে সামনের ৩১টা দিন চলবে কী ভাবে? আপনি তো বিলকুল ভুলে মেরে দিয়েছিলেন, ইনকাম ট্যাক্সের বকেয়া পুরো টাকাটা ফেব্রুয়ারির মাইনে থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে! এর পর স্ত্রীর কাছ থেকে ধার নেওয়া ছাড়া আর কোনও রাস্তাই খোলা নেই! প্রত্যেক স্ত্রীই, সে গৃহবধূ হোক বা চাকুরিজীবী, তার স্বামীর চাইতে বড়লোক! সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, গত জন্মের পকেটমাররা এই জন্মে স্ত্রী হয়ে জন্মায়।

আপনার স্ত্রী অবশ্য খুব শান্ত গলায় জানিয়ে দিলেন, তাঁর জমানো টাকায় হাত দেওয়া যাবে না, সেটা অন্য কাজে লাগবে। এই ‘অন্য কাজ’টা খুব গোলমেলে ব্যাপার, সেটা ঠিক কী কাজ কেউ জানে না। জিজ্ঞেস করবে, সে সাহস মিলিটারিরও নেই।

এর পরে কী ভাবে আপনি আপনার স্ত্রীকে ম্যানেজ করলেন সেই উপাখ্যান বিস্তারিত বিবৃত করার নয়, তবে মার্চের প্রথম রাতে শুতে যাওয়ার আগে আপনি ভাবলেন, ‘যাক! এ যাত্রা ফাঁড়া কেটে গেল।’ মূর্খ আপনি তখনও জানেন না, মার্চের সঙ্গে সঙ্গেই মার্চ পাস্ট করে দুঃসময়গুলো ধীরে ধীরে এসে ঘিরে ধরছে আপনাকে।

পর দিন অফিসে আপনাকে ধরিয়ে দেওয়া হল ডজন খানেক ফাইল। মার্চ মাস, ইয়ার এন্ডিং, তার যাবতীয় বিভাগীয় রিপোর্ট আগামী কয়েক দিনের মধ্যে তৈরি করে পাঠাতে হবে ওপরে। এ ছাড়া চলতি আর্থিক বছরের সমস্ত পেন্ডিং বিল পাঠাতে হবে ১৫ তারিখের মধ্যে। আগামী বছরের বাজেটও আগাম পেশ করতে হবে এই মাসেই। আবার এই মার্চ মাসেই আপনার ওপরওয়ালা তৈরি করবেন আপনার সারা বছরের কাজের খতিয়ান।

এখন পান থেকে চুন খসলে আপনিও খসে যেতে পারেন, বলা যায় না হয়তো বদলি হয়ে গেলেন বান্দোয়ান কি বনগাঁ! এই সময় অফিসের সামনের গাছটায় বিরামহীন ডেকে চলেছে যে কোকিলটা, সেটা কি আসলে কাশছে?

এর মধ্যে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত অফিসফেরত আপনাকে স্ত্রী ধরিয়ে দিল আপনার পরীক্ষার রুটিন, এই মার্চ মাসেই তো আপনার কন্যার ফাইনাল এগজাম। সে বাঘা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে, তার পরীক্ষা তো আসলে আপনাদেরই পরীক্ষা। অঙ্ক, সাধারণ জ্ঞান এই দুটো পরীক্ষা আপনার, বাকি ইংলিশ, বেঙ্গলি, সোশ্যাল স্টাডি, সায়েন্স, মরাল সায়েন্স, গ্রামার— আপনার স্ত্রীর জিমেদারি। হতে পারে আপনার কন্যা পড়ে মাত্তর ক্লাস টু’তে, কিন্তু তার মা’র মতে: এখন থেকেই বেস তৈরি করা উচিত, নইলে পরে পিছিয়ে পড়বে।

এর পর অফিসের মতো বাড়িতেও ঘন ঘন আপনার কৈফিয়ত তলব হতে লাগল— ‘চ্যাপ্টার ফোরের ওয়ার্ড প্রবলেমগুলো একটাও পারছে না। কনভার্শনগুলো সড়গড় হয়নি। সেভেন আর
এইট-এর টেবিলের মধ্যে গুলিয়ে ফেলছে। আর
‘জি. কে’-র হাল তো খুব খারাপ! এত দিন করলেটা কী? এর চেয়ে টিউশন পড়লেই তো মনে হয় ভাল ছিল।’ আপনার অঙ্ক ও সাধারণ সমস্ত জ্ঞানের উপরই সন্দেহ প্রকাশ করেন আপনার স্ত্রী। সন্দেহ হয় আপনারও, সাবোতাজের। অফিসের মতো বাড়িতেও আপনাকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা? নইলে গত টার্মে সবেতেই মেয়ে পেল ৫০-এ ৫০, আর আপনার অঙ্ক আর জি. কে-তেই কিনা ৩৩ আর ৩৭!

যাই হোক, আপনার দুটো পরীক্ষা হয়ে গেল, এখন রেজাল্ট বের হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিন্ত, এ দিকে ইয়ার এন্ডিংটাও এন্ড করে এনেছেন, বেশ কিছু দিন পর ভেতরের কোকিলটা আবার ঠিকঠাক সুরে গাইছে, এমন সময় সাতসকালে আপনার ফ্ল্যাটে হাজির শালা। মানে আপনার স্ত্রীর এক তুতো ভাই, বিমা-এজেন্ট। মার্চ মাসই তো ওদের আসার সময়। এখনও সন্তানের নামে কোনও পলিসি না থাকা আর নিজের হাতে সন্তানকে জাহাজের কাছি দিয়ে হাত-পা বেঁধে গভীর জলে ঝপাস করে ফেলে দেওয়া একই ব্যাপার, অতএব ‘জীবন খুদেবিচ্ছু’, ‘তুলতুলে জীবন’, ‘জীবন কাঁচাকচি’ ইত্যাদি পলিসির প্রয়োজনীয়তা, সে গভীর মনোযোগের সঙ্গে বোঝাতে লাগল আপনাকে।

রোববার সাতসকালে এতখানি জীবনের জন্য একদম প্রস্তুত ছিলেন না আপনি। বিগ-শপারটা নিয়ে বাজারে বেরিয়ে গেলেন। ব্যাজার মুখে আপনার শালাবাবুও বিদায় নিলেন। ব্যাপারটা মোটেই ভাল হল না। স্বামীর হাতে দাদার অপমান কোনও স্ত্রীই সহ্য করে না।

আপনি বাড়ি ফিরলে প্রথমেই আপনার স্ত্রী আপনার অপদার্থতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, সাংসারিক বোধের অভাব, ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর ঝাঁঝালো বক্তব্য পেশ করলেন, সেখানে অনিবার্য ভাবেই পাশের ফ্ল্যাটের অমুকদা, তমুকবাবুর উদাহরণ এল, আপনাকে তাদের কাছে অনেক কিছু শেখার নির্দেশ দেওয়া হল। ভাষণটা আপনি আগে বহু বার শুনেছেন, প্রায় মুখস্থ। তবে ইদানীং একটা নতুন অনুষঙ্গ যোগ হয়েছে, আপনার অকালপক্ব কন্যাটি তার মার কথার ফাঁকে প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর বলে যাচ্ছে ‘বাবা, মা তো ঠিকই বলছে।’ এতে আপনি যত না বিরক্ত হচ্ছেন, তার মার উৎসাহ তার বহু গুণ বেড়ে যাচ্ছে।

এই সমস্ত কঠিন পরিস্থিতিতে নীরবতাই আপনার একমাত্র নীতি, কিন্তু সে দিন আপনিও দুটো কথা বললেন, ফল হল মারাত্মক। প্রথমে কিছু কাপ, ডিশ অকালে অক্কা পেল, তা পাক, বিবেকানন্দ বলেছেন ওরা তো আর কলেরা, ম্যালেরিয়াতে মরবে না, এ ভাবেই ওদের মৃত্যু। কিন্তু তার পর আপনার স্ত্রী তাঁর নবীন চ্যালাটিকে, মানে আপনার কন্যাটিকে বগলদাবা করে হাঁটা দিল সিধে বাপের বাড়ি।

দু’দিন ও দিক থেকে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। এ দিকে আপনারও ‘যা হওয়ার হবে, শেষ দেখে ছাড়ব’ জঙ্গি ভাবটাও ধীরে ধীরে মিইয়ে আসছে, অফিস থেকে তালা খুলে ফাঁকা ফ্ল্যাটটাতে ঢুকতে মোটেই আর ভাল লাগছে না। কিন্তু কী করবেন সেটাও ভেবে পাচ্ছেন না, দু’তিনটে ফোন তো আপনি করেছিলেন স্ত্রীর মোবাইলে, কেউ ধরেনি, পরে ফোনও আসেনি। এক দিন সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফিরে কপালে হাত রেখে ট্র্যাজেডি লিখবেন ভাবছেন, ঠিক তখনই আপনার মোবাইলে এসএমএস, স্ত্রীর। শেষ কবে আপনাকে ও মেসেজ করেছে! মনে করতে পারলেন না। আপনি ঘাবড়ে গেলেন। খুলে কী দেখবেন? কোনও চরমপত্র?! ডিভোর্স? সেপারেশন? মামলা? থানা-পুলিশ? ভয়ে ভয়ে আপনি মেসেজটা খুলে দেখলেন, লেখা— ‘জেলা স্কুলের সামনে রাস্তায় কী দারুণ লেবুফুলের গন্ধ! তাড়াতাড়ি চলে এসো, আমি দাঁড়িয়ে আছি।

আপনার ঠিক তক্ষুনি মনে হল, ইফ মার্চ কাম্‌স, ক্যান বসন্ত বি ফার বিহাইন্ড?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement